ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নিয়োগ বাণিজ্যের বলি হয়েছে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ হাজার শিক্ষার্থী। নিয়োগ বঞ্চিত ছাত্রলীগ ও স্থানীয় ক্যাডারদের গাড়ি ভাংচুর, বিভিন্ন অফিস ভাংচুর, বোমা হামলা, বোমা মেরে গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, প্রতি রাতে গুলী বর্ষণ, ছাত্রলীগ সম©র্র্থত স্থানীয় ক্যাডারদের সশস্ত্র মহড়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে ক্যাম্পাসে। নিরাপত্তার অভাবে ও হামালার আশঙ্কায় ক্যাম্পাসে পরিবহন সচল করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভয়ে ও আতঙ্কে কোন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারী ক্যাম্পাসে আসতে পারছে না। ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে একাডেমিক ও প্রশাসনিক সকল কার্যক্রম। টানা ১৫ দিন ধরে অচল রয়েছে ক্যাম্পাস। গত ১৫ দিনে বিভিন্ন বিভাগের প্রায় শতাধিক চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে। ফলে সেশনজট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এনিয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। ফুসে উঠছে বিভিন্ন শিক্ষক ও ছাত্র সংগঠন। এদিকে ক্যাম্পাস সচল করার দাবিতে যে কোন মুহূর্তে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কঠোর আন্দোলনে যেতে পারে বলে জানা গেছে। কবে ক্যাম্পাস সচল হবে? আবার কবে ফিরে যাবে ক্লাসে? তা নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে হল ছাড়তে শুরু করছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নিয়োগকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের নিয়োগ বাণিজ্য, নৈরাজ্যে ও প্রশাসনের দলীয়করণ, আত্মীয়করণের প্রতি তীব্র নিন্দা, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়ে অতিদ্রুত ক্যাম্পাস সচল করার দাবি জানিয়েছে ছাত্রশিবির, ছাত্রদলসহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠন ।
এদিকে গত মঙ্গলবার ভিসি, প্রো-ভিসির পদত্যাগ ও অবৈধ গণনিয়োগ বাতিলের দাবিতে সাংবাদিক সম্মেলন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন গ্রীন ফোরাম ও জিয়া পরিষদ। ক্যাম্পাস চালাতে ব্যর্থ, অবৈধ নিয়োগ বাণিজ্য, দলীয়করণ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনে এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসির পদত্যাগসহ ও অবৈধ গণনিয়োগ বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বিজ্ঞাপিত পদের অতিরিক্ত প্রায় দেড় শতাধিক জনবল নিয়োগ দিয়েছে। নিয়োগের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকরা।
উল্লেখ্য, গত ৭ ও ৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ২১৭তম সিন্ডিকেটে বিশ্ববিদ্যালয় প্রসাশন ফলিত রসায়ন ও রাসায়নিক প্রযুক্তি বিভাগ এবং পরিসংখ্যান বিভাগে মোট ৪ জন শিক্ষকসহ ১৫২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেয়। এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের গ্রুপের নেতা-কর্মী ও স্থানীয় কিছু ক্যাডার নিয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে ছাত্রলীগের নিয়োগ বঞ্চিত ও স্থানীয় ক্যাডাররা। এরই সূত্র ধরে গত ১০ সেপ্টেম্বর ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সামসুজ্জামান তুহিনের নেতৃত্বে চাকরি বঞ্চিত দলীয় ও স্থানীয় ক্যাডাররা প্রক্টর অফিসে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। একই দাবিতে গত ১৩ সেপ্টেম্বর তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসি পরিচালকের অফিস, মেডিকেল, প্রকৌশলী অফিস, পরিবহন অফিস, প্রশাসনিক ভবনে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। বোমা মেরে দুটি বাস জ্বালিয়ে দেয় এবং একটি এ্যাম্বুলেন্স ভাংচুর করে। গত ১৬ সেপ্টেম্বর পুলিশ প্রহরায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারার ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গাড়ি ক্যাম্পাসে পৌঁছায়। অফিস শেষে দুপুর দুইটায় বাড়ি ফেরার সময় গাড়ি ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া মহাসড়কের মধুপুর নামক স্থানে পৌঁছালে চাকরি বঞ্চিত ছাত্রলীগ ও স্থানীয় ক্যাডাররা প্রো-ভিসি প্রফেসর ড. কামাল উদ্দিন ও ট্রেজারার প্রফেসর ড. শাহজাহান আলী ও কর্মকর্তার গাড়িতে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। এতে প্রো-ভিসির গাড়িতে থাকা বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. সরওয়ার মোর্শেদ ও আট কর্মকর্তা মারাত্মকভাবে আহত হন।
