রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানা ছাত্রলীগের সভাপতি এবিএম ফারুক হোসেন হত্যার পেছনে রাজনৈতিক কোন কারণ নেই বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। তাদের মতে এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দলের জের ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘আরমান ট্রেডার্সের’ কর্তৃত্বের কারণেই খুন হন ছাত্রলীগ নেতা ফারুক ওরফে আরমান। পুলিশ ও গোয়েন্দারা এই তিন কারণকে সামনে রেখেই তদন্তে নেমেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দসহ প্রভাবশালীরা জানান, আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে কেন্দ্র করেও এ খুনের ঘটনা ঘটতে পারে। ফারুকের ভাই কামরুল হাসান জানান, চাঁদাবাজি ও মাদক বিক্রিতে বাধা দেয়ায় তার ভাইকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়। এই মাদক ব্যবসার সাথে স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতা জড়িত। এদিকে ফারুক হোসেন খুনের ঘটনায় পুলিশ ও র্যা ব তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। গতকাল শনিবার বাদ আসর জানাযা শেষে মানিকদি কবরস্থানে ফারুকের দাফন সম্পন্ন হয়। ফারুক হত্যাকান্ডের ব্যাপারে গতরাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ক্যান্টনমেন্ট থানায় কোন মামলা হয়নি বলে জানান ওসি হোসনে আরা বেগম। শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টায় ছাত্রলীগ নেতা ফারুক তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে মানিকদি বিদ্যা নিকেতনের উঁচু প্রাচীর ঘেরা মাঠে বসে গল্প করছিলেন। এ সময় সন্ত্রাসীরা তাকে গুলী করে হত্যা করে। এই হত্যাকান্ডের পেছনে স্থানীয় ছাত্রলীগ জামায়াত ও শিবিরকে দায়ী করে। গতকাল শনিবার ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বিভিন্ন স্থানে গিয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ করলে তারা জানান, এই হত্যাকান্ডের পেছনে রাজনৈতিক কোন কারণ নেই। ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীর জানান, হত্যাকারীরা ফারুকের পূর্ব পরিচিত বলেই মনে হচ্ছে। তারা পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই বিরোধের জের ধরে তাকে হত্যা করেছে। তিনি বলেন, শুক্রবার সন্ধ্যার কিছু সময় পরে ফারুক কয়েকজনকে সাথে নিয়ে আদর্শ বিদ্যা নিকেতনের ভেতরে ঢুকেছে এটা আমার সামনেই। এরপর তারা ভেতরে বসে কথা বলছিল। রাত সাড়ে ৯টার সময় খবর পাই কয়েকজন ফারুককে গুলী করে পালিয়ে গেছে। এ থেকে তিনি ধারণা করছেন, যারা ফারুককে হত্যা করেছে তারা পূর্ব পরিচিত এবং পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই এ হত্যাকান্ডটি ঘটানো হয়েছে। এখন যারা ফারুকের সাথে বসে কথা বলছিল তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই বোঝা যাবে হত্যাকান্ডের সময় কারা কি করেছিল এবং কারা জড়িত। ক্যান্টনমেন্ট থানা যুবলীগের আহবায়ক বশির আহমদ জানান, ফারুক হত্যার জন্য দায়ী সংঘবদ্ধ মাদক চক্র। তিনি বলেন, ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় মাদক ব্যবসা প্রতিরোধে ফারুক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে তা কার্যকরে উদ্যোগী হয়ে উঠেছিল। এ কারণেই তারা পরিকল্পিতভাবে ফারুককে হত্যা করে তাদের পথের কাঁটা সরিয়ে দেয়। অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী ও চক্রের সাথে কারা জড়িত জানতে চাইলে বশির আহমদ বলেন, তাদের হাত অনেক বড়। নাম বললে আমাকেও মেরে ফেলবে। শুধু বলি তাদের পেছনে অনেক বড় বড় নেতা ও প্রভাবশালী মহলের সাপোর্ট রয়েছে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, গত কয়েক মাসে মানিকদি, বালুঘাট এলাকায় মাদক বিক্রেতাদের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। তারা কাউকেই তোয়াক্কা করতো না। কারণ তাদের পেছনে ছিল প্রভাবশালী মহল। সূত্রগুলো জানায়, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ১৪ মাসে মানিকদিতে ৯টি হত্যাকান্ড ঘটেছে। এসব হত্যাকান্ডের পেছনে মাদক বিক্রি ও চাঁদাবাজিই মূল কারণ। তিন কারণ সামনে রেখে তদন্তে পুলিশ এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তার, অভ্যন্তরীণ দলীয় কোন্দলের জের ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘আরমান ট্রেডার্সের’ কর্তৃত্বের কারণেই খুন হয়েছেন ছাত্রলীগ নেতা এবিএম ফারুক হোসেন ওরফে আরমান। পুলিশ ও গোয়েন্দারা এই তিন কারণকে সামনে রেখে খুনের তদন্তে নেমেছে। এদিকে ফারুক হোসেন খুনের ঘটনায় র্যা ব-পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকে আটক করেছে। আটককৃতরা হচ্ছে- মানিকদি আদর্শ বিদ্যানিকেতনের সিকিউরিটি গার্ড গোলাপ হোসেন, স্থানীয় শিবির কর্মী মনিরুল হক ও মোহাম্মদ শাহাদাত হোসেন। গতকাল শনিবার সকালে মানিকদির একটি বাড়ি থেকে শাহাদাতকে গ্রেফতার করে র্যা ব। সংশ্লিষ্টদের তথ্য মতে, স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতার ইন্ধনে এই খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছে। আওয়ামী লীগের ওই নেতা এলাকায় মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছেন। তার একক আধিপত্যে অন্যরা কোণঠাসা ছিলেন। পুলিশের ধারণা পূর্ব পরিচিতরাই তাকে পরিকল্পিতভাবে খুন করেছে। তাছাড়া আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে একটি প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে ফারুকের দ্বনদ্ব চলে আসছিল। সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার শফিউদ্দিনের পক্ষে কাজ করায় ওই মহলটি ফারুকের ওপর নাখোশ হয়। বিভিন্ন সময় তাকে শাসিয়ে দেয়া হয়েছে। এদিকে ফারুকের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। কিছুক্ষণ পরপরই বিলাপ করে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে আছড়ে পড়ছিলেন ফারুকের বাবা মোবারক উল্লাহ। শোকে নির্বাক মা মোবাশ্বেরা বেগম পারুল। চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরছে পানি। কাঁদতে পারছেন না তিনি। ঢাকা মহানগরী পুলিশের উপ-কমিশনার (গুলশান বিভাগ) হাপিজ আকতার জানান, বিষয়টি তারা তদন্ত করে দেখছেন। পাশাপাশি ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে হত্যাকান্ডের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তাছাড়া ফারুকের পরিবারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কাউকে দায়ীও করা হয়নি। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত দায়ের করা হয়নি মামলা। অবশ্য ফারুকের ছোট ভাই কামরুল হাসান বলেছেন, এলাকায় মাদক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তার ভাই। এ জন্য তাকে খুন করা হয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন তারা। কামরুল জানান, তাদের একমাত্র বোন হাসিনা আকতারের বিয়ের ব্যাপারে ক্যান্টনমেন্ট এলাকারই এক প্রভাবশালীর স্বজনরা তাদের বাসায় আসেন। পাত্রী দেখার পর সন্ধ্যার দিকে ফারুক ও কামরুল মেহমানদের এগিয়ে দিতে বাসার বাইরে যান। কামরুল বলেন, রাত দশটার দিকে গুলীর শব্দ শুনে বাসা থেকে বের হয়ে মাঠে যান। সেখানে গিয়ে ভাই গুলীবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা শুনতে পান। পরে হাসপাতালে গিয়ে ভাইয়ের মৃত্যুর খবর জানেন তারা। কামরুল বলেন, স্থানীয় লোকজনের কাছে জানতে পেরেছেন, রনি, মাসুদ ও মাসুমসহ অন্যরা ফারুককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। যেখানে গুলী করে ফারুককে খুন করা হয় তা তার বাসা থেকে প্রায় দেড়শ গজ দূরে। কামরুল জানান, কারো সঙ্গে ভাইয়ের শত্রুতা ছিল না। কারা তাকে হত্যা করেছে পুলিশই বের করবে। তবে এলাকার একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ হত্যাকান্ডের সঙ্গে জড়িত। তিনি আরও বলেন ভাইয়া সবসময় সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কথা বলতেন। মানিকদি এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ কিছুটা বেড়ে যাওয়ায় সন্ত্রাস প্রতিরোধ কমিটি গঠন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওইসব সন্ত্রাসীরাই তাকে হত্যা করেছে। অন্যদিকে ফারুকের মৃত্যুর পর ক্যান্টনমেন্ট মানিকদি এলাকায় শুক্রবার মধ্যরাত থেকে উত্তেজনা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যা ব মোতায়েন করা হয়েছে। ঘাতকদের বিচারের