ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে বুধবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ (রাবি) বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বের করা মিছিলে হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। চবি ক্যাম্পাসে বাম সংগঠনগুলোর জোট প্রগতিশীল ছাত্রজোটের মিছিলে দু’দফা হামলা চালায় ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এতে পাঁচজন আহত হন। রাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিলে তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। সিলেটের এমসি কলেজে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সমাবেশে হামলা করেছে ছাত্রলীগ। এতে ১৩ নেতাকর্মী আহত হন। এদিকে ঢাবি ক্যাম্পাসের মঙ্গলবার ঘটনায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দিয়েছে ছাত্রলীগ ও বাম ছাত্র সংগঠন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচারসহ চার দফা দাবিতে ২৯ সেপ্টেম্বর সারা দেশে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট ডেকেছে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট। অন্যদিকে ঢাবি উপাচার্যকে লাঞ্ছিত ও কার্যালয়ের গেট ভাংচুর, নারী নিপীড়কদের শাস্তিসহ পাঁচ দফা দাবিতে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে ছাত্রলীগ।
চবি প্রতিনিধি জানান, দুপুরে চবি কেন্দ্রীয় পাঠাগারের সামনে বাম সংগঠনগুলোর জোট প্রগতিশীল ছাত্রজোটের মিছিলে ছাত্রলীগের ক্যাডারদের দুই দফা হামলায় পাঁচজন আহত হয়েছেন। তারা হলেন- আইরিন সুলতানা, ফজলে রাব্বী, কাউসার রিজু, ধীমান চাকমা ও প্রত্যয় নাফাক। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) হয়ে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে মিছিল এলে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা অতর্কিত হামলা চালিয়ে তা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে পাঁচজন নেতাকর্মী আহত হন। তবে হামলার ঘটনা অস্বীকার করে ছাত্রলীগ নেতাদের দাবি, প্রগতিশীল ছাত্রজোটের মিছিল থেকে সরকারবিরোধী ও উস্কানিমূলক স্লোগান আসছিল, সেটির প্রতিবাদ জানাতে গেলে তাদের সঙ্গে ঝামেলা হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ধীমান চাকমা বলেন, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অতর্কিত হামলা চালিয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হন। বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে জানিয়ে বিচার দাবি করেছি। প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, তাদের মিছিলে ছাত্রলীগ নেতা ফারুখ, মিজানুর রহমান মিজান, তৌহিদুল ইসলাম জিমেল, নিশাদ, জুয়েলসহ বেশ কয়েকজনের নেতৃত্বে হামলা হয়েছে। এ ব্যাপারে মিজান বলেন, প্রগতিশীল জোটের নেতাকর্মীরা উস্কানিমূলক স্লোগান দিচ্ছিল, ছাত্রলীগের নেতারা তাদের প্রতিহত করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর লিটন মিত্র বলেন, প্রগতিশীল ছাত্রজোটের মিছিলে হামলা করার অভিযোগ পেয়েছি। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে আহত অবস্থায় একজনকে উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠিয়েছি।
রাবি প্রতিনিধি জানান, দুপুর ১২টার দিকে রাবি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনের রাস্তার একপাশে সমাবেশ করে প্রগতিশীল ছাত্রজোটের নেতাকর্মীরা। রাবি শাখা ছাত্রলীগের মিছিলটি সমাবেশের সামনে আসে। ছাত্রলীগের মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক ফেরদৌস মো. শ্রাবণ এ সময় প্রগতিশীল ছাত্রজোটের কর্মসূচির ব্যানার ধরে থাকা ছাত্র ফেডারেশনের নেতা সুব্রত কর্মকারকে ধাক্কা দেয়। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি লিটন দাসকেও এ সময় ধাক্কা দেয়া হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া ও সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুর নেতৃত্বে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নবীন শিক্ষার্থীদের অভ্যর্থনা জানিয়ে মিছিল বের করে। মিছিলটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে এলে সেখানে অবস্থানরত সমাবেশকারীদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়। পরে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের দলীয় টেন্টে গিয়ে সমাবেশ করে। কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি আবদুল মজিদ অন্তর বলেন, মিছিলের জন্য তাদের রাস্তা ছেড়ে দিই। কিন্তু তারা আমাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এতে আমরা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাইনি। তারা গায়ে পড়ে ঝামেলা করার জন্য এটা করেছে।
রাবি ছাত্রলীগের সভাপতি গোলাম কিবরিয়া বলেন, আমাদের মিছিল এমনিতেই অনেক বড় হয়। আর ঘটনাস্থলে রাস্তাটাও অনেক সরু ছিল। তাই একটু ধাক্কা হতেই পারে। তাছাড়া ইচ্ছাকৃতভাবে কিছুই করা হয়নি।
ঢাবি প্রতিনিধি জানান, ঢাবি ক্যাম্পাসে মঙ্গলবার ছাত্রলীগ ও বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। বুধবার ঢাবি ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করে ছাত্রলীগ এবং বাম ছাত্র সংগঠনগুলো। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে ছাত্রলীগ এবং ‘প্রগতিশীল ছাত্র জোট ও নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে বাম ছাত্র সংগঠন সমর্থিত আন্দোলনকারীরা কর্মসূচি পালন করে। দাবি আদায়ে ভিসি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ। আর মধুর ক্যান্টিনে পৃথক দুটি সংবাদ সম্মেলন করে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল করে বাম সমর্থিতরা।
দুপুর ১টার দিকে ৪ দফা দাবিতে মধুর ক্যান্টিনে সংবাদ সম্মেলন করে বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট। প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সমন্বয়ক ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের সভাপতি ইমরান হাবিব রুমন লিখিত বক্তব্য তুলে ধরেন। জোটের চার দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- মঙ্গলবার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেফতার ও বিচার, ১৫ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতনের সঙ্গে যুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও মামলা প্রত্যাহার, আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ব্যয় প্রশাসনকে বহন করা এবং অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেয়া। প্রগতিশীল ছাত্রজোটের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ঐক্য ফোরাম, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন ও বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর নেতারা। ৪ দফা দাবি আদায়ে ২৯ জানুয়ারি সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট আহ্বান করেছে সংগঠনগুলো। এছাড়া শুক্রবার ঢাবি ক্যাম্পাসের রাজু ভাস্কর্যে সংহতি সমাবেশ এবং রোববার সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন তারা। জোটের সমন্বয়ক রুমন বলেন, ডাকসু নির্বাচন বানচাল করতে বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে।
মধুর ক্যান্টিনে ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করেন আন্দোলনকারীরা। তাদের পক্ষ থেকে চার দফা দাবি তুলে ধরেন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা সামান্তা শারমিন। লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, যে কোনো আন্দোলনকে বিতর্কিত করার এক ভালো কৌশল হলো শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আবিষ্কার করা। এটা ছাত্রলীগের দীর্ঘদিনের কৌশল। তিনি বলেন, এ কারণে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে ছাত্রলীগকে আমরা কখনও বড় কর্মসূচি নিতে দেখি না। তিনি আরও বলেন, হলগুলো ছাত্রলীগের জিম্মায় ছেড়ে দিয়েছে প্রশাসন। বেশির ভাগ ছাত্র ছাত্রলীগকে পছন্দ না করলেও বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের জোরপূর্বক নিয়ে যাওয়া হয়। যখন দরকার পড়ে বা নিজেদের প্রয়োজনে তাদের ব্যবহার করে এবং পরবর্তীকালে দায় এড়ানোর কৌশল হিসেবে ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’ তত্ত্ব দাঁড় করায়।
বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাঁচ দফা দাবিতে উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগের সহস াধিক নেতাকর্মী। এ সময় তাদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটি, সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেয়।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানারে ওই আন্দোলন থেকে দাবি পূরণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়া হয়। পাঁচ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্যের ওপর হামলাকারী ও লাঞ্ছনাকারী এবং উপাচার্যের কার্যালয় ভাংচুরকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবিলম্বে বহিষ্কার; সাধারণ শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগের ওপর হামলাকারী ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী, তানভীর আহমেদ মুঈন, বেনজীর, তুহিন কান্তি, সাদিক রেজা, তমা, সুদীপ্ত, সালমান, ইভা, তমা শাকিল, ইরা, সোহেল রিফাত, সিদ্দীকী, জামিল, মিথিলাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার ও গ্রেফতার; প্রক্টর অফিস ভাংচুরকারী এবং প্রক্টর অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর হামলাকারীদের বহিষ্কার; ঢাবি অফিসিয়াল ক্যামেরা ভাংচুরকারী এবং ক্যামেরাম্যান ও উপাচার্য অফিসের কর্মচারীর ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি; ঢাবির শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশকে যারা নষ্ট করতে চায় তাদের অবিলম্বে শাস্তির আওতায় আনা। সভায় ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বলা হয়, আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে লাঞ্ছিত ও তার কার্যালয়ের গেট ভাংচুর, নারী নিপীড়কদের শাস্তিসহ ৫ দফা দাবি মেনে নিতে হবে।
ঢাবি সাদাদলের উদ্বেগ ও নিন্দা : ক্যাম্পাসে সাম্প্রতিক ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ঢাবির বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত শিক্ষকদের সাদাদল। বুধবার সাদাদলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেন খান এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। বিবৃতিতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ধারাবাহিকভাবে সংঘটিত সহিংস ঘটনাবলীতে আমরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন ও ক্ষুব্ধ।