আবারো গত বৃহস্পতিবার সকাল ৯টার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার প্রফেসর ড. শাহজাহান আলী গাড়িতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার সময় গাড়িটি এগার মাইল নামক জায়গায় পৌঁছালে অজ্ঞাত সাত-আটজন চাকরি বঞ্চিত বহিরাগত ক্যাডার তার গাড়িকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় তারা শিক্ষকদের বহনকারী একটি গাড়িতেও হামলা চালায়। এই নিয়োগ বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও স্থানীয় বহিরাগত ক্যাডারদের তান্ডবলীলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত তিন কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
এই নিয়োগকে কেন্দ্র করে চাকরি বঞ্চিত ছাত্রলীগ ও স্থানীয় ক্যাডারদের গাড়ি ভাংচুর, বিভিন্ন অফিস ভাংচুর, বোমা হামলা, বোমা মেরে গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, প্রতি রাতে গুলী বর্ষণ, ছাত্রলীগ সমর্থিত স্থানীয় ক্যাডারদের সশস্ত্র মহড়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে। নিরাপত্তার অভাবে ক্যাম্পাসে কোন পরিবহন সচল করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ভয়ে ও আতঙ্কে কোন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস আসতে পারছে না। এ কারণে টানা ১৫ দিন ধরে ক্যাম্পাস কোন বিভাগে ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি । ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। একাডেমিক কার্যক্রম চালুর দাবিতে যে কোন মুহূর্তে সাধারণ শিক্ষার্থীরা কঠোর আন্দোলনে যেতে পারে। ক্লাস-পরীক্ষা অনুষ্ঠিত না হওয়ায় গত ১৫ দিনে বিভিন্ন বিভাগের প্রায় শতাধিক চূড়ান্ত পরীক্ষা স্থগিত হয়ে গেছে। ফলে চরম সেশন জটে পড়েছে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। কবে ক্যাম্পাস সচল হবে? আবার কবে ফিরে যাবে ক্লাসে? তা নিয়ে শঙ্কিত সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এ ব্যাপারে শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. এয়াকুব আলী বলেন, বিশ্ববিদ্যলয় প্রশাসন দলীয়করণ ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে বিজ্ঞাপিত পদের তিন গুণ নিয়োগ দিয়েছে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিনেন্সকে লঙ্ঘন করেছে। এমনিতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৫ কোটি টাকা বাজেট ঘাটতি রয়েছে। এই নিয়োগের ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো শোচনীয় হবে। আমরা এই অবৈধ গণনিয়োগ বাতিলসহ এর সাথে জড়িত প্রশাসনে কর্তাব্যক্তিদের পদত্যাগ দাবি করছি।
এদিকে অবৈধ গণনিয়োগ বাতিল, ভিসির পদত্যাগ ও অতিদ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় সকল একাডেমিক কার্যক্রম সচল করার দাবিতে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল (ইবি শাখা)। গতকাল শনিবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান ফটকে বেলা ১১টায় ইবি ছাত্রদলের সভাপতি ওমর ফারুক ও সাধারণ সম্পাদক রাশিদুল ইসলাম রাশেদের নেতৃত্বে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করে।
সমাবেশে ছাত্রদলের সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ বাণিজ্য দলীয়করণ, আত্মীয়করণের জায়গা নয়। এটি জ্ঞানার্জনের জায়গা। আর এই জ্ঞানার্জনের সুষ্ঠু পরিবেশ ধরে রাখতে আমরা বদ্ধপরিকর। তিনি আরো বলেন, যদি আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞানার্জনের এই মহাবিদ্যাপিঠকে স্বাভাবকি করা না হয়, সাধারণ শিক্ষার্থীদের লেখা-পড়ার অধিকার ফিরিয়ে দেয়া না হয় তা হলে ছাত্রদল সাধারণ ছাত্রদের সাথে নিয়ে কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশায়ারি উচ্চারণ করে।