ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) ঘুষ, দুর্নীতিবিষয়ক প্রতিবেদন আমাদের নতুন করে চোখ খোলার একটি বিরাট সম্ভাবনা তৈরি করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার বিষয়টিকে আমরা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক বলে মনে করি। কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার অর্থ হলো সরকারি সেবা খাতসংশ্লিষ্ট অন্য সংস্থাগুলোও ইতিমধ্যে কমবেশি ‘যথেষ্ট দুর্নীতিগ্রস্ত’ হয়েছে বলে বাস্তবসম্মত আশঙ্কার সৃষ্টি হতে পারে।
কারণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আরও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সংস্থার নিয়মনীতির ওপর সরাসরি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারে। সুতরাং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার অর্থ তারা কেবল তাদের বিভাগীয় সেবা দিতেই ঘুষ নেয় তা নয়, বিশেষ করে পুলিশ অন্যান্য সরকারি সংস্থার সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও তারা প্রভাব বিস্তার করে। সুতরাং পুলিশ বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করা কিংবা তাদের দুর্নীতি কমিয়ে আনা, তথা তাদের আরও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়া থেকে বাঁচাতে সরকারকে সর্বোচ্চ পদক্ষেপ নিতে হবে।
পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা বড় গলায় বলে থাকেন যে বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা অনেক বেড়েছে। এখন জনগণের সামনে তাদের এটা পরিষ্কার করা উচিত যে সেসব রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা দুর্নীতি রোধে কী ভূমিকা রেখেছে।কারণ, আর্থিক সুবিধাদাতা তো কার্যত করদাতা আমজনতা। সেই আমজনতা বৈধভাবে পুলিশকে বর্ধিত বেতন দেবে এবং তারাই তাদের কাছ থেকে সেবা নিতে ঘুষ দিতে বাধ্য হবে—এটা তো হতে পারে না। সার্বিক বিচারে একটি বিষয় পরিষ্কার যে সরকারি সেবা খাতে সুবিধাবঞ্চিত মানুষই সব থেকে বেশি অসহায় হয়ে পড়েছে। এর একটা জবাবদিহি ও আশু প্রতিকার দরকার।
সরকারি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে সমাজের অনগ্রসর অংশ, বিশেষ করে দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অতিরিক্ত চাপে থাকার আরও বহুমাত্রিক ক্ষতিকর দিক আছে। যেমন ঘুষ দিয়ে তারা কোনোমতে নিজেদের পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। এটা দাবি করার যুক্তি অতীব দুর্বল যে ঘুষের বিনিময়ে তাদের জীবনে আইনের শাসনের শর্ত পূরণ হচ্ছে। সরকারি নীতিনির্ধারকেরা বরং এটাও খতিয়ে দেখতে পারেন, ঘুষের বিনিময়ে তাঁরা আসলে ভুক্তভোগীদের যা দিচ্ছেন, সেটা আদৌ বৈধ ‘সেবা’ কি না।
২০১৫ সালে টিআইবির আগের প্রতিবেদনে ঘুষ দিতে বাধ্য হওয়া খানার হার ছিল ৭১ ভাগ। দুই বছরের ব্যবধানে সেটা বেড়ে ৮৯ ভাগ হয়েছে। এটা এখন জলের মতো পরিষ্কার যে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে অল্প সময়ের ব্যবধানেই তা শতভাগ পূর্ণ হতে পারে। রিপোর্ট বলেছে, সাড়ে ৬৬ ভাগ খানাই সেবা-দুর্নীতির শিকার। ঘুষ নিয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকেরা অনেক সময় উদাসীন বা আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। এখন তাঁদের উচিত হবে টিআইবির এই ফলাফলকে জেগে ওঠার ঘণ্টাধ্বনি হিসেবে নেওয়া। অতীতের কিছু টিআইবি প্রতিবেদনের মতো এই ফলাফলকেও অভ্যাসবশত নাকচ করা হলে তা জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী ও একটা আত্মঘাতী বিষয় হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) দুর্নীতি প্রতিরোধের যত ধরনের ব্যবস্থা ও হাতিয়ার কাগজে-কলমে সচল রয়েছে, সেসব আসলে কতটা জনস্বার্থ রক্ষা করতে পারছে, সেই হিসাব-নিকাশও জরুরি।
আমরা টিআইবির গবেষণার একটি বিষয়কে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় নিতে বলব। তারা দেখিয়েছে যে যেসব সেবাদানের প্রক্রিয়ায় মানুষের শারীরিক সংশ্লিষ্টতা কমিয়ে যান্ত্রিক পদ্ধতিনির্ভর করা সম্ভব হয়েছে, সেখানে ঘুষের প্রকোপ কমেছে। বিষয়টি সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। আমরা আশা করব, সেবা খাতের যেখানেই সম্ভব, সেখানেই যন্ত্রনির্ভরতা বাড়াতে হবে। আর আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জন্য সব থেকে জরুরি রাজনৈতিকীকরণ বন্ধ এবং পেশাদারির পুনরুজ্জীবন।