একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি নিয়ে দেশজুড়ে চলছে বেপরোয়া বাণিজ্য। ভালো কলেজে ভর্তি হতে নগদ টাকা গুনতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এ টাকা গিয়ে ঢুকছে ছাত্রলীগ কলেজ কমিটিগুলোর নেতাদের পকেটে। সমকালের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ভর্তিবাণিজ্য সংক্রমিত কলেজগুলোর সিংহভাগই সরকারি কলেজ। এর ফলে প্রকৃত মেধাবীরা পছন্দসই কলেজে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার কম জিপিএ পাওয়া ছাত্রছাত্রীরাও টাকার বিনিময়ে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা ‘একাদশ শ্রেণীর ভর্তি নীতিমালা’ অনেকটা ‘কাগুজে নীতিমালা’য় পরিণত হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী, কোনো কলেজে আবেদনকারী শিক্ষার্থীকে মেধা তালিকা এসএসসির ফলের ভিত্তিতে শিক্ষা বোর্ড থেকে নির্ধারণ করে দেওয়ার কথা। বাস্তবে দেখা গেছে, ছাত্রলীগ নেতাদের চাপে অধ্যক্ষরা এ নীতিমালা ভেঙে মেধা তালিকার পেছনে থাকা শিক্ষার্থীদেরও ভর্তি করতে বাধ্য হচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এ ক্ষেত্রে অর্থ লেনদেনের সত্যতা স্বীকার করেছেন। ঢাকার বাইরের কয়েকটি কলেজে ভর্তিবাণিজ্য নিয়ে হামলা, সংঘর্ষের ঘটনা সংবাদপত্রে ফলাও করে ছাপাও হয়েছে।
প্রথম দফায় বিলম্ব ফি ছাড়া গত ২৯ জুন ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় বিলম্ব ফি দিয়ে ভর্তি কার্যক্রম শেষ হবে আগামী ২২ জুলাই। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক
তাসলিমা বেগম সমকালকে বলেন, ভর্তি নীতিমালা লঙ্ঘনের প্রমাণ পেলে সংশ্লিষ্ট কলেজ ও অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, আসন অনুযায়ী মেধা তালিকা অনুসারে ভর্তি হওয়ার কথা। বঞ্চিত হয়েছে এমন শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করলে শিক্ষা বোর্ড থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, রাজধানীর পুরান ঢাকার সরকারি কলেজগুলোতে এখন চলছে ছাত্রলীগের বর্তমান ও সাবেক নেতাদের ভর্তিবাণিজ্য। সুযোগ বুঝে বাণিজ্যের এই হার ১৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত গিয়ে ঠেকছে। কবি নজরুল সরকারি কলেজ, সরকারি শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজসহ আরও কিছু কলেজের ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে ভর্তিবাণিজ্যের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, কলেজের অফিস শাখা থেকে ফরম নেওয়ার নিয়ম থাকলেও তা নিতে হচ্ছে ছাত্রলীগ নেতাদের কাছ থেকে।
কবি নজরুল সরকারি কলেজ :পুরান ঢাকার কবি নজরুল কলেজে একাদশ শ্রেণীতে আসনসংখ্যা এক হাজার ২৭০। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে ৩৫০, ব্যবসায় শিক্ষায় ৫৫০ ও মানবিকে ৩৭০ শিক্ষার্থীর ভর্তি হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ২০০ আসন কলেজ শাখা ছাত্রলীগ নেতাদের পছন্দের প্রার্থীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
বোর্ডের মেধা তালিকা অনুযায়ী প্রথম দফার ভর্তি কার্যক্রম শেষ হয়েছে গত ২৯ জুন। এর মধ্যে ভর্তি হয়েছে প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থী। এখন চলছে অপেক্ষমাণ তালিকার শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম। সরেজমিনে দেখা যায়, কলেজের প্রধান ফটকের সামনে অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে টাকা লেনদেন করছেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতাকর্মী। কলেজের একাদশ শ্রেণীর ভর্তি কমিটির দফতরে (২০৬ নম্বর কক্ষ) কাগজপত্র হাতে নিয়ে ঘোরাঘুরি করছেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রকিবুজ্জামান সোহেল।
