প্রকাশ্যে অস্ত্রবাজির ঘটনা বাড়ছে চট্টগ্রামে। তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে প্রকাশ্যে চলছে অস্ত্রের মহড়া। একের পর এক খুনের ঘটনায়ও প্রকাশ্যে ব্যবহার হচ্ছে ভয়ঙ্কর সব অস্ত্র। এসব কোনোটির মামলা হলেও গ্রেফতার হচ্ছে না অস্ত্রধারীরা। আবার কোনো ঘটনায় অস্ত্রধারীদের গ্রেফতার দূরে থাক, তাদের বিরুদ্ধে মামলাও করে না পুলিশ। সর্বশেষ গত ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডে উপনির্বাচনে প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে গোলাগুলিতে লিপ্ত হয় সন্ত্রাসীরা। অস্ত্রসহ তাদের ছবিও প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তাদের গ্রেফতারে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। এমনকি কোনো মামলাও দায়ের হয়নি তাদের বিরুদ্ধে। অস্ত্রধারীরা গ্রেফতার না হওয়ায় তুচ্ছ ঘটনায় বাড়ছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের আস্টম্ফালনও দিন দিন বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের রাজনৈতিক বিবেচনায় দেখার কোনো সুযোগ নেই। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পার পেয়ে গেলে সমাজে খুনোখুনি, সংঘাত ও মারণাস্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাবে। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হবে। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। অস্ত্রধারীদের গ্রেফতারে পুলিশকে আরও সক্রিয় হতে হবে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নগর পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, ‘পুলিশের উপস্থিতিতে কিংবা জানামতে যদি কোনো ঘটনা ঘটে, তখন কোনো বাদী পাওয়া না গেলে সরকারের পক্ষে বাদী হয়ে মামলা করে পুলিশ। গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডে পুলিশের সামনে কোনো ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের নলেজে যে বিষয়টি নেই সেটি নিয়ে তো মামলা করার সুযোগ তেমন থাকে না। এ ক্ষেত্রে কেউ ক্ষুব্ধ কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকলে তারা মামলা করতে পারেন। এ ছাড়া যেসব ঘটনায় অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে অধিকাংশ অস্ত্রধারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে পুলিশের তৎপরতা আছে।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ওয়ার্ডটির বেচা শাহ মসজিদ এলাকায় দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রকাশ্য অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করে চার যুবক। পরদিন অস্ত্রসহ তাদের ছবি প্রকাশিত হয় বিভিন্ন পত্রিকায়। চারজনের মধ্যে দু’জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। একজন ওমর গণি এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ নেতা রাকিব হায়দার ও অন্যজন কমার্স কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদুর রশিদ বাবু। তাদের একজনকেও গ্রেফতার করেনি পুলিশ। এমনকি তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলাও দায়ের হয়নি বলে স্বীকার করেছেন বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম এম ময়নুল ইসলাম।
গত ১৬ ডিসেম্বর বায়েজিদ বোস্তামী থানার চন্দ্রনগর শ্যামল ছায়া আবাসিক এলাকায় প্রকাশ্য অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় স্থানীয় ভূমিদস্যু দিদার বাহিনীর দিদার, তার সহযোগী আশরাফ, রফিক, মিল্টন, তুষার ও ডিবি ফয়সাল। এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। এমনকি কোনো মামলাও দায়ের করা হয়নি।
গত ১৪ এপ্রিল দুপুরে বায়েজিদ বোস্তামী থানার আরেফিন নগর এলাকায় স্থানীয় যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসী মোস্তফা ও সোহেল গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় অস্ত্র উঁচিয়ে কয়েক রাউন্ড গুলি করে মো. সোহেল। এ ঘটনায় সাতজনকে গ্রেফতার করা হলেও সোহেলকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ প্রসঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, ‘চন্দ্রনগর শ্যামল ছায়া আবাসিক এলাকার বিষয়টি আমার জানা নেই। ১৪ এপ্রিলের ঘটনায় সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সোহেলকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। আশা করছি শিগগির তাকে গ্রেফতার করা যাবে।’
