জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যা মামলায় পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তবে অভিযোগ প্রমাণ না হওয়ায় দুই আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে। ঢাকার চার নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক
(জেলা ও দায়রা জজ) এবিএম নিজামুল হক গতকাল রোববার দুপুরে জনাকীর্ণ এজলাসে সাত আসামির উপস্থিতিতে এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়েছে। দ িত সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মী এবং জাবির বিভিন্ন বিভাগের ছাত্র। এ হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সে সময় তাদের আজীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করেছিল। তিন বছর আগে প্রতিপক্ষের হামলায় নিহত জুবায়েরও ছাত্রলীগ করতেন। এই প্রথম দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হত্যার বিচার হলো।
মৃত্যুদ প্রাপ্তরা হলো_ প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আশিকুল ইসলাম আশিক, খান মোহাম্মদ রইছ ও জাহিদ হাসান, দর্শন বিভাগের রাশেদুল ইসলাম রাজু এবং সরকার ও রাজনীতি বিভাগের মাহবুব আকরাম। তারা সবাই পলাতক।
যাবজ্জীবনপ্রাপ্তরা হলো_ দর্শন বিভাগের ইশতিয়াক মেহবুব অরূপ ও কামরুজ্জামান সোহাগ, ইতিহাস বিভাগের মাজহারুল ইসলাম, পরিসংখ্যান বিভাগের শফিউল আলম সেতু ও অভিনন্দন কু ওরফে অভি এবং অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র নাজমুস সাকিব তপু। দণ্ডিত প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়েছে। এদের মধ্যে প্রথমজন পলাতক। বাকিরা কারাগারে। বেকসুর খালাসপ্রাপ্তরা হলো_ বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের ছাত্র নাজমুল হাসান প্লাবন ও ইতিহাসের মাহমুদুল হাসান। মোট ১৩ আসামির মধ্যে সাতজন কারাগারে আটক আছে। জুবায়েরের বড় ভাই আবদুল্লাহ আল মামুন রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘এই রায়ে সন্তুষ্ট হবো তখনই, যখন এ রায় কার্যকর হবে। আমি চাই আসামিরা যাতে আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে না যায়।’ আসামিপক্ষ অসন্তোষ প্রকাশ করে রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে যাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। রায়কে স্বাগত জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল করেছেন শিক্ষার্থীরা। তারা রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি জানান।
রায়ে দ িতদের মধ্যে আশিক, রইছ, আকরাম ও অরূপ গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি শুনানি চলাকালে কাঠগড়া থেকে পালিয়ে যায়। জামিন নিতে আসা এই আসামিরা শুনানির সময় ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির থাকলেও জামিন বাতিলের আদেশ ঘোষণার পর তারা পালিয়ে যায়। এর পর তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হলেও গত এক বছরে তাদের গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। ৬ আসামির অনুপস্থিতিতেই রায় ঘোষণা করা হলো। রায় ঘোষণার আগে গতকাল সকালে আসামিদের মধ্যে কারাবন্দি সোহাগ, মাজহারুল, সেতু, অভি, তপু, প্লাবন ও মাহমুদুলকে আদালতে হাজির করা হয়।
জুবায়েরের বাড়ি পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার মদিনাবাগ নাবলাপাড়া গ্রামে। তার পিতা তোফায়েল আহমেদ ও মাতা হাসিনা আহমেদ সেখানেই অবস্থান করছেন।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার কথা থাকলেও অবরোধের মধ্যে আসামিদের কারাগার থেকে আনতে না পারায় তা পিছিয়ে যায়। গতকাল হরতাল উপেক্ষা করে আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়। তিন বছরের বেশি সময় বিচার চলার পর গত ২৮ জানুয়ারি বিচারক নিজামুল হক এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করেছিলেন। ওই দিনই সাত আসামির জামিন বাতিল করে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, যাদের দু’জন খালাস পেয়েছেন।
পর্যবেক্ষণ : আলোচিত জুবায়ের হত্যাকা ে বাংলাদেশে বর্তমান রাজনীতির আদর্শহীন চেহারা ফুটে উঠেছে বলে আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। রায়ে বলা হয়, এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনার গভীরে ঢুকে বর্তমান রাজনীতির চরম বিশৃঙ্খলা, নীতিহীন ও আদর্শচ্যুত চেহারাই উন্মোচিত করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী কর্তৃপক্ষ সিন্ডিকেটও এসব প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়। কারণ প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক প্রভাব বিদ্যমান রয়েছে।