কলেজের একাধিক শিক্ষক সমকালকে বলেন, ভর্তিচ্ছু অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে নিয়ম ভঙ্গ করে ভর্তির জন্য চাপ দিচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। ইয়াসির সিয়াম নামের এক শিক্ষার্থী জানান, অপেক্ষমাণ তালিকার ৫৪৮ সিরিয়ালে থাকা সত্ত্বেও তিনি ভর্তি হতে পারছেন না। অথচ অপেক্ষমাণ তালিকার ৪২০০ সিরিয়ালের শিক্ষার্থী টাকার বিনিময়ে ভর্তি হয়েছেন।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে রকিবুজ্জামান সোহেল সমকালকে বলেন, ভর্তিতে ছাত্রলীগের জন্য আলাদা আসন নেই। তার সাফ কথা, ছাত্রলীগ ভর্তিবাণিজ্য করছে না।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে কলেজের অধ্যক্ষ নুরুন নাহার বলেন, ক্যাম্পাসের বাইরে কারা ভর্তিবাণিজ্য করছে, তা তার জানা নেই। তবে তারা নিয়ম মেনেই শিক্ষার্থীদের ভর্তি করছেন।
সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ :সোহরাওয়ার্দী কলেজে প্রকাশ্যেই ভর্তিবাণিজ্য করতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী সারোয়ার হোসেন বাবু। সরেজমিনে দেখা যায়, কলেজ ছাত্র সংসদের কক্ষে বসে তিনি ভর্তিবাণিজ্য করছেন। তার পাশে থাকা ছাত্রলীগ সভাপতি কামরুজ্জামান ও সাধারণ সম্পাদক কাউছার হক ভর্তিচ্ছু অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছেন। পরে টাকার বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীর হাতে ভর্তি ফরম তুলে দিচ্ছেন। কলেজের এক কর্মকর্তা বলেন, মেধা তালিকায় পেছনে থাকা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ১৫ থেকে ৫০ হাজার টাকা নিচ্ছেন তারা। কর্তৃপক্ষ সবকিছু জানার পরও নীরব। কলেজের ভর্তি কমিটির কাছে পাওয়া যাচ্ছে না প্রকৃত তথ্য। ভর্তি কমিটির আহ্বায়ক নিতাই চন্দ্র সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ পর্যন্ত কতজন ভর্তি হয়েছে জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
কলেজ সূত্র থেকে জানা যায়, একাদশ শ্রেণীতে এ কলেজে এক হাজার ৬৫০টি আসন রয়েছে। এর মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগে ৩০০, ব্যবসায় শিক্ষায় ৮৫০ ও মানবিকে ৫০০ জন, যার সিংহ ভাগই খালি পড়ে আছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে কলেজ শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি কামরুজ্জামান বলেন, ভর্তির ব্যাপারে দুই-একজন অভিযোগ করতেই পারে। তবে কলেজে ভর্তিসংশ্লিষ্ট কাজে ছাত্রলীগ জড়িত নয়।
খুলনার ৩ কলেজে ছাত্রলীগের ভর্তিবাণিজ্য :খুলনা ব্যুরো থেকে হাসান হিমালয় জানান, খুলনার সরকারি সিটি কলেজ, আযম খান কমার্স কলেজ ও সুন্দরবন কলেজে একাদশ শ্রেণীর প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীকে নিয়মবহির্ভূতভাবে ভর্তি করেছে ছাত্রলীগ নেতারা। এসব ভর্তির ক্ষেত্রে মেধা তালিকা ও অপেক্ষমাণ তালিকা অনুসরণ করা হয়নি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেশিশক্তি প্রয়োগ এবং ভর্তিতে মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও অভিভাবকরা জানান, ছাত্রলীগ নেতাদের ভর্তিবাণিজ্য কলেজগুলোতে ওপেন সিক্রেট। ভর্তি কমিটি ও কলেজ প্রশাসন এ সম্পর্কে অবগত। নিয়মবহির্ভূতভাবে ভর্তির প্রতিবাদ করায় সিটি কলেজে তিনজন এবং সুন্দরবন কলেজে এক শিক্ষক মারধর ও লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন।
