এইচ এম আকতার
২০১০ সালে শেয়ারাবাজারে কেলেঙ্কারিতে ক্ষত তৈরি হয় দেশের অর্থনীতিতে। সে ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে বিনিয়োগকারিরা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, অর্থনৈতিক এ ক্ষতের পরিমাণ ২০১২ সালের অক্টোবর সময়ের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ২২ শতাংশ বা ২৭ বিলিয়ন ডলার। ওই সময়ের মুদ্রা বিনিময় হারের (প্রতি ডলার ৮১ টাকা) হিসেবে বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ কোটি টাকার বেশি। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারের ধসের নায়কদের বিচার না হওয়াকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে সংস্থাটি। ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারিদের প্রশ্ন সে বিচার কি কখনও হবে।
শেয়ারবাজার সংস্কারে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয় তুলে ধরতে ‘ক্যাপিটাল মার্কেট ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ : এ সেক্টর রিফর্ম পারসপেক্টিভ’ শীর্ষক প্রতিবেদন গত মাসে প্রকাশ করে এডিবি। সংস্থাটির ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে অর্থনৈতিক ক্ষতের এ চিত্র উঠে এসেছে। ২০১০ সালের কেলেঙ্কারির পর বাজার মূলধন কমে যাওয়া এবং দেউলিয়াত্ব, মানুষের পুঁজি ও কর্ম হারানোর ফলে সৃষ্ট সামাজিক অস্থিতিশীলতার প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষতের হিসাবটি করেছে এডিবি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ডিএসইর সূচক সর্বকালের শীর্ষে উন্নীত হয়। ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর ডিএসইর ওই সময়ের প্রধান সূচক ডিএসই ছিল ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্ট। তিন মাসেরও কম সময়ে ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তা ৫ হাজার ২০৩ পয়েন্টে নেমে আসে। পরবর্তী এক বছরের মধ্যে এ সূচক সর্বনিম্ন ৩ হাজার ৬১৬ পয়েন্টে নামে।
এর কারণ হিসেবে মার্জিন ঋণে শিথিলতা ও অতিরিক্ত নির্ভরতা, মানসম্মত ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং না থাকা এবং আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের দুর্বলতাকে দায়ী করছে এডিবি। ১৯৯৬ সালে শেয়ারবাজারের ধস সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর মীমাংসা না হওয়াকেও এর অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে সংস্থাটি।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের ক্ষতি সূচক ও ইনডেক্স দেখে করলে তা যথাযথ হয় না। কোনো সিকিউরিটিজের দর কমে যাওয়ার পর কেউ শেয়ার ছেড়ে না দিয়ে পরবর্তী সময়ের জন্য অপেক্ষা করলে ক্ষতির আশঙ্কা কম থাকে। কিছু বিনিয়োগকারীর অতি আগ্রাসী মনোভাবের কারণে বাজারে এ ধরনের ঘটনা ঘটে।
তিনি আরো বলেন, ওই সময় শেয়ারবাজারে ধসের পেছনে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগকারীসহ সব পক্ষই দায়ী ছিল। ব্যাংকের অতিরিক্ত শেয়ারের কারণে মূল্যসূচক বাড়লেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো ভূমিকা রাখেনি। শেয়ারবাজারের উল্লম্ফন চোখের সামনে হলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিএসইসি বিষয়টি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অন্যদিকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা একটি সংঘবদ্ধ চক্রের কবলে পড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
অর্থনীতিতে দেশের শেয়ারবাজার তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেনি বলে মনে করছে এডিবি। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ধস-পরবর্তী সময়ে (২০১১-১২) ব্যাংকে সঞ্চয়ের পরিমাণ জিডিপির ৮ দশমিক ৩ শতাংশ। অন্যদিকে ইকুইটি ও বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহের পরিমাণ জিডিপির মাত্র দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। অর্থনীতিতে ব্যাংকভিত্তিক অর্থায়নের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা রয়ে গেছে। ব্যাংকের সম্পদ দেশের মোট আর্থিক সম্পদের ৮০ শতাংশের বেশি। ফলে প্রয়োজন থাকলেও অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের জন্য অর্থায়ন করতে পারেনি খাতটি। কারণ এতে ব্যাংকগুলোর ঋণ ঝুঁকিতে পড়ার আশঙ্কা ছিল। বন্ড মার্কেট জিডিপির মাত্র ৫ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারের বন্ড জিডিপির ৪ শতাংশ ও করপোরেট বন্ড মার্কেট জিডিপির ১ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় এটি অত্যন্ত কম।
ডিএসই ব্রোকার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি আহমেদ রশীদ লালী বলেন, বাজারে বিনিয়োগকারীদের কিছু ভুলভ্রান্তি থাকবে। তবে ওই সময় বাজার ধসের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকই মূলত দায়ী। ২০০৬ সাল থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ শুরু করার পর ২০১০ সালের মধ্যে অনেকেই তাদের বিনিয়োগসীমা ১০ শতাংশ অতিক্রম করে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত নিয়ে গেছে। পরবর্তীতে বাজার ধসের সময় তা এক মাসের মধ্যে সমন্বয় করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ দেয়ায় শেয়ারবাজার বিরাট অংকের বিক্রয় চাপ সহ্য করতে পারেনি।
২০১০ সালের ধসের ঘটনার পর বেশকিছু আইনি পদক্ষেপ নেয় সরকার। এর অংশ হিসেবে ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের জন্য পুনঃঅর্থায়ন তহবিল, বাজার পুনর্গঠনে তহবিল গঠন, স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন, ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং আইন পাস ও বিএসইসির আইন সংশোধন করা হয়। পাশাপাশি শেয়ারবাজার উন্নয়নে সরকারের সঙ্গে ক্যাপিটাল মার্কেট মাস্টারপ্ল্যান (২০১২-২২) বাস্তবায়ন করছে এডিবি।
ক্যাপিটাল মার্কেট মাস্টারপ্ল্যানের আওতায় যেসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে তার মধ্যে রয়েছেÑ এ খাতের মধ্যস্থতাকারীদের অবস্থান সুসংহত করা, প্রাইমারি ডিলার ব্যবস্থার সংস্কার, কেন্দ্রীয় ক্লিয়ারেন্স ও সেটেলমেন্ট সিস্টেম স্থাপন এবং বীমা কোম্পানিগুলোর পুনঃঅর্থায়ন। ২০১৭ সালে মধ্যস্থতাকারীদের জন্য ঝুঁকিভিত্তিক বিনিয়োগ বিধিমালা প্রবর্তন ও পুনঃঅর্থায়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সংহত হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি টিকে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোয় পর্যাপ্ত অর্থায়ন ও আর্থিকভাবে শক্তিশালী করার বিষয়টিও নিশ্চিত হবে।
সে সময় প্রায় ১০ লাখ বিনিয়োগকারি মূলধন হারিয়ে বাজার ছেড়েছিল, তারা এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এখনও অনেকে বাজার ছাড়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। গত ছয় বছরেও মূলধন আগের অবস্থায় ফিরেনি। যার ফলে অনেকেই বাজার ছাড়তে পারছে না। এখন ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৪৮২৩। ২০১০ সালের সমপরিমাণ সূচকে পৌঁছতে আর কত দিন লাগবে তা কেউ বলতে পারছে না। অথচ গত ছয় বছরে বাজারে মূলধন বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সে হিসাবে সূচকও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাওয়ার কথা। তা না হয়ে কমে দাঁড়িয়েছে অর্ধেকে।