দাবি করে গতকাল ফারুকের জানাযার আগে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করেছে। স্থানীয়রা জানান, রাত ১টার দিকে মানিকদি আদর্শ বিদ্যানিকেতন স্কুলের মাঠে হঠাৎ গুলীর শব্দ শুনতে পান। এ সময় বিদ্যানিকেতনের মূল গেট তালাবদ্ধ থাকলেও পকেট গেট খোলা ছিল। স্থানীয়রা ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ফারুককে পড়ে থাকতে দেখে হাসপাতালে পাঠানো হয়। এদিকে ঘটনার পর পরই আটক স্কুলের দারোয়ান গোলাপ মিয়া বলেছেন, শাহাদতের দোকানে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় ছাত্রনেতারা আড্ডা দেন। চা-সিগারেটের দোকানটি অনেক রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। রাত সোয়া ৯টার দিকে ফারুক হোসেন দেয়াল টপকে ভেতরে ঢুকেছিলেন বলে তিনি দাবি করেন। এর কিছুক্ষণ পরই গুলীর শব্দ শোনা যায়। আটক স্কুলের নিরাপত্তা প্রহরী গোলাপ মিয়া পুলিশকে জানান, রাত ৯টার দিকে ফারুকসহ ৪/৫ জন যুবক মানিকদী আদর্শ স্কুলের সীমানা প্রাচীর ডিঙিয়ে ভেতরে ঢোকে। সোয়া ৯টার দিকে হঠাৎ পর পর কয়েক রাউন্ড গুলীর শব্দ শুনতে পান তিনি। স্থানীয় লোকজনের কাছে খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ফাঁকা মাঠে ফারুকের অচেতন দেহ পড়ে থাকতে দেখে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (গুলশান বিভাগ) হাফিজ আকতার বলেন, ঘটনাটি রহস্যজনক। স্কুলের সীমানা প্রাচীর অনেক উঁচু। তার ওপর রয়েছে কাঁটাতারের বেড়া। এই প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে ভেতরে যাওয়া কঠিন। স্কুলের প্রধান ফটকও তালাবদ্ধ ছিল। ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি হোসনে আরা বেগম জানান, মাঠের চারপাশে দেয়ালঘেরা আর ওপরে ছিল কাঁটাতারের বেড়া। সন্ত্রাসীরা কিভাবে ভিতরে ঢুকলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তাছাড়া শুক্রবার থাকায় গেট বন্ধ থাকার কথা। ধারণা করা হচ্ছে, মাঠে সন্ত্রাসীদের ঢুকতে কেউ সহায়তা করেছিল। এ জন্য সিকিউরিটি গার্ডকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ফারুকের বাম পায়ের গোরালীসহ শরীরের ৯টি গুলী লাগে। নিহত ফারুকের বাবার নাম মোবারক উল্লাহ। তিনি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট। ১৯৮৩ সালে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। এরপর ঠিকাদারী ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। বড় ছেলের নামে প্রতিষ্ঠানের নাম রাখেন আরমান ট্রেডার্স। পুলিশ বলছে, ঠিকাদারী নিয়ে বিরোধের বিষয়টিও তারা খতিয়ে দেখছেন। ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ৪৫৫/১ মানিকদিকে তাদের পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে ফারুক সবার বড়। ১৯৯৮-৯৯ সেশনে সরকারি তিতুমীর কলেজ থেকে ডিগ্রী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। এরপর মাস্টার্সে ভর্তি হলেও ফাইনাল পরীক্ষা দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন ভাই কামরুল। ফারুকের ছোট ভাই ইমরুল হাসান স্পেনে থাকেন। ২০০৩ সালে প্রেম ও পারিবারিকভাবে স্থানীয় এক তরুণীর সঙ্গে বিয়ে হয়। প্রায় দুই বছর পরে তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ওদিকে লাশের ময়না তদন্ত শেষে গতকাল বেলা ১১টায় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ফারুকের নামাজের জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। দুপুরের পর তার লাশ নেয়া হয় যে মাঠে খুন করা হয় সেই মানিকদি আদর্শ বিদ্যানিকেতন স্কুল মাঠে। সেখানে বাদ আছর তার ২য় নামাজের জানাযা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়। ফারুক খুনের ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের আহবানে গতকাল মানিকদিতে ধর্মঘট পালন করা হয়। এ সময় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। দোকানপাট বন্ধ ছিল সাময়িক। মানিকদি এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ-র্যা ব মোতায়েন করা হয়েছে। দিনভর আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠন মানিকদিতে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করে।