বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বেপরোয়া হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজি ও নিয়োগ বাণিজ্য। অসহায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও এসব নিয়ে এখন ফুঁসে উঠেছে স্থানীয় এলাকাবাসী। অভিযোগ রয়েছে, মাথাভারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে সুবিধাবাদী বিএনপি ও জামায়াতপন্থীদের কলকাঠিতে চলছে সবকিছু। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে-বাইরে বিরাজ করছে এক ধরনের অস্থিরতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বহনকারী একটি বাসে গত বুধবার রাতে ক্ষুব্ধ স্থানীয় এলাকাবাসীর আগুন ধরিয়ে দেয়ার নেপথ্যেও রয়েছে টেন্ডার ও নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা বিএনপি ও জামায়াতপন্থী একটি সিন্ডিকেটের প্রভাব বিস্তার। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য ও সাবেক ছাত্রনেতা কৃষিবিদ আব্দুল মান্নান এমপি জনকণ্ঠকে জানান, ছাত্রলীগের টেন্ডারবাজি বন্ধ করতে হবে এবং এটি কারও কাম্য নয়। টেন্ডার বাণিজ্য ও নিয়োগ সামনে রেখে শহরে আধিপত্য বিস্তার ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব চলছে বলে মন্তব্য করে সাবেক এই দাপুটে ছাত্রনেতা জানান, আগামী সিন্ডিকেট সভায় এসব নিয়ে আলোচনা করা হবে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক নেতাসহ কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শিক্ষার্থী।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ও ফাও খাওয়া নিয়ে রাতারাতি বেপরোয়া হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ। ক্যাম্পাসের কামাল রণজিত মার্কেটে বিশ্ববিদ্যালয় কর্মচারী হারেছের দোকান থেকে চা সিগারেট নিয়ে টাকা না দেয়ার প্রতিবাদ করায় ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয় হারেছের পুত্র রতন। ভাংচুর করা হয় হারেছের চা দোকানটি। এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় ছাত্রলীগের হাতে নাজেহাল হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় ছাত্র রনি ও কিরণ। ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ রনি ও কিরণকে বহিষ্কার করেছে এবং মামলায় আসামি করা হয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগের বেপরোয়া চাঁদাবাজি ও অত্যাচার নির্যাতনের প্রতিবাদে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের উদ্যোগে গত ৯ জুন বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কেওয়াটখালি বাজারের মাঠে বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশে করেছে স্থানীয় এলাকাবাসী। সর্বশেষ গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস পোড়ানোর ঘটনায় দ্রুত বিচার আইনে দায়ের করা মামলাতেও স্থানীয় এলাকাবাসীর সঙ্গে আসামি করা হয়েছে রনি ও কিরণকে। চা দোকানে হামলা ও ভাংচুরের আগে কামাল রণজিত মার্কেটের একটি দোকানে ২০ হাজার টাকা চাঁদাবাজি করে ছাত্রলীগ। ক’দিন পর আবারও ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে ছাত্রলীগ। কিন্তু এই চাঁদা দেয়ার আগেই চা দোকানে হামলার ঘটনা ঘটে। এরও আগে একই মার্কেটের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন কর্মচারীর মুদি দোকানে হামলা ও ভাংচুর করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জব্বারের মোড়ের রেস্তোরাঁর মালিকরাও এ রকম চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছে। ছাত্রলীগের স্থানীয়দের চেয়ে উত্তরবঙ্গ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের স্থানীয় সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বীনা) উপকেন্দ্র নির্মাণের প্রতিটি টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করে ছাত্রলীগ। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিপি আব্দুস সালাম গোপালগঞ্জের উপকেন্দ্র নির্মাণের টেন্ডারে অংশ নিতে এসে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন গত ১৩ মে। অভিযোগ, ছাত্রলীগের সঙ্গে নেগোসিয়েশনসহ নগদ কমিশন না দেয়ায় এই হামলার ঘটনা ঘটে। কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি গোলাম সরওয়ার জানান, বীনার ঘটনায় আব্দুস সালাম বাদী হয়ে ৫ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ এনে ছাত্রলীগের সভাপতি আজাদ, সাধারণ সম্পাদক ইমনসহ ছাত্রলীগ নেতাদের নামে মামলা করেছেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুজ্জামান ইমন জনকণ্ঠের কাছে অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, মামলায় ছাত্রলীগকে আসামি করা হলেও আসলে এই হামলায় জড়িত ছিল বহিরাগত সন্ত্রাসীরা। বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে অবহিত করা হয়েছে। তদন্তপূর্বক ছাত্রলীগ দায়ী হলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এই সম্পাদক। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি আব্দুস সাত্তার ম-লের মেয়াদে পছন্দের ঠিকাদারকে কাজ না দেয়ায় ক্ষুব্ধ ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শাহীন আলমকে প্রধান প্রকৌশলীর সামনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে। এ ঘটনায় জোটবদ্ধ হয়ে প্রকৌশলীরা নালিশ করেছিলেন ভিসির কাছে। কিন্তু কোন ফল হয়নি। এর পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল বিভাগে চলছে ছাত্রলীগের একক কর্তৃত্ব ও আধিপত্য। এখানকার সব টেন্ডারের কাজ নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্রলীগ। বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রধান প্রকৌশলীর দফতর থেকে ৩-৪ কোটি টাকার টেন্ডার হয়ে থাকে। ঠিকাদারদের ৫০ হাজার টাকা থেকে ৫০-৬০ লাখ টাকার প্রতিটি টেন্ডারে ছাত্রলীগকে ১০ শতাংশ হারে বাধ্যতামূলক কমিশন দিতে হয় বলে জানা গেছে। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন টেন্ডারে এখন আর যোগ্য কোন ঠিকাদার অংশ নিচ্ছে না। ফলে প্রতিযোগিতা ছাড়াই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব টেন্ডারের কাজ। নাম প্রকাশ করা হবে না শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রকৌশলী জানান, এর আগেও ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে টেন্ডারবাজি করেছে। তবে এত ব্যাপক ও বেপরোয়া ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণ ও বেগম ফজিলাতুননেছা মুজিব হোস্টেলের বাকি নির্মাণ কাজের প্রক্রিয়াধীন টেন্ডার নিয়েও এ রকম টেন্ডারবাজির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা।
এর আগে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) ময়মনসিংহ সদর দফতরে নিয়োগ বাণিজ্যের ঘটনায় সংস্থাটির মহাপরিচালক ছাত্রলীগের হামলায় লাঞ্ছিত হন। অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ নিয়ে এই অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর ড. আক্তার হোসেন, প্রফেসর ড. আব্দুস সাত্তার ম-লসহ বর্তমান ভিসি প্রফেসর ড. রফিকুল হকের মেয়াদে শিক্ষক, অফিসার ও কর্মকর্তা নিয়োগেও ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। বিশ্ববিদ্যালয়ে সুবিধাবাদী বিএনপি ও জামায়াতপন্থী একটি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগ কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে নিজস্ব মতাদর্শের বাইরে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী কর্মকর্তা, অফিসার ও শিক্ষক নিয়োগের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। প্রচার রয়েছে প্রত্যেক পদের বিপরীতে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে। তবে শিক্ষক নিয়োগে এ রকম কোন লেনদেন হয়নি বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়েরই একাধিক শিক্ষক সূত্র। সূত্রগুলো আরও জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান সরকার মেয়াদে যেসব নিয়োগ হয়েছে তাতে হাতেগোনা আওয়ামীপন্থীর পাশাপাশি বিএনপি ও জামায়াতপন্থীরাও নিয়োগ পেয়েছে অবলীলায়। প্রচার রয়েছে, বিএনপিপন্থী ট্রেজারের পুত্র রাকিবুল হাসানকে সহকারী হিসাবরক্ষক পদে, জামায়াত পরিবারের নাহিদ সাত্তারকে কৃষি অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক পদে, বিএনপিপন্থী শাহীন হালিমকে ক্রীড়া প্রশিক্ষক পদে, সোনালী দলের কর্মী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে প্যারা সাইটোলজি বিভাগের প্রভাষক, বিএনপিপন্থী আনিসুর রহমান টিটুকে ফুড টেকনোলজি বিভাগে, ছাত্রদলের সাবেক নেতা লাভলু মজুমদারকে গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান বিভাগে, শিবিরকর্মীকে কৃষি অর্থনীতি বিভাগে, ছাত্রদলকর্মী মোর্শেদা নাসরিনকে ভেটেরিনারি বিভাগে, আরেক শিবিরকর্মীকে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগে নিয়োগসহ বিএনপি-জামায়াত ও বিএনপিপন্থী শিক্ষক সংগঠন সোনালী দলের একাধিক নেতা ও পরিবারের সদস্যদের বর্তমান সরকার মেয়াদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন হলের প্রভোস্ট, হাউস টিউটরসহ কৃষি মিউজিয়ামের পরিচালক, কমিউনিটি কাউন্সিল ও ল্যান্ড স্ক্যাপ প্রধান পদে নিয়োগ নিয়েও বিতর্ক রয়েছে।
অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে বিএনপি ও জামায়াতপন্থী প্রশাসনসহ শিক্ষক ও অফিসার তাদের দলীয় মতাদর্শের নেতাকর্মী সমর্থকদের নিয়োগে সক্ষম হয়েছে। সর্বশেষ ১৮৬ কর্মচারী নিয়োগ সামনে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের বিএনপি-জামায়াতের ওই সিন্ডিকেট ছাত্রলীগকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে আবারও তৎপর হয়ে উঠেছে। এ নিয়ে শহরকেন্দ্রিক পাল্টা অভিযোগও রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নিয়োগে ভাগ বসাতে স্থানীয় এলাকাবাসীর ব্যানারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগবিরোধী একটি মহল সরব হয়ে উঠেছে বলে প্রচার রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক শিক্ষক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রফেসর ড. মঞ্জুরুল আলম জানান, সব ক’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে ভাল চলছিল কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু প্রভাব বিস্তার নিয়ে যা ঘটছে তা অনাকাক্সিক্ষত এবং কারও কাম্য নয়। বিএনপিপন্থী সোনালী দলের সাবেক সভাপতি প্রফেসর নজরুল ইসলাম আক্ষেপ করে জনকণ্ঠকে জানান, কর্মচারী নিয়োগকে বৈধ করতেই এসব ঘটছে। এখন যারা ছাত্রলীগ করে তাদের নেটওয়ার্ক বেশি বলেই হয়তবা টেন্ডারবাজি কিংবা নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে পদস্থ কাউকে লাঞ্ছিত করার পরও প্রতিকার মিলছে না। এ কারণেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে ছাত্রলীগ। এ রকম পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ টিএসসিতে এক সভা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা জোরদার ও বাসে হামলাকারী বহিরাগতদের গ্রেফতারসহ আজ শনিবারের মধ্যে কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি গোলাম সরওয়ারের অপসারণ দাবি করে আল্টিমেটাম দিয়েছে।