প্রাচীন ভারতে, গ্রিসে ও মিসরে ধর্ষণের জন্য নির্ধারিত শাস্তি ছিল পুরুষদের উপস্থচ্ছেদ বা ক্যাস্ট্রেশন। আমরা সাধারণভাবে যাকে খোজা করা হিসেবে বুঝে থাকি। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুরুষদের যৌনক্ষমতা রহিত করা যায়। এখন প্রাচীন যুগ নয়, কিন্তু প্রাচীন যুগের বর্বরতা আমাদের প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। ধর্ষণ সেই বর্বরতা, যার শাস্তি হিসেবে এখন এই পথ বেছে নেওয়ার সময় এসেছে।
কথাটা তুচ্ছার্থে বলছি না। প্রতিবেশী ভারতে এ নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে বিস্তর কথা চালাচালি হচ্ছে। কেউ কেউ অপরাধের তুলনায় শাস্তি অধিক, এই যুক্তিতে তার বিরোধিতা করেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেক মানবাধিকারকর্মী রয়েছেন, ধর্মশাস্ত্র বিশেষজ্ঞ রয়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই পুরুষ। খুব কম মেয়ের লেখা পড়েছি, যাঁরা এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছেন। কারণটা বোঝা দুষ্কর নয়।
এই প্রস্তাবকে বর্বরতা বলে তা কাগজের ঠোঙার মতো ছুড়ে ফেলে দেওয়া হবে, সে কথায় আমার সন্দেহ নেই। অথচ পাল্টা যুক্তি উঠছে, ধর্ষণের মতো যে বর্বরতাকে আমাদের প্রতিদিন সহ্য করতে হচ্ছে, তার তুলনায় এই শাস্তি মোটেই তেমন নির্দয় বা নির্মম নয়। এখন অনেক দেশেই, এমনকি এই আমেরিকাতেও, উপস্থচ্ছেদ বা খোজা করাকে ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন নির্যাতনের জন্য সমতুল্য শাস্তি বিবেচনার ‘ঐচ্ছিক’ ব্যবস্থা রয়েছে। এ দেশে অনেক সময় কামাসক্ত আচরণ ও যৌন আগ্রাসনকে মানসিক বৈকল্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আজীবন জেলখানায় কাটানোর বদলে এই সব ধর্ষক ব্যক্তিদের স্বেচ্ছায় উপস্থচ্ছেদের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ফলে তারা এখন থেকে সমাজে বসবাসের জন্য আর বিপজ্জনক নয়, এই বিবেচনা থেকে তাদের মুক্তির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়া ও ফ্লোরিডায় শিশুদের ওপর যৌন আগ্রাসনের জন্য শাস্তিপ্রাপ্ত একাধিক ব্যক্তি কারাগারের বাইরে আসার সুযোগ পেয়েছে।
ধর্ষণের দুটো দিক রয়েছে, একটি ব্যক্তিগত, অন্যটি সামাজিক। অধিকাংশ সমাজেই পুরুষ নিজেদের অধিক ক্ষমতাবান বলে ধরে নেয়, তার গায়ে জোর বেশি, প্রায় ক্ষেত্রেই পকেটে পয়সা বেশি। নারীর দেহের ওপর তার একটি স্বাভাবিক অধিকার রয়েছে, এমন বোধ সে শৈশবাবধি দেখে আসছে, পরিবারের ভেতর, পরিবারের বাইরে। পুরুষ হলে অপরাধ করেও পার পাওয়া যায়, এই সত্যটিও তার অতিপরিচিত। পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশন অথবা ফিল্মের পর্দায় যৌনাগ্রাসন আমরা প্রতিদিন দেখছি, ফলে এটি একটি প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা। ফলে যৌন আগ্রাসন এই পুরুষের চোখে, তা সে ১৩ বছরের বালক অথবা ৬৩ বছরে প্রৌঢ়, যা-ই হোক না কেন, আদৌ বড় কোনো অপরাধ নয়। আমাদের মতো শ্রেণিবিভক্ত ও প্রায় সামন্ততান্ত্রিক সমাজে গরিব অথবা দুর্বল হলে তো কথাই নেই। এটি তার পৌরুষের প্রকাশ, ফলে তা পুরুষের আত্মপরিচয়ের অংশ। সে কারণে পুরুষের চোখে যৌন আগ্রাসন কোনো অপরাধ তো নয়ই, এটি তার ক্ষমতার প্রকাশ, ফলত তার অবিভাজ্য অধিকারের অন্তর্গত।
যৌনতার ব্যাপারে এই পুরুষতান্ত্রিক অধিকার—ম্যাসকিউলিন প্রিভিলেজের প্রকাশ ঘটে নানাভাবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, অধিকাংশ কেন, সব ক্ষেত্রেই, ধর্ষণের জন্য দোষ বর্তায় মেয়েদের ওপর। ‘এত রাতে বাইরে কেন,’ ‘এত উত্তেজক পোশাক কেন,’—এই জাতীয় নির্মম যুক্তি তো মেয়েদের হরহামেশাই শুনতে হয়। ভারতে এক মহাসাধু দলবদ্ধ যৌন হামলার জন্য গ্রহ-তারকার অবস্থানকেও দোষী করেছেন, কিন্তু ধর্ষকদের কোনো অপরাধ খুঁজে পাননি। পুলিশের কাছে গেলে সেই একই কথা শুনতে হবে, তার ওপর রয়েছে মুখ টিপে হাসি ও লোলুপ দৃষ্টি। এ ছাড়া রয়েছে টাকার খেলা, ওপরওয়ালার টেলিফোন। অনেক ক্ষেত্রে (যেমন ভারতে ও পাকিস্তানে) ধর্ষণের শিকার যে নারী, ধর্ষণের প্রমাণ হিসেবে তাঁকে চারজন সাক্ষীর ব্যবস্থা করার আইনি ব্যবস্থা রয়েছে।
যৌনতা নিয়ে আমরা কথা বলি না, আমাদের সাংস্কৃতিক রক্ষণশীলতা সে জন্য দায়ী। ধর্ষণ নিয়ে তো নয়ই। পারিবারিক সম্ভ্রমের অজুহাতে খুব কম সময়ই ধর্ষণের অভিযোগ পুলিশ পর্যন্ত গড়ায় না। অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষক পরিবারের কোনো সদস্য, তাকে রক্ষার তাগিদে এমন নির্মম একটি অপরাধও চেপে যাওয়া হয়। এসবের একটাই উদ্দেশ্য, পুরুষতান্ত্রিক অধিকারের সংরক্ষণ।
শুধু আমাদের দেশে নয়, পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ক্ষমতাবানেরা চিরকালই ধর্ষণের ব্যাপারটা উপেক্ষা করে এসেছে। আমি দীর্ঘদিন জাতিসংঘে কাজ করেছি। এখানে শান্তিরক্ষী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, শান্তি রক্ষার নামে যে দেশেই গেছে, তারা সেখানে যথেচ্ছ যৌনাচারে লিপ্ত হয়েছে। কম্বোডিয়ায় শান্তিরক্ষীদের নামে এই অভিযোগ উঠলে জাতিসংঘের এক উপমহাসচিব মন্তব্য করেছিলেন, ছেলেছোকরারা তো এমনই করবে। (তাঁর কথায়, ‘বয়েজ উইল বি বয়েজ।’) আমেরিকায় এক সিনেটর ধর্ষণের শিকার এমন মেয়েদের পরামর্শ দিয়েছিলেন, ধর্ষণ হলো বৃষ্টির মতো। অভিযোগ না করে তা উপভোগ করুন। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নারীদের ওপর ধর্ষণ হয়েছে, এই অভিযোগ নিয়ে তদন্তের জন্য যে কমিশন গঠিত হয়েছে, তার প্রধান বলেছেন, ‘আমাদের সৈনিকেরা কখনোই রোহিঙ্গা মেয়েদের ধর্ষণ করবে না; কারণ, এই সব মেয়ে বড় নোংরা (ডার্টি)।’
মেয়েদের প্রতি পুরুষের এই দৃষ্টিভঙ্গি, অথবা সমাজে নারী ও পুরুষের যে অসম সম্পর্ক, তা নির্মিত হয়েছে বিগত কয়েক হাজার বছরের আন্তসম্পর্কের প্রতিক্রিয়ায়। আমরা চাইলেই এই দৃষ্টিভঙ্গি অথবা নারী-পুরুষ সম্পর্ক রাতারাতি বদলে যাবে না। কিন্তু আজ যে মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হলো অথবা আগামীকাল যে শিকার হতে চলেছে, হাজার বছর অপেক্ষার বিলাসিতা তার নেই। অতএব, হাত গুটিয়ে থাকার সময় নেই, কর্তারা ঘুম ভেঙে উঠবেন, তার অপেক্ষায় থাকাও অর্থহীন।
অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আইনি শাসনের প্রতিপালন। কিন্তু পুলিশ বা বিচারব্যবস্থা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষতান্ত্রিক অধিকারের রক্ষাকর্তা, তাদের কোনো তাগিদ নেই ধর্ষককে চিহ্নিত করা বা তার শাস্তির নিশ্চয়তা বিধান। এই নিশ্চয়তার অবর্তমানে যা আশু প্রয়োজন তা হলো যাঁরা ধর্ষণের শিকার, তাঁদের চারধারে সংহতি ও সমর্থনের বর্ম নির্মাণ। এই বর্ম প্রথমে আসতে হবে পরিবার ও নিকটাত্মীয়দের ভেতর থেকে। আর তার বাইরে থাকতে হবে মেয়েদের নিজস্ব সমর্থনের বৃত্ত। পুরুষেরা যদি হাত বাড়ায় খুব ভালো, না বাড়ালে মেয়েদের নিজেদেরই এই কাজের দায়িত্ব মাথায় তুলে নিতে হবে। এই যে ক্ষুদ্র ও বৃহত্তর বর্ম, তা কেবল ধর্ষণের শিকার প্রতিটি নারীর ব্যক্তিপরিচয়ের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে তা-ই নয়, বিচারপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানেও উদ্যোগী হবে।
তবে পুরুষদের বাদ দিয়ে ধর্ষণের মতো অপরাধের প্রতিকার অর্জিত হবে না। আইন নির্মিত হয় কেন্দ্রে, কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয় স্থানীয় পর্যায়ে, যেখানে কর্তাব্যক্তিরা অধিকাংশই পুরুষ। তাঁদের যদি গা ধরে ঝাঁকাতে হয়, উপস্থচ্ছেদের মতো শাস্তির বিধান রাখা জরুরি।
বাংলাদেশের ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আইনে’র আওতায় ধর্ষণের জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। আমার প্রস্তাব, অতিরিক্ত শাস্তি হিসেবে প্রত্যেক ধর্ষণকারীকে খোজা করার মাধ্যমে নারীর ওপর যৌন অত্যাচার করার হাতিয়ার কেড়ে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হোক। যেকোনো ধর্ষক অপরাধী প্রমাণিত হলে এই তার যোগ্য শাস্তি, এই কথাটা যতটা সম্ভব ব্যাপকভাবে প্রচার করা হোক। প্রতিটি ভবিষ্যৎ ধর্ষণকারী যেন মাথায় রাখে, ধর্ষণের জন্য কারাদণ্ড ছাড়াও তার জন্য অপেক্ষা করছে এই শাস্তি। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের পর একসময় যদি সে ছাড়া পায়ও, তখনো গলায় ঝুলবে এই আজীবনের অভিশাপ।