গত ৬ অক্টোবর সদরঘাট থানার দক্ষিণ নালাপাড়া বাসার সামনে খুন হন চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস। এ ঘটনায় গ্রেফতার মোক্তার হোসেন ও ফয়সাল আহমেদ পাপ্পু আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তারা উল্লেখ করেছেন, সুদীপ্তকে পিটিয়ে হত্যার সময় পরপর পাঁচ রাউন্ড গুলি করে জাহেদুর রহমান জাহেদ ও রুবেল দে ওরফে চশমা রুবেল। তাদের মধ্যে রুবেলকে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি গ্রেফতার করে পুলিশ। ছয় মাস পার হলেও জাহেদের হদিস পায়নি পুলিশ। সুদীপ্তকে হত্যার পর গা-ঢাকা দিলেও কিছুদিন আগে লালখানবাজার এলাকায় জাহেদকে প্রকাশ্যে দেখা গেছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় একটি সূত্র।
এ প্রসঙ্গে সদরঘাট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, ‘সুদীপ্ত হত্যার পলাতক অস্ত্রধারী রুবেলসহ কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর অন্যরা গা-ঢাকা দেওয়ায় তাদের এখনও গ্রেফতার করা যায়নি। তাদের ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা অব্যাহত আছে।’
গত ৩ ডিসেম্বর নগরের ডিটি রোডে নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে খুন হন পরিবহন ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদ। এ ঘটনায় মো. মামুন হোসেন ও মো. আলমগীর ওরফে শরবত আলমগীর নামে দু’জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তারা উল্লেখ করেছেন, হারুনের বুকে গুলি করে আলমগীর। পরে তার ভাই হৃদয় গিয়ে নিজের পিস্তল দিয়ে আরেক দফা গুলি করে। ঘটনার চার মাসেও ধরাছোঁয়ার বাইরে দুই সহোদর। তারা নগরের পশ্চিম মাদারবাড়ি চট্টলা বেকারি মোড় এলাকার আলুওয়ালার বাড়ির জানে আলমের ছেলে।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা সদরঘাট থানার উপপরিদর্শক মোহাম্মদ অলিউল্লাহ বলেন, ‘গ্রেফতারকৃত আসামিদের জবানবন্দি অনুযায়ী হারুনের খুনে যারা অস্ত্র ব্যবহার করেছে, তাদের তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। যে নামগুলো এসেছে তারা উচ্চ আদালত থেকে আগাম জামিন নেওয়ায় ধরা যাচ্ছে না তাদের। গ্রেফতার ও অস্ত্র উদ্ধারের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও আদালতের সঙ্গে পরামর্শ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
গত ১৬ জানুয়ারি নগরের জামালখান আইডিয়াল স্কুলের বিপরীতে কলেজিয়েট স্কুল ছাত্র আদনান ইসপারকে দিনদুপুরে খুন করা হয়। এ সময় আদনানের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়েছিল মো. সাব্বির খান নামে এক কিশোর। ঘটনার পরদিন রাতে সাব্বিরসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তারা সবাই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে সাব্বির খান জানিয়েছে, ঘটনার সময় যে পিস্তল ব্যবহার হয়েছে সেটি মহসিন কলেজ ছাত্রলীগ নেতা এনাম হোসেন তাকে দিয়েছেন। ঘটনার তিন মাস পূর্ণ
হলেও রাউজান উপজেলা এলাকার ছেলে এনামকে এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
আদনান হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালী থানার উপপরিদর্শক ইমদাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আদনান হত্যায় ব্যবহূত অস্ত্রটি এনামের বলে স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছিল সাব্বির। অস্ত্রটি এখনও উদ্ধার করা যায়নি। এনামকে ধরতে অভিযান অব্যাহত আছে।’
চট্টগ্রাম কলেজে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত ১২ জুলাই ছাত্রলীগের দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে প্রকাশ্য অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি করে বাকলিয়ার বগারবিল এলাকার কথিত যুবলীগ কর্মী মোহাম্মদ সেলিম। সাত মাস পার হলেও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি চকবাজার থানা পুলিশ। এ প্রসঙ্গে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুরুল হুদা বলেন, ‘সংঘর্ষে যার হাতে অস্ত্র ছিল সংঘর্ষের পর থেকে সে পলাতক। যার কারণে গ্রেফতার করা যায়নি। তবে চেষ্টা চলছে।’