ইয়াবা ব্যবসা, অপহরণ, হত্যা ও চাঁদাবাজির ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ আছে এমন অনেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। পূর্ণাঙ্গ কমিটির সহসভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক পদের বেশির ভাগ নেতায় নিয়মিত ছাত্র নন। এছাড়া বেশ কয়েকজন বিবাহিত ও চাকুরীজীবী আছে এমনও তথ্য রয়েছে।
এদিকে ত্যাগীনেতাদের বাদ নিয়ে তেলবাজদের কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ঝড় বইছে। নাম প্রকাশ না করা শর্তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের সভাপতি বলেছেন, বর্তমান সভাপতি- সাধারণ সম্পাদকের ঘনিষ্ঠ অনুসারী অনেকে রাজনীতি না করেও পদ পেয়েছেন। আবার বিরাগভাজন হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় থেকেও বাদ পড়েছেন কেউ কেউ।
সোমবার রাতে কমিটি ঘোষণার পর ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামসুল কবির তাঁর ফেসবুক পাতায় লেখেন, ‘অভিনন্দন ছাত্রলীগের নবগঠিত পূর্ণাঙ্গ কমিটির নেতাদের। ত্যাগ ও যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধু আমার অনুসারী হওয়ার অপরাধে যারা কমিটিতে জায়গা পায়নি, তাদের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।’
কমিটি নিয়ে আক্ষেপ করে ছাত্রলীগের আরেক সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শারমিন সুলতানা তাঁর ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, যোগ্যতার মাপকাঠি যেখানে অতিমাত্রায় তৈলমর্দন, সেখানে যোগ্যতা বলে কিছু নাই। সব ফটোশপ। আর এখন তো কথাই নাই। চলছে ডিজিটাল যুগের ডিজিটাল তেলবাজি। একটু কৌশলী হলেই মাঠে-ময়দানে না থেকেও আপনি পেতে পারেন, আপনার কাক্সিক্ষত পোস্ট।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্রীয় কমিটি হওয়ার কথা ২৫১ সদস্যের। কিন্তু গঠনতন্ত্রের নিয়ম ভঙ্গ করে এবার কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে ৩০১ সদস্যের। এছাড়া ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের শেষ পৃষ্ঠায় বিশেষ দ্রষ্টব্য দিয়ে লেখা রয়েছে, উপরিউক্ত কমিটিতে কেউ ব্যবসা বা চাকরিতে যোগদান করিলে তাদের তাৎক্ষণিকভাবে অব্যাহতি দেওয়া হবে। কিন্তু এই কমিটিতে নিয়ম ভঙ্গ করে তিনটি জাতীয় দৈনিকের নিজস্ব প্রতিবেদক হাবিবুর রহমানকে গণযোগাযোগ-বিষয়ক উপসম্পাদক, রফিকুল ইসলাম রনি ও রুহুল আমিনকে সহসম্পাদক করা হয়েছে। এ ছাড়া একটি অনলাইনের সহসম্পাদক জাকারিয়া বুলবুলকে সহসম্পাদক, জাতীয় একটি দৈনিকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি রেজাউদ্দৌলা প্রধান ওরফে রেজা আকাশ ও আরেকটি দৈনিকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি পিয়াল হাসানকে সহসম্পাদক করা হয়েছে।
গত সোমবার ছাত্রলীগের যে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে তার মধ্যে অনেক নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। এই সব অভিযোগ মধ্যে কমিটির সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন অরফে আনু এবং নিশিতা ইকবাল নদীর নামে ইয়াবা ব্যাসার অভিযোগ রয়েছে। এর আগে তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ও আশপাশের এলাকায় মাদক ব্যবসার অভিযোগে গণমাধ্যমে সংবাদ বের হয়।
সাকিব হাসান সুইমকে সহসভাপতি করা হয়েছে। তিনি ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। চাঁদা ও আধিপত্যের জেরে ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর গভীর রাতে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে কলেজের ছাত্র আসাদুজ্জামান ফারুক মারা যান। সুইম এ হত্যা মামলার অন্যতম আসামি। এ ঘটনার পরই তাঁকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। ঢাকা কলেজ ও আশপাশের এলকায় তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে চাঁদাবাজির অভিযোগও।
২০১০ সালের ১৮ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল-ছাত্রলীগের সংঘর্ষের সময় ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিনকে মাথায় লোহার রেঞ্চ দিয়ে আঘাত করেন ইমতিয়াজ বুলবুল ওরফে বাপ্পী। এমন অভিযোগের পরও তিনি ছাত্রলীগের গতকালের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সহসভাপতি হয়েছেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহমেদ কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহসভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে শিক্ষক লাঞ্ছনার অভিযোগে ২০১৩ সালে ‘তিন মাসের স্থগিত বহিষ্কার’ শাস্তিও দেওয়া হয়।
কাজী এনায়েতকে সহসভাপতি করা হয়েছে। তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সমাজসেবা-বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। শাহবাগের ফুলের দোকানে চাঁদাবাজি ও শিক্ষা ভবনের টেন্ডারবাজির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। মুহসীন হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মেহেদি হাসান পেয়েছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি পদ। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে ইয়াবা ব্যবসার। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ইয়াবা চালানের সময় আটক হওয়া ব্যক্তিরা জবানবন্দিতে মেহেদির নাম বলেন।
আশিকুল পাঠানকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনাবিষয়ক সম্পাদক। তাঁর বিরুদ্ধে গত বছর ক্যাম্পাসে প্রাইভেট কার চাপা দিয়ে এক রিকশাচালককে হত্যার অভিযোগ রয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চাঁদাবাজি ও ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
সৃজন ঘোষকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়েছে। তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক উপক্রীড়া সম্পাদক ছিলেন। চাঁদা না দেওয়ায় ২০১৪ সালে এক ব্যবসায়ীকে অপহরণের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় তাঁকে ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপরও তিনি পদ পেয়েছেন।
কমিটি গঠনের সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমানকে বেশ কয়েকবার ফোন করা হলেও তিরি রিসিভ করেননি। সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন বলেন, কমিটিতে পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে যাদের ছাত্রত্ব আছে তাদের পদ দেওয়া হয়েছে। একজন হত্যার অভিযুক্ত আসামি ও অপর একজন অপহরণকারীকে কমিটিতে স্থান দেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাদের এই অভিযোগের কারণে সোহাগ-নাজমুল ভাইদের কমিটির সময় তাদের ছাত্রলীগ বহিষ্কার করা হয়েছিলো। পরে তাদের বহিস্কার প্রত্যাহারও করেছেন তারা।
গত বছরের ২৬-২৭ জুলাই ছাত্রলীগের ২৮তম জাতীয় সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে পাঁচ সদস্যের ‘সুপার ফাইভ’ কমিটি গঠিত হয়। সম্মেলনের প্রায় সাত মাস পর গত সোমবার রাতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।