রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংঘর্ষের ঘটনার পর গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশ্যে ক্যাম্পাসে ৮ সাংবাদিককে মারধর করেছে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। সকাল ১১টার দিকে রাবি শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের সামনেই নেতাকর্মীরা পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের মারধর করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে রাবির সহকারী প্রক্টর মোসতাক হোসেনও এ সময় লাঞ্ছিত ও আহত হন। আহতদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আগেরদিন চট্টগ্রামে ২ জন এবং পাবনায় ১০ জন সাংবাদিক ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে প্রহৃত হয়েছেন। সব মিলিয়ে গত দু’দিনে দেশের বিভিন্নস্থানে ২০ জন সাংবাদিক প্রহৃত হয়েছেন বলে জানা গেছে। ছাত্রলীগের হাতে সাংবাদিক নিপীড়নের এই ঘটনাকে নতুন কোন ঘটনা নয় উল্লেখ করে দেশের বিজ্ঞজনেরা মনে করছেন অতীতেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সাংবাদিকদের উপরে নির্যাতনের স্টীমরোলার চলেছে। তবে বর্তমানে ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের আমলে অতীতের সেই একইরূপ সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র দেশেবাসীকে প্রকৃত অর্থেই উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। দেশব্যাপী সাংবাদিক নিপীড়নের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ মফস্বল মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরামের নেতৃবৃন্দ। গতকাল রাজশাহীতে ঢাকা থেকে আগত চ্যানেল আইয়ের ফটো সাংবাদিক মঈন হোসেন, মোস্তফা কামাল মল্লিক, প্রথম আলো রাজশাহীর ফটো সাংবাদিক আজহার, দৈনিক নিউ এইজ’র রাজশাহী প্রতিনিধি সৌমিত্র, দৈনিক জনকণ্ঠ রাবি প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম, দৈনিক যুগান্তরের রাবি প্রতিনিধি সায়েম সাবু ঘটনার ছবি তুলতে গেলে তাদের উপর ছাত্রলীগ ক্যাডার রকি, রুবেল, জুয়েল, মাসুদ, তাকিম, মুনির, তুহিনসহ আরো ২০/২৫ জন হামলা চালায়। ছাত্রলীগ কর্মীরা সাংবাদিকদের মারধরের ছবি তুলতে দেয়নি। ছবি উঠালে একজনকেও ক্যাম্পাস থেকে জীবিত ফিরতে দেয়া হবে না বলে হুমকি দেয়া হয়। আহত সাংবাদিকদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তবে এই ঘটনার পর রাবি শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি আওয়াল কবির জয় বলেন, এটা একটি বিশৃক্মখল ঘটনা। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর আগে গত বুধবার দুপুরে শিবির নেতা রয়েছে এমন অভিযোগে পাবনা প্রেসক্লাবে হামলা ও ভাংচুর এবং ১০ সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের নেতৃত্বে সরকারি এওয়ার্ড কলেজের দুশতাধিক ছাত্রলীগ ক্যাডার। এ সময় তারা প্রেসক্লাবের জেনারেটর, শতাধিক চেয়ার টেবিল, ওয়াটার ফিল্টার আলমারীসহ বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী তছনছ ও ভাংচুর করে। একই দিন দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের মিছিল চলাকালে সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ইত্তেফাকের চবি প্রতিনিধি সুজনের ওপর ছাত্রলীগ ক্যাডাররা হামলা চালায়। নিকট অতীতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে আওয়ামী শাসনামলে সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে লেখার অধিকার চরমভাবে ভূলণ্ঠিত হয়েছিল। অত্যাচার নির্যাতনের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের মদদে এবং তাদের হুমকিতে অনেক সাংবাদিককে সে সময়ে কর্মস্থল থেকেও উচ্ছেদ করার মতো ঘটনা ঘটেছিল। অনেককে তখন বলতে শোনা গিয়েছিল ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি যেন তার পিতার পদাঙ্কই অনুসরণ করেছেন। ১৯৭৪ সালে শেখ মজিবর রহমানও সরকারি চারটি পত্রিকা রেখে বাকি সব প্রত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকারকে গলাটিপে হত্যা করেছিলেন। সে সময়ে সরকারি মদদপুষ্ঠ চারটি পত্রিকা রেখে বাকি পত্রিকা বন্ধ করে দেয়ায় শত শত সাংবাদিক বেকার হয়ে যান। অনেকে চলে যান অন্য পেশায় আর বাকিরা ভাল কোন পেশায় ফিরতে পারেননি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ আমলে বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপারে খোদ যুক্তরাষ্ট্রও উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ২০০১ সালের ১৮ মে খোদ সরকারি পত্রিকা দৈনিক জনকন্ঠে বোরহান আহমেদের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল এরকম, ‘১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে বিপন্ন ছিল সাংবাদিকতা। বন্দুকের নলের মুখে ছিল সাংবাদিকদের জীবন আর আইনের শাসন’। শাসকগোষ্ঠীর এমপি মন্ত্রীদের হাতেও সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ছিল যেন নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। ২০০১ সালের ২৪ জুলাই দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যেখানে বলা হয়, বছরের প্রথমার্ধে ছয়মাসে দেশে ৭৪ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হন আর সরকারি গুন্ডা বাহিনীর হাতে নিহত হন ২ জন সাংবাদিক। ঐ একই পত্রিকায় ২০০০ সালের ৩১ অক্টোবর ‘সাংবাদিকরাই বড় টার্গেট’ শিরোনামে আরো একটি বড় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। মহাজোট সরকারের শরীক দলের এমপি রাশেদ খান মেনন নিজেই ২০০১ সালের ৮ মে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ‘আক্রান্ত সাংবাদিক ও সাংবাদিকতা’ শিরোনামে এক বিশাল প্রবন্ধ লিখে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সাংবাদিক নির্যাতনের বিশদ বর্ণনা দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ আমলের তৎকালীন সমাজকল্যান মন্ত্রী ডা. মোজাম্মেল হোসেন সাংবাদিকদের পিটিয়ে হাড় গুড়ো করে দেয়ার হুকুম দিয়ে সমালোচনার শীর্ষে চলে আসেন। তার হুকুমের ৩৬ ঘণ্টার মধ্যে সাতক্ষীরা চিত্র’র সম্পাদক আনিসুর রহমানকে প্রহার করা হয়। ত্রাণ বিতরণে অনিয়মের সংবাদ ছাপার অপরাধেই(!) তাকে পিটিয়ে আহত করা হয়। ফেনীতে জয়নাল হাজারী নিজের হাতে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে সাংবাদিক টিপুকে। ফেনীর ছাত্রলীগ নেতা কহিনুরসহ জন ছাত্রলীগ ক্যাডাররা সেখানকার বিভিন্ন পত্রিকার সাংবাদিকদের সব সময়েই রাখতের হুমকির মুখে। ২০০০ সালের ১৬ জানুয়ারি দৈনিক মানব জমিন পত্রিকায় তাদের মিডিয়া ওয়াচে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের মিডিয়া জগতের রিপোর্টার এবং ফটো সাংবাদিকদের জন্য ২০০০ সালটি ছিল খুবই বেদনাদায়ক। দেশ স্বাধীন হওয়ার ৩০ বছরের মধ্যে আওয়ামী শাসনামলের এই বছরটিতেই সম্ভবত স্বাধীন সাংবাদিকতার উপর বেশি আঘাত এসেছে। সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করায় যশোরে সাংবাদিকদের মধ্যে কাফনের কাপড় বিলি করে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। ২০০১ সালে ২৩ মে দৈনিক সংগ্রামে আলোড়ন সৃষ্টিকারী একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। রিপোর্টে বলা হয়, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পাঁচ বছরে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নজীরবিহীনভাবে সাংবাদিকদের নির্যাতন করা হয়। এই অঞ্চলেই সাংবাদিক নিহত হয় সাত জন। লক্ষীপুর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন সাংবাদিকদের হাত-পা কাটা হবে। সে সময়ের পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাকের উপস্থিতিতেই তিনি এই ঘোষণা দেন। হাজারী বাহিনীর দাপটে মানবজমিন পত্রিকার দাগনভূইয়া সংবাদদাতা শহিদুল আলম ইমরান হাসপাতালেও চিকিৎসা নিতে পারেননি। আর তাদের স্টাফ রিপোর্টার শেখ মামুনুর রশীদ সরকারি গুন্ডাদের অত্যাচারে শুধু লক্ষীপুর নয় তাকে নোয়াখালীও ছাড়তে বাধ্য হতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালের ৩১ জুন নিজেই ঘোষণা দিয়েছিলেন যে সব সাংবাদিক সতর্কভাবে সংবাদ না ছাপে বা অসত্য সংবাদ পরিবেশন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিতে হবে। দেশের প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় তার এই নির্দেশ দেয়া নিয়ে তখন সারাদেশেই সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। আওয়ামী লীগ আমলে পুলিশ পশাসনের কাছে নিরাপদ ছিল না দেশের সাংবাদিক সমাজ। দৈনিক ভোরের কাগজের স্টাফ ফটোগ্রাফার মাসুদ পারভেজ আনিস বিজয় নগর এলাকায় পুলিশের গুলীতে গুরুতর আহত হন। ১৯৯৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঐ একই দিনে যাত্রাবাড়ি এলাকা থেকে তিন ফটো সাংবাদিককে মারধর করে ক্যামেরা কেঁড়ে নেয় পুলিশ। পরে অবশ্য তাদের ক্যামেরা ফেরত দেয়া হয়। ২০০১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি দৈনিক দিনকালে প্রকাশিত হয় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাহীনতায় আছে সাংবাদিক সমাজ। ১৯৯৯ সালের ১৪ আগস্ট প্রথম আলো পত্রিকায় বিশিষ্ট সাংবাদিক এবিএম মূসা লিখেন আওয়ামী লীগের আমলেই আজ আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে দেশের সাংবাদিক সমাজ।