মিজানুর রহমান খান
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কি একটি গাইডলাইন হতে পারে? নিজেকে বাঁচাতে যে হত্যাকাণ্ড তা-ও কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। তবে আইনের চোখে এর একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। এর বাইরে এমন কিছু থাকার প্রশ্নই আসতে পারে না। কারণ, সংবিধান বলেছে, আইনের আশ্রয় ব্যতীত কারও জীবন নেওয়া যাবে না। এমনকি কাউকে অপমান পর্যন্ত করা বারণ। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিও দেশের বর্তমান বাস্তবতায় বন্দুকযুদ্ধে আইনের শাসন ও গণতন্ত্র দুটোই অবলোকন করছেন! তাহলে এই যুক্তি খুবই স্বাভাবিক যে বাস্তবতা যদি সংবিধান মান্য করতে না-ই দেয়, তাহলে আমরা কেন সেই সংবিধানে উপযুক্ত সংশোধনী আনব না! সংবিধান শোধরাব না, কিন্তু সেটা ‘জাতির উন্নয়নের’ স্বার্থে পদ্ধতিগতভাবে লঙ্ঘন করব, সেটা তো আরও বেশি ভয়ানক কথা।
আদালতের তরফে বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ন্ত্রণে একটি গাইডলাইন পাওয়ার আশায় কলম ধরেছি। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও লোকসভা নয়, এ বিষয়ে আদালত এগিয়ে এসেছেন। ওসব দেশে আদালতের হস্তক্ষেপ সত্ত্বেও এটা চলছে ঠিক, কিন্তু তাই বলে আমাদের এমন কিছুই থাকবে না, তা নিশ্চয় যুক্তি নয়। আমরা মনে করি এই শূন্যতা পূরণ করার সময় এসেছে। ভারতীয় আদালত ১৯৯৭-এ শুরু করে ১৭ বছর পরে এসে একটি গাইডলাইন দিয়েছেন। ১৯৯৭ সালে অন্ধ্র প্রদেশ হাইকোর্ট বলেছিলেন, ‘পুলিশ আত্মরক্ষার যে যুক্তি, সেটা তারা হত্যাকাণ্ডের বিচারকালে আদালতকে বলবে।’ ভারতের মতো এ দেশেও প্রতিটি এমন মৃত্যু একটি করে এফআইআর ও তদন্ত রিপোর্টের জন্ম দিলেও এ হত্যার ঘটনা কখনো আদালতের চৌকাঠ পেরোয় না। ২০১১ সালে ওম প্রকাশের মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বললেন, এটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের সমতুল্য।
২০১৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পিপল ইউনিয়ন ফর সিভিল লিবার্টিজ বনাম মহারাষ্ট্র মামলাটি এ বিষয়ে ভারতের প্রথম মাইলফলক মামলা, যেখানে সুপ্রিম কোর্ট ১৬ দফা গাইডলাইন বেঁধে দেন। নাগরিক সমাজ মুম্বাই পুলিশের ৯৯টি বন্দুকযুদ্ধের বৈধতার প্রশ্ন আদালতের সামনে নিয়েছিলেন। আদালত অনুশোচনা করেছিলেন যে ‘ভারতে দুর্ভাগ্যবশত এ বিষয়ে কোনো কাঠামোগত গাইডলাইন বা প্রক্রিয়া নেই। যে সমাজে আইনের শাসন আছে, সেখানে এটা অবশ্য কর্তব্য যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যথাযথ ও স্বাধীনভাবে তদন্ত হতে হবে, যাতে ন্যায়বিচার হতে পারে। এটা এই আদালতের “সাংবিধানিক কর্তব্য” কতিপয় গাইডলাইন বেঁধে দেওয়া, যাতে যেসব অপরাধ সংঘটনকারী, যারা নিজের হাতে আইন তুলে নেয়, তাদের বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়। সুতরাং পুলিশের বন্দুকযুদ্ধে সব ধরনের মৃত্যু ও গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় এই আদালত দ্বারা প্রণীত গাইডলাইন অবশ্যই কঠোরভাবে অনুসৃত হতে হবে।’ আদালত গাইডলাইন করে দিলেই বন্দুকযুদ্ধ কমবে কি কমবে না, সেটা পরের প্রশ্ন। বড় প্রশ্ন হলো, আমাদের দেশে এ ক্ষেত্রে একটা শূন্যতা চলছে। আর তা পূরণ হওয়া দরকার।
২০১৩ সালে মহারাষ্ট্রে ‘উগ্রপন্থী ও সন্ত্রাসী’সহ অন্যান্য ঘটনায় পুলিশের গুলিতে ১০৩ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়। পুলিশ নিহত হয় ৪৭ জন। আহত হয় ১ হাজার ১৫৮ জন। সুখের বিষয়, আমাদের পুলিশ নিহত হওয়ার সংখ্যা খুবই কম, তবে বন্দুকযুদ্ধকে গ্রহণযোগ্যতা দিতে এজাহারে যে বিবরণ আসে, তাতে আহত হওয়ার বিবরণ বিরল নয়। একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কাগজপত্রে পুলিশের আহত হওয়ার পরিসংখ্যান, ডাক্তারি সনদ সবই পাবেন! না হলে তো এজাহার দাঁড়াবে না! ভারতের ওই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আসামের দুটি বন্দুকযুদ্ধ ‘সাজানো’ বলে উল্লেখ দেখতে পাই। আদালত বলেন, এই ‘সাজানো এনকাউন্টারের’ সংখ্যা যে এতটাই কম, যা সন্দেহের উদ্রেক করে। ভারতে আদালতের কাছে যখনই সাজানো বন্দুকযুদ্ধের ফরিয়াদ নেওয়া হয়েছে, তখন তাঁরা স্বাধীন তদন্ত নিশ্চিত করেন। গুজরাটের ২১টি সাজানো বন্দুকযুদ্ধ মামলার শুনানিকালেই গুজরাট সরকার একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি মনিটরিং কমিটি করে, আর আদালত এই কমিটিকেই সত্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব দেন। সুপ্রিম কোর্ট যাকে সাজানো বন্দুকযুদ্ধ বলেছেন, সেখানেও তাঁরা স্বাধীন তদন্তের ব্যবস্থা করেছেন।
আগের এক লেখায় তনুর ময়নাতদন্ত যাতে ১৮৭২ সালের করোনার্স আইনে হয়, সেই আহ্বান জানিয়েছিলাম। সুপ্রিম কোর্টের এই রায় থেকে দেখছি যে সাজানো বন্দুকযুদ্ধের তদন্তে এই করোনার্স আইনের প্রয়োগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। আমাদের প্রধান বিচারপতি ময়নাতদন্তের অকার্যকরতা চিহ্নিত করেছেন। আর এই মামলায় ভারতের প্রধান বিচারপতি লোধা ইউ ডি এইচ আর স্মরণ করিয়ে বলেছেন, এ রকম ঘটনায় ময়নাতদন্তকালে নিহত ব্যক্তির স্বজনকে রাখতে হবে। এখানে বন্দুকযুদ্ধবিষয়ক তদন্তে মিনেসোটা প্রটোকলের শর্তাবলি মানার কথাও বলেছেন প্রধান বিচারপতি। এই প্রটোকলে প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার তদন্তে ১০টি শর্ত পূরণের কথা বলা আছে। এটা মানা হলে মানুষ জানত, তরুণ ফাহিম যে অস্ত্রের গুলিতে নিহত হয়েছেন তার হাতলে কার আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে। পুলিশের কেউ হতাহত হলেও অপরাধীর অস্ত্র ও আঙুলের ছাপ শনাক্ত হবে। দৃশ্যপটে উপস্থিত প্রত্যেকের নামধামের রেকর্ড রক্ষা করতে হবে। সরেজমিনে যে তদন্ত দল যাবে, তারা রিপোর্ট দেবে এবং তা প্রকাশ করতে হবে।
মানবাধিকার কমিশনের বিদায়ী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান তাঁর ছয় বছরে ২৫টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে চিঠির পর চিঠি লিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাননি। আর ভারতের ওই গাইডলাইন বলছে প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যার তথ্য দ্রুত কমিশনকে জানাতে হবে। আর কোনো সন্দেহভাজন মানে সাজানো বন্দুকযুদ্ধের অভিযোগ উঠলে তার তদন্তে কমিশনকে রাখতেই হবে। এটা বাধ্যতামূলক। আর ২০০৯ সালের বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন আইনে কমিশন দ্বারা বিচার বিভাগীয় তদন্ত নিষিদ্ধ করে রাখা হয়েছে। প্রতিবছর দুবার—জানুয়ারি ও জুলাইয়ের ১৫ তারিখের মধ্যে কমিশনকে এমন সব হত্যাকাণ্ডের তালিকা দিতে হবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ জন্য সাতটি তথ্যসংবলিত একটি ফরমও তৈরি করে দিয়েছেন। কোনো পুলিশের বিরুদ্ধে তদন্ত চললে তাকে বরখাস্ত করে তা করতে হবে। নিহত ব্যক্তির পরিবারকে সিআরপিসির ৩৫৭ক ধারায় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
