ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট (আইসিইউ) তখন অালোয় ফকফকা। বৈদ্যুতিক পাখাটি মৃদু অাওয়াজ দিয়ে মাথার ওপরে ঘুরছে। অক্সিজেনের সিলিন্ডারে বুদবুদ কাটছে। অারও যন্ত্রের সংযোগ বুকের ওপরে। সাদা চাদরের বিছানায় শোয়া রাজীবের শরীরও সাদা চাদরে ঢাকা। ঘুমে অচেতন। সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজ বিচ্ছিন্ন হাতের বগল থেকে বুকের খানিক অংশ।
এত সাদার মাঝেও ওর শীরের যে অংশটুকু বেরুনো, তা প্রায় নীলাভ রংয়ের ছাপ। অথচ হাত হারানোর অাগে ওর গায়ের রং এমন ছিল না। দুই বাসের চিপায় পড়ে ডান হাত হারিয়ে যে শক (আঘাত) পেয়েছে রাজীব, তা ঘুমের মাঝেও প্রকাশ পাচ্ছে। উচ্চমাত্রার ওষুধ দিয়েও ব্যথা কমানো যাচ্ছে না। ব্যথার যন্ত্রণাতেই ঘুম ভাঙছে। ঘুম থেকে উঠে ব্যথায় অারও কাতরাচ্ছে।
হাতহারা রাজীব! ঘুমের মাঝেও হয়তো বাম হাত দিয়ে ডান হাত খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু পাবে কোথায়! ঘাতক বাসচালকরা যে রাজীবের ডান হাত চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, শত চেষ্টাতেও রাজিব অার ডান হাতের স্পর্শ পাবে না।
নিবিড় পর্যবেক্ষণে অাছে বিধায় রাজীবের স্বজনরা সবাই ভেতরে যেতে পারছেন না। বন্ধুরা দেখতে এলেও ইউনিটের গেটেই অাটকে দেয়া হচ্ছে। বারান্দায় বিছানা করেছেন রাজীবের খালা জাহানারা বেগম। সেখানে রাজীবের মাদরাসাপড়ুয়া ছোট দুই ভাইও বসে। মামা জাহিদুল ইসলাম বাকরুদ্ধ প্রায়। অথচ ভাগ্নেকে বাঁচাতে অন্তহীন ছোটাছুটি তার।
জাগো নিউজকে জাহিদুল ইসলাম বলেন, খাওয়া-ঘুম হারাম হয়ে গেছে। কী করবো বুঝতে পারছি না। এত কষ্ট করে রাজীবের বড় হওয়া। মনে হলেই চোখের পানি অাটকে রাখতে পারছি না। দশ বছর অাগে ওর মা মারা গেল। এরপর বাবাও চলে গেল। এখন হাত হারিয়ে পঙ্গু। জানি না বাঁচবে কিনা? বাঁচলেও এত কষ্ট ও সইবে কীসে!
ভাই জাহিদুলের কথা শুনে জাহানারা বেগমের চোখ তখন ছলছল। ওড়নায় চোখ মুছতে মুছতে বলছিল, অামার রাজীব এখন লিখবে কীসে? ও তো ডান হাতেই লেখে। অামার রাজীব অার লিখতে পারবে না! এতিম ছোট দুই ভাইকে কে অাগলে রাখবে?
মঙ্গলবার দুপুর দেড়টার দিকে রাজধানীর বাংলামোটরের দিক থেকে ফার্মগেটমুখী একটি দ্বিতল বিআরটিসি বাস সার্ক ফোয়ারার কাছে পান্থকুঞ্জের পাশে সিগনালে থেমে ছিল। সে বাসের পেছনের ফটকে দাঁড়িয়েছিলেন রাজীব। খানিকবাদেই একই দিক থেকে আসা স্বজন পরিবহন নামের একটি বাস দ্রুতগতিতে এসে দ্বিতল বাসের বাঁ পাশের ফাঁক দিয়ে ঢুকে সামনে যাওয়ার (ওভারটেক) চেষ্টা করে।
দুই গাড়ি তখন টক্কর দিতে গেলে চাপে পড়ে ডান হাত বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ফটকে দাঁড়ানো রাজীবের। হাতটি দ্বিতল বাসের সঙ্গে ঝুলছিলও তখন। তাৎক্ষণিকভাবে রাজীবকে পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে নেয়া হলেও হাতটি আর জোড়া দেয়া যায়নি। মঙ্গলবারই রাজীবের অস্ত্রোপচার করা হয়।
এ বিষয়ে এক রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বুধবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রাজীবকে এক কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। একইসঙ্গে তার চিকিৎসা ব্যয় বিআরটিসি ও স্বজন পরিবহনের মালিকদের বহন করতে নির্দেশ দেন।
রাজীব হোসেন রাজধানীর মহাখালীর সরকারি তিতুমীর কলেজের ছাত্র। থাকেন যাত্রাবাড়ীর মিরহাজীরবাগের একটি ছাত্রাবাসে।