বিচারক রায়ে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে উলি্লখিত অনৈতিক কর্মকা ের শেষ পরিণতি হচ্ছে জুবায়ের হত্যাকাণ্ড। অনুরূপ অহেতুক হত্যাকা মানবতা ও নৈতিকতাকে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করে। এতে ভুক্তভোগীর পরিবারের ওপর নেমে আসে শোকের ছায়া। এমনকি পারিবারিক, সামাজিক ও আর্থিক নানারকম সমস্যাও এসব পরিবারকে গ্রাস করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পেশিশক্তির জোরে কোনো ধরনের সহিংসতা, নৃশংসতা, অশান্তি সৃষ্টি, নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, হানাহানি, উগ্রতা ও বর্বরতা শিক্ষার অনুকূল পরিবেশের ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, যা কারও কাম্য হতে পারে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত কোনো হত্যাকা বা সন্ত্রাসী কর্মকা ের বিচার সাম্প্রতিক অতীতে না হওয়াটাও পরবর্তী সময়ে একই ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত করছে বলে আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়।
রায়ে আরও বলা হয়েছে, এ রকম হত্যাকা ে ছাত্র রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়, যা স্বাভাবিক কারণেই ছাত্র রাজনীতিকে করে কলঙ্কিত। কোনো ধরনের হত্যা বা সন্ত্রাস প্রতিহত করার লক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ যেন যুগোপযোগী আচরণবিধি তৈরি করে, সে প্রত্যাশা করেছেন আদালত। বিচারাধীন বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের আরও সচেতনতার ওপরও তাগিদ দেওয়া হয়।
গণমাধ্যমকর্মীদের বিভিন্ন প্রশংসনীয় ভূমিকার উল্লেখ করে বিচারক বলেন, তাদের তৎপরতা কোনো কোনো সময় সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করে, যা বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কাও তৈরি করে। বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করে বিচার-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করে সংবাদ পরিবেশন বাঞ্ছনীয়।
রায় কার্যকরের দাবি : জাবি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জুবায়ের হত্যা মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল রোববার রায়কে সাধুবাদ জানিয়ে আনন্দ র্যালি করেছেন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’ ব্যানারে সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, এই রায়ে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাই খুুশি হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আমরা যে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলাম তার সঙ্গে এ রায়ের মিল আছে। তৎকালীন উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির বলেন, জুবায়ের হত্যাকাণ্ডের সময় যে প্রশাসন ছিল তাদের আস্থা এবং সাক্ষ্য প্রদানের ভিত্তিতে এ রায় দিয়েছেন আদালত। বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি মাহমুদুর রহমান রায়কে সাধুবাদ জানিয়ে দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানান।
প্রেক্ষাপট : ২০১২ সালের ৮ জানুয়ারি অনার্স শেষ বর্ষের শেষ পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর ছাত্রলীগের কয়েক কর্মী জুবায়েরকে ডেকে নিয়ে রড দিয়ে পিটিয়ে জখম করে। এর পর তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ওই দিন রাতেই রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরদিন ভোরে মারা যান জুবায়ের। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হামিদুর রহমান বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় ১৩ জনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মীর শাহীন শাহ পারভেজ ২০১২ সালের ৩ এপ্রিল ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেন। ২০১৩ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-৪। রায় ঘোষণার আগে চার্জশিটভুক্ত ৩৭ সাক্ষীর মধ্যে ২৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
জুবায়ের জাবির বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবাসিক হলের ছাত্র ছিলেন। তিনি জাবির ৩৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। জুবায়ের নিহত হওয়ার পর ছাত্র-শিক্ষকদের আন্দোলনের এক পর্যায়ে পদত্যাগে বাধ্য হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সময়কার উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির।