নব্বইয়ের দশকের পর থেকে দ্রুতগতিতে সম্প্রসারণ হয়েছে দেশের অর্থনীতি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিকশিত হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাত। ২০১৬তে এসে তফসিলভুক্ত ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৭। দ্রুত বিকাশমান এ খাতে সুশাসনের অভাবে বেড়েছে ঝুঁকি। এর সঙ্গে বেড়েছে আর্থিক জালিয়াতি ও অপরাধ। দেশের ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে তিন পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের শেষ পর্ব
সোনালী ব্যাংকের নারায়ণগঞ্জ করপোরেট শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মো. নুরুজ্জামান। বিভিন্ন সময় ২৮টি ব্যাক টু ব্যাক এলসির বিপরীতে ব্যাংকের প্রায় ৫ কোটি ২৬ লাখ টাকা আত্মসাত্ করেছেন তিনি। এ নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থানায় গত বছরের ১১ মার্চ মামলা করে কর্তৃপক্ষ, যার পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৩১ মার্চ তাকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মাগুরা শাখার মুখ্য কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন খন্দকার সাজেদুল আলম। ভুয়া শস্যঋণ প্রকল্প দেখিয়ে তিনি আত্মসাত্ করেন ব্যাংকটির আলমখালী শাখার ৩ কোটি টাকা। এ অপরাধে ব্যাংক থেকে সাময়িক বরখাস্তের পাশাপাশি চলতি বছরের ২৭ এপ্রিল দুদকের অভিযানে গ্রেফতার হন তিনি।
শুধু মো. নুরুজ্জামান বা সাজেদুল আলম নন, আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন তাদের মতো হাজার হাজার ব্যাংক কর্মকর্তা। দুর্নীতির অভিযোগে প্রায়ই দুদকের অভিযানে গ্রেফতারও হচ্ছেন ব্যাংকাররা।
২০১০ সালের শেষের দিকে অপ্রত্যাশিতভাবে বিপর্যয় নেমে আসে দেশের শেয়ারবাজারে। শেয়ারবাজারে বিপর্যয়ের রেশ কাটতে না কাটতেই আলোচনায় আসে ব্যাংকিং খাতের হল-মার্ক কেলেঙ্কারি। ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখাসহ একাধিক শাখার মাধ্যমে হল-মার্ক নামের অখ্যাত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী তুলে নেয় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। দেশের আর্থিক খাতের বড় এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ূন কবিরসহ ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের যোগসাজশের অভিযোগ ওঠে তখনই। আর্থিক খাতের বড় এ কেলেঙ্কারির প্রধান সুবিধাভোগী হল-মার্ক গ্রুপের এমডি তানভীর মাহমুদ ও জিএম তুষার আহমেদ এখন কারাগারে রয়েছেন। এছাড়া হল-মার্ক কেলেঙ্কারির নন-ফান্ডেড অংশের মামলায় গ্রুপটির চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলামও বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। তবে নির্বিঘ্নে দেশ ছেড়েছেন ব্যাংকটির সেই সময়কার এমডি হুমায়ূন কবিরসহ একাধিক কর্মকর্তা।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে আলোচনায় আসে পাঁচটি ব্যাংক থেকে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া বিসমিল্লাহ গ্রুপ। জানা গেছে, গ্রুপটির এমডি খাজা সোলায়মান চৌধুরী ও তার স্ত্রী এবং গ্রুপের চেয়ারম্যান নওরিন হাবিব ব্যাংক লুটের টাকা দিয়ে বর্তমানে দুবাইয়ে হোটেল ব্যবসা করছেন। এ ঘটনায় বিসমিল্লাহ গ্রুপের ১৩ জন ও পাঁচটি ব্যাংকের ৪১ জন ব্যাংকারকে আসামি করে ১২টি মামলা করে দুদক। আসামিদের মধ্যে রয়েছেন জনতা ব্যাংকের তিন শাখার ১২ জন, বেসরকারি খাতের প্রাইম ব্যাংকের নয়জন, প্রিমিয়ার ব্যাংকের সাতজন, যমুনা ব্যাংকের পাঁচজন ও শাহ্জালাল ইসলামী ব্যাংকের আটজন ব্যাংকার।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যেসব কর্মকর্তা দুর্নীতি করছেন, দুদক কর্মকর্তারা তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসছেন। কমিশনের বক্তব্য হচ্ছে, যারা জালজালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নেবেন কিন্তু সে ঋণ ফেরত দেবেন না, তা হতে দেয়া হবে না। দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ হিসেবে ব্যাংকিং খাতের যেকোনো অপরাধই নিয়ন্ত্রণ করতে দুদক সচেষ্ট রয়েছে।
হল-মার্ক ও বিসমিল্লাহ কেলেঙ্কারির ডামাডোলের মধ্যেই আলোচনায় আসে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকে লুটপাটের ঘটনা। ব্যাংকটির তত্কালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে অখ্যাত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আত্মসাত্ করে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভালো মুনাফায় থাকা ব্যাংকটি এখনো এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এ ঘটনায় ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলাম দেশ ছাড়লেও চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। বেসিক ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় গত বছরের ২১, ২২ ও ২৩ সেপ্টেম্বর ৫৬টি মামলা করে দুদক। ঋণ জালিয়াতি, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে এখন পর্যন্ত ১৪ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করেছে বেসিক ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১১ সালের ডিসেম্বরে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা। অথচ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৫ হাজার ৭৩১ কোটি টাকায়। সে হিসাবে এ সময়ে দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৪৩ হাজার ৮৭ কোটি টাকা। একই সময়ে বেড়েছে ব্যাংকিং খাতে অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণও। জুন শেষে অবলোপনকৃত ঋণের পরিমাণ ছাড়িয়েছে ৪১ হাজার কোটি টাকা।
ব্যাংকিং খাতে চলমান অনিয়ম প্রসঙ্গে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) গবেষণা সেক্রেটারি ও এক্সিম ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক একেএম নুরুল ফজল বুলবুল বলেন, ব্যাংক হলো মানুষের আর্থিক আস্থার শেষ কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু গত কয়েক বছরে সরকারি ব্যাংকগুলোয় অপতত্পরতা ও কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের কিছু ভুলভ্রান্তি মানুষকে হতাশ করেছে। এ ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো সংশোধন করতে হবে। দেশের ব্যাংকিং খাত বিশেষ করে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলো একটি আস্থার জায়গায় ছিল। গুটিকয়েক মানুষের দুরভিসন্ধিমূলক স্বার্থের জন্য তা নষ্ট হতে দেয়া যায় না। এটি আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল। শেয়ারবাজারের বিপর্যয়ের পর মানি মার্কেটের বিপর্যয় হলে দেশের অর্থনীতিই হুমকির মুখে পড়বে। সবাই মিলে ব্যাংকিং খাতকে সংশোধন করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারকে আরো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) আয়োজিত গোলটেবিল আলোচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অফ-সাইট সুপারভিশন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ২০০৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ভালো অবস্থানে ছিল। এরপর হল-মার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের মতো বড় বড় ঋণ জালিয়াতি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে ডুবিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর এমডিরা এখনো নানা অনিয়মে জড়িত। তারা এখনো প্রতারণামূলক ঋণ বিতরণ করছেন। নানা ফাঁকফোকর খুঁজে তারা ব্যাংকগুলোর সর্বনাশ করছেন। যেখানে কোনো গ্রাহককে ৩০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়া যায়, সেখানে ব্যাংকগুলো ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দিচ্ছে। অথচ এ পরিমাণ ঋণ দেয়ার ক্ষমতা স্বয়ং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরেরও নেই।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তার রেগুলেটরি ও সুপারভাইজরি কর্মকাণ্ড দেশের ব্যাংকগুলোর ওপর যথার্থভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। হল-মার্ক, বেসিক ব্যাংকসহ যে কেলেঙ্কারিগুলো হয়েছে, সেগুলোর বড় অংশই বাংলাদেশ ব্যাংক চিহ্নিত করেছে। আমরা ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যাংকার্স মিটিংয়ে কথা বলি ও প্রজ্ঞাপন জারি করার মাধ্যমে ব্যাংকগুলোকে যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকি। যে ব্যাংকগুলোয় অনিয়ম হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অনেক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে অপসারণ করা হয়েছে, বোর্ড ভেঙে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের যাতে কর্তৃত্ব বাড়ে, সে ব্যাপারেও আইনি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ বেশকিছু ব্যাংকে পর্যবেক্ষক দেয়া হয়েছে।