সড়কে ইটের টুকরা, কাঠ, বাঁশের ছড়াছড়ি। জায়গায় জায়গায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী। কাঁদানে গ্যাসের শেলের খালি কৌটাগুলোও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। কার্জন হল থেকে ঝাঁজালো ওই শেলের গন্ধ ছড়াচ্ছিল পুরো ক্যাম্পাসে। যেন পরিত্যক্ত যুদ্ধক্ষেত্র। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রোববার রাত থেকে শুরু হওয়া সহিংস ঘটনার পর গতকাল সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভোরের পরিবেশটা ছিল এ রকমই।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত রোববার বিকেল থেকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন হাজারো শিক্ষার্থী। পুলিশের মার খেয়ে রাত আটটা থেকে শাহবাগ ছেড়ে ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন তাঁরা। আবাসিক হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও রাতে হল থেকে বেরিয়ে আসেন অসংখ্য ছাত্রী। তাঁরাও যোগ দেন বিক্ষোভে। রাত দেড়টার দিকে শাহবাগ এলাকা থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা সরে যেতে শুরু করেন। তাঁরা মল চত্বর এলাকায় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে জড়ো হন। এ সময়ই নীলক্ষেতের দিক থেকে ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও কুয়েত মৈত্রী হলের ছাত্রীরা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকলে আন্দোলন অন্য মাত্রা পায়। কয়েক হাজার শিক্ষার্থীর অনিয়ন্ত্রিত জমায়েত তৈরি হয়। সেখানে তখন পুলিশ ছিল না। সংবাদ সংগ্রহে গেলে তাঁরা কয়েকজন সংবাদকর্মীর ওপরও চড়াও হন। তখনই ভিসির বাসভবনে হামলা ও ব্যাপক ভাঙচুর হয়।
রাত ২.৩০: ছাত্রলীগের ধাওয়া-গুলি
রাত আড়াইটার দিকে নীলক্ষেতের দিক থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগের কয়েক শ নেতা-কর্মী লাঠিসোঁটা ও রড নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকেন। তাঁদের অধিকাংশই ঢাকা কলেজসহ মহানগর ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত বলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা পরে জানান। তাঁরা ঢুকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে জড়ো হওয়া আন্দোলনকারীদের মারধর করেন, ধাওয়া দেন। ছাত্রলীগের মিছিল থেকে এ সময় গুলিও ছোড়া হয় বলে অন্তত পাঁচজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন। একই সময় পুলিশও ক্যাম্পাসের ভেতরে আন্দোলনকারীদের ওপর কাঁদানে গ্যাসের শেল, রাবার বুলেট ছোড়া শুরু করে। পুলিশ ও ছাত্রলীগের যুগপৎ হামলায় ছত্রভঙ্গ হয়ে ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়েন আন্দোলনকারীরা। ছাত্রীদের একটা বড় অংশ টিএসসিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়।
ভোর ৪টা: ছাত্রলীগ-আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অবস্থান
ভোর পৌনে চারটার দিকে প্রায় ৬০টি গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকে র্যাব। তার আগেই অবশ্য পুলিশ ও ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। উপাচার্যের বাসভবনের বাইরে পুলিশ ও র্যাবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি লাঠিসোঁটা, রড, পাইপ নিয়ে অবস্থান করছিলেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীরা।
উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে তখন জাহাঙ্গীর কবির নানক, কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন। বাসভবনটি ততক্ষণে গিজগিজ করছে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের ভিড়ে। জাহাঙ্গীর কবিরের সঙ্গেই এসেছিলেন মোহাম্মদপুর, আদাবর, শ্যামলী এলাকার কয়েক শ ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মী। এ ছাড়া ঢাকা কলেজ, তেজগাঁও কলেজের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদেরও সেখানে পাওয়া যায়।
ভোর সাড়ে ৪টা: ভিসির বাসভবনের ভেতরে যা চলছিল
ভিসির বাসভবনের বাগানে তখন আলোচনা করছিলেন জাহাঙ্গীর কবির, আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, শিক্ষক সমিতির নেতা মাকসুদ কামাল, কবি আবদুস সামাদসহ অন্যরা এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। এ সময় উপাচার্যের বাসভবন থেকে হামলাকারীদের বিতাড়িত করার জন্য ছাত্রলীগের প্রশংসা করেন তাঁরা। ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গভীর রাতে হল থেকে ছাত্রীদের বের হতে দেওয়ার জন্য ছাত্রী হলগুলোর প্রভোস্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান। জাহাঙ্গীর কবির নানক সোমবার দিনের বেলায় যেভাবে হোক, ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য বলেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের।
ভোর ৬টা: আবারও গুলি
ভোর ছয়টার দিকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নেতৃত্বে উপাচার্যের বাসভবন থেকে একটি মিছিল বের হয়ে টিএসসি হয়ে কার্জন হলের দিকে যায়। মিছিলকারীদের হাতে লাঠিসোঁটা ছিল। সেই মিছিলটি কার্জন হল এলাকায় আন্দোলনকারীদের ওপর চড়াও হতে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত তাঁরাই আন্দোলনকারীদের ধাওয়া খেয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারাসহ পিছু হটেন। ওই মিছিলে থাকা নেতা-কর্মীরা শহীদুল্লাহ্ হলের ক্যানটিনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের উপসম্পাদক খাদেমুল বাশারকে বেধড়ক মারধর করেন। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে রক্তাক্ত অবস্থায় খাদেমুলকে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
সকাল পৌনে ৭টা: রাস্তায় হলের ছাত্ররা
কার্জন হল এলাকা থেকে ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের হটাতে ব্যর্থ হওয়ার পর সেখানে সাঁজোয়া যান নিয়ে চড়াও হয় পুলিশ। কার্জন হলের পেছন দিকটা থেকে শুরু করে শহীদুল্লাহ্ হলের দিকে শতাধিক কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়া হয়।
ছাত্রলীগের হামলা ও পুলিশের এলোপাতাড়ি কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপের প্রতিবাদে সকাল পৌনে সাতটার দিকে শহীদুল্লাহ্ হলের কয়েক শ ছাত্র দোয়েল চত্বর এলাকার রাস্তায় নেমে আসেন। এ সময় মহানগর পুলিশ কমিশনার, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল দলের সদস্যরা সেখানে গিয়ে ছাত্রদের শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ঘণ্টাখানেক সেখানে থাকার পর পুলিশ ছাত্রদের হটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর ছাত্ররা আবার ক্যাম্পাসে আসেন।
কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জমায়েত, মুক্তি দাবি
সকাল ১০টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন হল থেকে আসা ছাত্ররা। বেলা ১১টার দিকে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ আগের রাতে উপাচার্যের বাসভবনে হামলা ও আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নেয়। এ সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা মোটরসাইকেল নিয়ে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাঁদের ‘ধর’ ‘ধর’ বলে তাড়া দেন।
সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রাশেদ খান ও নুরুল্লা নুরু। তাঁরা দুপুরের মধ্যে গ্রেপ্তার ছাত্রদের মুক্তি দাবি করেন। সেখান থেকে তাঁরা মিছিল নিয়ে বের হন। ছাত্রদের কারও পরনে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো দেওয়া টি-শার্ট, কেউ পাঞ্জাবি পরেছিলেন, কারও টি-শার্টে চে গুয়েভারার ছবি, কারও মাথায় ছিল টুপি। ছাত্রীদেরও বেশভূষায় বৈচিত্র্য ছিল। তবে স্লোগান অভিন্ন, ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’। মিছিল যখন ক্যাম্পাস ঘুরছিল, তখন প্রতিটি মোড়েই ছিল উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পুলিশ। তবে রাতে পুলিশ যতটা মারমুখী ছিল, দিনভর তাদের তেমন তৎপরতা চোখে পড়েনি। বেলা একটার দিকে রাজু ভাস্কর্যে যখন শিক্ষার্থীরা জমায়েত হন, তখন কাছেই টিএসসিতে দাঁড়িয়ে ছিল অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ ও সাঁজোয়া যান।
পুলিশের হামলার প্রতিবাদে বেলা ১১টার দিকে সায়েন্স অ্যানেক্স ভবনের সামনে মানবন্ধন করেন ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগসহ কয়েকটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কোনো ক্লাস হয়নি।
ধাওয়া, আগুন
একপর্যায়ে বেলা ১টা ৫০ মিনিটে উত্তেজিত শিক্ষার্থীরা পুলিশকে ধাওয়া দেন। পুলিশ প্রথমে টিএসসি ও পরে বাংলা একাডেমির কাছে গিয়ে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে পুলিশ ছাত্রদের উদ্দেশে কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে শুরু করে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা পুলিশ ও বহিরাগতদের ঠেকাতে বাঁশ ফেলে রাস্তায় ব্যারিকেড দেন। কাঁদানে গ্যাসের শেল থেকে বাঁচতে মোড়ে মোড়ে আগুন জ্বালান তাঁরা। তবে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত চারুকলা থেকে দোয়েল চত্বর এবং নীলক্ষেত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে পুলিশ ও বহিরাগতরা ঢুকতে পারেনি। বেলা তিনটার দিকে ছাত্রপ্রতিনিধিরা সচিবালয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে দেখা করতে যান।
আন্দোলন আজ পর্যন্ত স্থগিত
সচিবালয় থেকে ছাত্রপ্রতিনিধিরা ফিরে সন্ধ্যা সাতটার দিকে রাজু ভাস্কর্যে আসেন। সেখানে জড়ো হয়ে থাকা আন্দোলনকারীদেরকে আগামী ৭ মে পর্যন্ত আন্দোলন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্তের কথা জানান। তখন সমবেত আন্দোলনকারীদের অধিকাংশই এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল ও বাংলা একাডেমি এলাকায় অবস্থান নিয়ে তাঁরা স্লোগান দিতে থাকেন। রাত সাড়ে নয়টার দিকে আন্দোলনকারীদের মুখপাত্র দাবি করে বিপাশা চৌধুরী নামের এক শিক্ষার্থী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেন, ‘আশপাশে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ঘোরাঘুরি করছেন। নিরাপদ মনে না করে আজকের মতো আন্দোলন স্থগিত করা হলো।