চট্টগ্রামে ১০ ছাত্রলীগ নেতার ভর্তিবাণিজ্য :চট্টগ্রাম ব্যুরো থেকে সালাহ উদ্দিন জানান, চট্টগ্রামের কলেজগুলোতে ভর্তিবাণিজ্যের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের ১০ নেতার বিরুদ্ধে জোরালো অভিযোগ উঠেছে। কম জিপিএ পেলেও ওই নেতাদের ‘চা-পানি’ খরচ দিলে ভর্তি হওয়া যায়। অবশ্য বিভাগ ও কলেজভেদে সে খরচ ওঠানামা করে। ওমর গনি এমইএস কলেজে ভর্তিবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি ওয়াসিম ও জিএস বাচ্চু। বাচ্চু মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক দফতর সম্পাদক। একই অবস্থা নগরীর সরকারি সিটি কলেজেও। এখানে ভর্তিবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন কলেজ সংসদের সাবেক ভিপি রাজন, আবুু সিদ্দিক জিহাদ ও মার্শাল। ইসলামিয়া কলেজে ভর্তিবাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দুটি গ্রুপ। একটির নেতৃত্বে রয়েছেন কলেজ সংসদের ভিপি ইউনুছ, জিএস রয়েল, সাবি্বর ও মহানগর ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক রনি মির্জা। অন্য গ্রুপে রয়েছেন সোহেল রানা ও বিকাশ। ছাত্র ভর্তিতে তারা নিয়ে থাকেন ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা।
বরিশালে হাতেম আলী কলেজের অধ্যক্ষ আত্মগোপনে :আমাদের বরিশাল ব্যুরো জানায়, বরিশাল সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজে একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি নিয়ে ঘটেছে তেলেসমাতি কাণ্ড। ‘একাদশ শ্রেণীতে আসন শূন্য নেই’_ এ রকম লেখা কাগজ কলেজের সর্বত্র লাগিয়ে রাখা হয় ভর্তির নির্ধারিত তারিখ শেষ হওয়ার তিন দিন আগ থেকেই। অথচ ওই তিন দিন ভর্তিচ্ছু শত শত শিক্ষার্থী ও অভিভাবক কলেজে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন; কিন্তু কেউ ভর্তি হতে পারেনি। কলেজ অধ্যক্ষ মো. অলিউল ইসলাম ২৭ জুন থেকে কলেজে যাননি। তার মোবাইল ফোনও ছিল বন্ধ। অভিযোগ আছে, ছাত্রলীগ নামধারী কতিপয় ছাত্রনেতার ভর্তিবাণিজ্যের কারণে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া শিক্ষার্থীরা ভর্তি হতে পারেননি। এ ভর্তিবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত অধ্যক্ষ এবং ভর্তি কমিটির কয়েকজন শিক্ষক।
রাজশাহীতে কলেজে হামলা-ভাংচুর :রাজশাহীর সরকারি কলেজগুলোতে ভর্তিবাণিজ্যে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগ। তাদের কথামতো ভর্তি কার্যক্রম না চালানোয় তারা একাধিক কলেজে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেছে। অভিযোগ রয়েছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২৫-৩০ হাজার টাকা নিয়ে তাদের ভর্তি করানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। রাজশাহী কলেজ, নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ ও রাজশাহী সিটি কলেজ ছাত্রলীগ ভর্তি প্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই হস্তক্ষেপ করে আসছে। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড থেকে ওই চারটি কলেজের জন্য আলাদা চারটি মেধা তালিকা সরবরাহ করা হয়। ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের পছন্দ অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের কলেজে ভর্তির জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয়। ২৮ জুন রাজশাহী সিটি কলেজ ও নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে হামলা চালায় ছাত্রলীগ কর্মীরা। ৬ জুলাই সিটি কলেজে আবারও হামলা চালায় ছাত্রলীগ কর্মীরা।