ওহিদুল ইসলাম স্বপন ও মৌসুমী ইসলাম দম্পতি ২০ বছর ধরে সুখে-দুঃখে একসঙ্গে ছিলেন। তাদের ১৭ বছরের এক সন্তানও রয়েছে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন স্বপন। প্রায়ই মদ্যপান করে অনেক রাতে বাসায় ফিরতে শুরু করেন। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কলহের শুরু। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাসায় ফিরলে দু’জনের ঝগড়া শুরু হয়, চলে ভোর পর্যন্ত। এক পর্যায়ে ইট দিয়ে স্বামীর মাথা থেঁতলিয়ে হত্যা করেন মৌসুমী। এ ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর মালিবাগে তাদের বাসায়। গ্রেফতারের পর মৌসুমী হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
২৮ জানুয়ারি পল্লবীতে পোশাককর্মী স্ত্রী তাসমিলা বেগমকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন রিকশাচালক স্বামী নুরুল ইসলাম। তাদের তিন সন্তান রয়েছে। সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকত। এসব নিয়ে কলহের জেরেই নুরুল স্ত্রীকে হত্যা করেন। ৭ ফেব্রুয়ারি বাগেরহাটের চিতলমারীর বাওয়ালীপাড়া গ্রামে ছেলের লাঠির আঘাতে মারা যান বাবা জগদীশ বাওয়ালী। নিহতের দুই ছেলে জয়দেব বাওয়ালী ও কার্তিক বাওয়ালীর মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল। ঘটনার দিন সকালে দুই ভাই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। জগদীশ তাদের বাধা দিতে গেলে জয়দেবের লাঠির আঘাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। গত ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে নরসিংদীতে ছোট তিন-ভাইবোনকে শ্বাসরোধে হত্যা করে মেজো ভাই। পুলিশের ধারণা, পারিবারিক কলহে ভাই রুবেল মিয়া তাদের হত্যা করে। দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রায়ই এমন মর্মস্পর্শী হত্যাকাণ্ড ঘটছে।
পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সারাদেশে ৫১৩ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ভাই ভাইকে, সন্তান বাবাকে, স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে হত্যার একাধিক ঘটনা রয়েছে। নৃশংসতার শিকার হচ্ছে শিশুরাও। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম দুই মাসে সারাদেশে যৌতুকের কারণে ১৯ নারী নিহত হয়েছেন। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অপরাধ ও সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অন্তত সাতটি কারণে বাড়ছে পারিবারিক খুন। মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয়, সহনশীলতা কমে যাওয়া ও পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এ ধরনের নৃশংসতার প্রবণতা বাড়ছে। পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতার কারণে বাড়ছে হতাশা, মানসিক বিষণ্নতা ও আর্থিক দৈন্য। মানুষ মাদকের দিকেও ঝুঁকছে। এসব কারণেই পারিবারিক হত্যা কমানো যাচ্ছে না। এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করতে হবে। মূল্যবোধ জাগ্রত ও পারিবারিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
গত ১০ জানুয়ারি আদাবরের শেখেরটেকের বাসার মধ্যে বড় ভাই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ূয়া শিহাবুল ইসলাম খান ওরফে শিহাবকে কুপিয়ে হত্যা করে ছোট ভাই সিফাতুল ইসলাম খান ওরফে সিফাত। মাদকাসক্ত শিহাব বাবা-মা, একমাত্র বোন ও ভাই সিফাতের ওপর নির্যাতন চালাতেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শিহাবকে গলা কেটে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার রতনপুরে স্ত্রী নুরীজা বেগমকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন তার স্বামী শাহীন আলম। ১০ ফেব্রুয়ারি শরীয়তপুরের গোসাইরহাট উপজেলার চোট কালীনগর গ্রামে ছেলে দবির খানের হাতে খুন হন বাবা ওয়ারেছ খান। ১১ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বাড়িপাড়ায় বড় ভাইয়ের লাঠির আঘাতে মারা যান ছোট ভাই নুর ইসলাম। ২৬ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জের গোপীনাথপুরে ভাইয়ের হাতে খুন হন ভাই ফরিদ সিকদার। ৩ মার্চ বগুড়ার ধুনট উপজেলার জোলাগাতী গ্রামে স্ত্রী আসমা খাতুনকে নির্যাতনের পর শ্বাসরোধে হত্যা করে স্বামী আল মাহমুদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান সমকালকে বলেন, সমাজ আধুনিকতার দিকে এগোচ্ছে। মোবাইল ফোন, ফেসবুক ও টুইটার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় পরিবারের কেউ কারোর সঙ্গে সময় দিতে পারেন না। ফলে পারিবারিক বন্ধন কমছে। মাদকাসক্ত ব্যক্তির সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে, নৈতিকতা হ্রাস পাচ্ছে। এসবসহ বেশ কিছু কারণে পারিবারিক খুনের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, সামাজিক সচেতনতা ও পারিবারিক বন্ধন বাড়াতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও দোষীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
ঢাবির সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, নানা কারণে মানুষের মূল্যবোধ কমে যাচ্ছে। কোথাও মূল্যবোধ চর্চার সুযোগও নেই। দেশে আইন আছে, তবে প্রয়োগ নেই। প্রয়োগ না থাকায় কেউ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। এ কারণে অসামাজিক কাজ হচ্ছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামাল বলেন, মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটছে। পারিবারিক কলহে স্ত্রী খুনের অন্যতম কারণ থাকে পরকীয়া। এ কারণে স্বামী খুনের ঘটনাও ঘটে। মাদক-সংক্রান্ত হত্যাকাণ্ড বিষয়ে তিনি বলেন, মাদক পরিবার ও সমাজকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ কারণে সৃষ্ট পরিবারিক কলহ থেকে হত্যার ঘটনাও ঘটছে। এসব রোধে পারিবারিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে, সামাজিক অনুশাসন মেনে চলতে হবে।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (গণমাধ্যম ও পরিকল্পনা) একেএম শহিদুর রহমান বলেন, দিন দিন মানুষের মধ্যে সামাজিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে, হত্যাকাণ্ড তারই প্রতিফলন। ভাইয়ের কাছে ভাই, বন্ধুর কাছে বন্ধু নিরাপদ থাকবে_ এটিই হওয়ার কথা। কিন্তু তা থাকছে না। তিনি বলেন, সব খুন একই অপরাধ। প্রচলিত আইনে অপরাধীর বিচার হয়।