রাজধানীসহ দেশে বেড়েছে বীভৎস, বিকৃত, রোমহর্ষক খুনের ঘটনা। আপনজনরাও ঘটাচ্ছে অবিশ্বাস্য খুন-খারাবি। মা খুন করছে সন্তানকে, স্ত্রী খুন করছে স্বামীকে, স্বামী পুড়িয়ে মারছে স্ত্রীকে, ভাই খুন করছে ভাইকে। খুনের পর লাশ রাখা হচ্ছে শয়নকক্ষে, রাস্তায়, বালুর ভেতর, বস্তার ভেতর, কাদার ভেতর, পানির ট্যাংকে, ড্রেনে কিংবা ডাস্টবিনে। প্রায়ই এ ধরনের খুনের ঘটনা ঘটছে। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দ্বন্দ্বই অধিকাংশ খুনের ঘটনার কারণ। পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৬ হাজার ৯৭৪টি। একই সময়ে রাজধানীতে খুন হয়েছে ১ হাজার ১২ জন। এর মধ্যে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডই বীভৎস ও রোমহর্ষক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম যুগান্তরকে বলেন, যার মনে ক্ষোভ যত বেশি, তার দ্বারা হত্যাকাণ্ডে নৃশংসতা তত বেশি হয়। তিনি বলেন, মানুষের চাহিদা, আকাক্সক্ষা বেড়ে গেছে। তাছাড়া আইন থাকলেও এর সঠিক প্রয়োগ না থাকায় এমন খুনের ঘটনা বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, বীভৎস হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়া সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি। তার মতে, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা, নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে বীভৎসতা বাড়ছে। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনি কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ জোরালো করতে হবে। তিনি বলেন, প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে মানসিক ও আর্থিক স্বার্থ রয়েছে।
পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সহেলী ফেরদৌস যুগান্তরকে বলেন, নৃশংস খুনের ঘটনা বাড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ থাকতে পারে। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়া, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, ইন্টারনেটের অপব্যবহার অন্যতম হতে পারে। তিনি বলেন, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হলে একটা মানুষ খারাপ কাজ করতে একটু ভাবে। তারা খারাপ কাজ পরিহার করে মানবিক আচরণগুলো করে। কিন্তু পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে মানুষের মনে নিষ্ঠুরতার মাত্রা বাড়তে পারে। তিনি বলেন, যেসব খুনের ঘটনা ঘটছে পুলিশ তা তদন্ত করে অপরাধীকে আইনের আওতায় নিয়ে আসছে।
পুলিশ সদর দফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত ৫ বছরে সারা দেশে খুনের ঘটনা ঘটেছে ১৬ হাজার ৯৭৪টি। এর মধ্যে ২০১৭ সালে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছেন ৩ হাজার ৫৪৯ জন। ২০১৬ সালে ৮৭৯ জন, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ৩৫ জন, ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫২৩ জন, ২০১৩ সালে ৩ হাজার ৯৮৮ জন খুন হয়েছেন। এছাড়া গত ৫ বছরে রাজধানীতে খুন হয়েছেন ১ হাজার ১২ জন। এর মধ্যে ২০১৭ সালে ২১৮ জন, ২০১৬ সালে ৪৮ জন, ২০১৫ সালে ২৩৯ জন, ২০১৪ সালে ২৬২ জন, ২০১৩ সালে ২৪৫ জন। এর মধ্যে অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডই বীভৎস ও রোমহর্ষক।
গত ৩১ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের বেউতা এলাকায় মালয়েশিয়া প্রবাসী আল-আমিনের বাড়িতে সাভারের ভাকুর্তা এলাকার কবিরাজ মফিজুর রহমানকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। পরে ৮ থেকে ১০ টুকরা করে প্রতিবেশীর মাগুর মাছের খামারসহ বিভিন্নস্থানে ফেলে রাখা হয়। প্রথমে হাত-পা, মাথাবিহীন শরীর ও পরে মাথা উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় গত ২০ জানুয়ারি গোয়েন্দা পুলিশ মাকসুদা আক্তার লাকি, নজরুল ইসলাম নজু ও সালাউদ্দিন নামে ৩ জনকে গ্রেফতার করে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশকে জানিয়েছে, কবিরাজির নামে শারীরিক সম্পর্ক ও প্রতারণার প্রতিশোধ নিতেই মফিজুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। গত ২ নভেম্বর বাড্ডার হোসেন মার্কেট এলাকার ময়নারটেকের একটি বাসায় বাবা জামিল শেখ ও মেয়ে নুসরাতকে খুন করে মা আরজিনা বেগমের কথিত প্রেমিক শাহীন মল্লিক।
এছাড়া ১ নভেম্বর রাজধানীর কাকরাইলে পারিবারিক কলহের কারণে খুন করা হয়েছে মা শামসুন্নাহার ও ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওনকে। গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর পশ্চিম মাতুয়াইল কাজীরগাঁও এলাকায় মাদকাসক্ত বাবা তার চার বছর বয়সী সন্তান শাহীনকে খুন করে। গত ২৭ অক্টোবর মিরপুরের দুয়ারীপাড়া ৫ নম্বর গলির বাসার মেঝে খুঁড়ে কালাম নামে এক যুবকের কঙ্কাল উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় শামীম নামে এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়। শামীম গোয়েন্দা পুলিশকে জানিয়েছেন, তারা দুজনে বন্ধু। দুই বন্ধু ভালোবাসতেন এক নারীকে। ওই নারীকে পাওয়ার জন্য শামীম কালামকে খুন করে লাশ নিজের ঘরের মেঝেতে পুঁতে রাখে।
এছাড়া কল্যাণপুরে গত ১৫ ডিসেম্বর রাজধানীর দারুসসালাম থানা পুলিশ দক্ষিণ কল্যাণপুরে রাস্তার ওপর থেকে একটি সুটকেসে থাকা হাত, পা, মাথা কাটা এক ব্যক্তির মরদেহ উদ্ধার করে । ওইদিন সকাল ৮টায় প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা লাগেজটি দেখে পুলিশকে খবর দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে সুটকেস খুলে মরদেহটি উদ্ধার করে। তবে এ হত্যাকাণ্ডের ক্লু এখনও উদ্ঘাটন হয়নি।