যেসব জ্ঞানী-গুণী এখন এই হত্যা সমর্থন করছেন, তাঁদের কাছে বিশেষ অনুরোধ—তাঁরা যেন আইন সংশোধন করে আমাদের সিআরপিসিতেও এ রকম একটি নতুন ধারা যুক্ত করার পক্ষে সরকারকে উৎসাহিত করেন। তাঁরা যেন বলেন, বন্দুকযুদ্ধ চালান, কিন্তু ওই গাইডলাইনের ১৫ দফাটা মান্য করেন, যেখানে বলা আছে কোনো বন্দুকযুদ্ধের পরপরই যাতে কোনো পুলিশ অফিসারকে পদোন্নতি না দেওয়া হয়। যে ধরনের পদোন্নতি ইদানীং আমরা বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে অসহায়ভাবে প্রত্যক্ষ করি। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, তার ১৬ দফার লঙ্ঘন ঘটলে নাগরিকেরা দেশের যেকোনো দায়রা আদালতে মামলা করতে পারবেন।
সাবেক আইনমন্ত্রী এবং ভারতীয় সর্বোচ্চ আদালতকে কলুষমুক্ত রাখতে জেহাদরত প্রশান্ত ভূষণ এই মামলার শুনানিকালে যে যুক্তি দেন, সেটা হুবহু গ্রহণ করার সুপারিশ রাখছি। তিনি বলেছেন, প্রতিটি বন্দুকযুদ্ধের পরে যে তদন্ত হবে তা একটি স্থায়ী তদন্ত কমিটি করবে। সেটা না হলে পুলিশের একটি আলাদা ক্যাডার সদস্যরা তদন্ত করবেন। আর এই কমিটি মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের ১৬ দফা নির্দেশনার মধ্যে আরও যেসব বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার স্বাধীন তদন্ত অন্যতম। আমাদের বাস্তবতায় তদন্তটা অন্তত একই থানার পুলিশ কর্মকর্তারা করবেন না, সেটা নিশ্চিত করা চলে। অন্তত দুজন চিকিৎসক ময়নাতদন্ত করবেন ও তার ভিডিওগ্রাফি সংরক্ষণ করবেন। মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটন করতেই হবে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের ওই রায়ে আছে, সিআরপিসির ১৭৬ ধারায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করার পরে ১৯০ ধারার আওতায় একজন বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সে রিপোর্ট পাঠাবেন। তাহলে আমরা দেখি সুপ্রিম কোর্টের একটি বিরাট ভূমিকা প্রচলিত আইনে ইতিমধ্যে স্বীকৃত। অথচ আমাকে অবহিত করা হয়েছে যে বাংলাদেশের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এটা তামিল করছেন না। জানা গেছে, বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা বন্দুকযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের সাক্ষ্য নিয়েই তদন্ত রিপোর্ট লেখেন। আর তার অনুলিপি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ডিসিকে দেন, ডিসি সেটা পরে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে পাঠান। তার মানে, বাস্তবতা হলো বিচার বিভাগকে বাদ দিয়েই সব হচ্ছে এবং পুরো বিষয়টিও থাকছে বিচারবহির্ভূত।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে বিচারিক হাকিমের কাছে রিপোর্ট দেওয়ার মানেই হলো এটা আশা করা যে বিচার বিভাগ নীরবতা পালন করবেন না, আর দশটা অপরাধের মতোই তাঁরা তা আমলে নেবেন। কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন। সে জন্য তিনি তাঁর বিচারিক মন প্রয়োগ করবেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ রকম কোনো নজির সৃষ্টি হয়নি বলেই জানি। স্বপ্রণোদিতভাবে বিষয়টি আমলে নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট একটি উপযুক্ত প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নিতে পারেন কি?