প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে খুনাখুনির ঘটনা। লাশ মিলছে রাস্তা, ঝোপ-ঝাড়, নদী, নালা-ডোবায়। দেশের বিভিন্ন স্থানের মতো রাজধানীতেও বাড়ছে হত্যাকা-। চলতি বছরের প্রথম ৫ মাসে (জানুয়ারি থেকে মে) রাজধানীতে হত্যাকা-ের শিকার হন ৮৪ জন। ২০১৬ সালের একই সময়ে এ সংখ্যা ছিল ৬৬। গত মে মাসেই রাজধানীতে খুন হয়েছেন ২০ জন। খোদ ঢাকা মহানগর পুলিশের হত্যা মামলার পরিসংখ্যান দিচ্ছে এ তথ্য।
অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্প্রতি পেশাদার অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠায় বেড়ে গেছে খুনের ঘটনা। একটির রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটছে আরেকটি খুনের ঘটনা। ঘটছে টার্গেট কিলিংও। খুনের শিকার হচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। রেহাই পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদ্যরাও। দু-একটি ঘটনায় খুনিদের কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও অধরাই থাকছেন নেপথ্যের কারিগররা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার শিথিলতা এবং মাঠপর্যায়ে পুলিশি তৎপরতায় ভাটা পড়ার কারণেই খুনের ঘটনা বেড়েছে। এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বৃদ্ধি করা না হলে ঈদের আগে-পরে রাজধানীতে আরও হত্যার ঘটনা ঘটতে পারে বলে অভিমত তাদের।
বেসরকারি একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাব মতে, চলতি মাসের গত ২৩ দিনে রাজধানীতে হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন অন্তত ১৫ জন। সে হিসাবে প্রায় প্রতিদিনই একজন করে খুন হচ্ছে রাজধানীতে। চলতি মাসের শুরুতেই (১ জুন) রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে ছিনতাইকারীর হাতে খুন হন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীর আলম। গতকাল শুক্রবার বিকালে মোহাম্মদপুরে নুরজাহান রোডের একটি বাড়ির রিজার্ভ ট্যাংকি থেকে উদ্ধার হয় নিখোঁজ ফার্মেসি ব্যাবসায়ী সৈয়দ হাসান আলী শামীমের লাশ। নিহতের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার ভাই রজ্জবের দাবি, হাসান হত্যাকা-ের শিকার। গত বুধবার সকালে রূপনগরের বিরুলিয়া ব্রিজের কিছু দূরে মেলে হাইওয়ে পুলিশের এএসপি মো. মিজানুর রহমান তালুকদারের ক্ষতবিক্ষত লাশ।
নৃশংস এ হত্যাকা-ের মোটিভ শনাক্তে এখনো অন্ধকারে পুলিশ। তাদের প্রাথমিক ধারণা, ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে খুনের শিকার হয়েছেন তিনি। তবে শত্রুতাবশত পরিকল্পিত হত্যাকা-ের বিষয়টিও মাথায় রেখে তদন্ত কার্যক্রম চালাচ্ছে ডিবি পুলিশ। ইতোমধ্যে লাশ উদ্ধারের স্থলের কাছাকাছি এবং এএসপি মিজানের উত্তরার বাসা সংলগ্ন বিভিন্ন সড়কের পাশে বাসাবাড়ি ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় থাকা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসিটিভি) ফুজেট সংগ্রহ করেছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে রাতের আঁধারের কারণে সিসিটিভিতে ধারণ হওয়া দৃশ্য অনেকটাই অস্পষ্ট বলে গতকাল আমাদের সময়কে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা। লাশের সঙ্গে পাওয়া আলামত (নিহতের মুজা, গলায় জড়ানো কাপড়ের টুকরা, পোশাক, ব্যাগ ও প্যান্টসহ যাবতীয় কিছু) পরীক্ষার জন্য আজ শনিবার সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানোর কথা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে গত বুধবার এএসপি মিজানুর রহমান হত্যার কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে শাহবাগের মৎস্য ভবনের সামনে ছিনতাইকারীদের প্রাইভেট কারের চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হন সজীব নামে এক ব্যবসায়ী। যাওয়ার আগে খুনিরা নিহতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয় ৮ হাজার টাকা। গত বৃহস্পতিবার উত্তর বাড্ডায় খুন হন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী নাসরিন খাতুন। মঙ্গলবার গভীর রাতে পূর্ব নাখালপাড়ায় হত্যা করা হয় আব্দুল আজিজ নামে এক বৃদ্ধকে। ১০ জুন গুলশান-২ এ খুন হন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় (আইএলও) কর্মরত ভারতীয় এক কর্মকর্তার বাসার গৃহকর্মী রানী বেগম। ৯ জুন ভাটারার নয়ানগর এলাকার একটি ভবনের নিচতলায় গলাকাটা অবস্থায় মেলে শাহীন আলম নামে এক ব্যবসায়ীর লাশ। ৮ জুন গভীর রাতে তুরাগের কামারপাড়ার কালিয়ারটেক এলাকায় একটি ঘর থেকে উদ্ধার করা হয় রেহানা পারভীন নামে এক গৃহবধূ ও তার তিন সন্তানের লাশ। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, পরিকল্পিত হত্যাকা-ের শিকার তারা।
এ ছাড়া গত ২৭ মে ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকায় রাস্তা থেকে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। একই দিন চকবাজারের পূর্ব ইসলামবাগ এলাকায় ছুরিকাঘাতে খুন করা হয় আ. কাইয়ুম নামে এক চা দোকানিকে। ২০ মে চকবাজারের পোস্তা এলাকায় হত্যাকা-ের শিকার হয় আকসারা নামে ৭ বছরের এক শিশু। ১৯ মে যাত্রাবাড়ীর কাজলায় খুন হয় জাহিদুল ইসলাম নামে এক কিশোর। ১৮ মে খিলগাঁওয়ের খিদমা হাসপাতালের পাশ থেকে ২৬ বছর বয়সী অচেনা এক যুবকের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৫ মে পল্লবীর মিরপুর-১২ কালাপানি মাঠ এলাকায় ছুরিকাঘাতে খুন হন হেলেনা আক্তার নামে এক গৃহবধূ।
এ ছাড়া চলতি বছরের গত ১৭৩ দিনে রাজধানী সংলগ্ন বুড়িগঙ্গা নদী থেকে অন্তত ২০টি লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। কোনো কোনো লাশের হাত-পা ছিল বাঁধা অবস্থায়। এদের কারো কারো পরিচয় শনাক্ত করা গেলেও অনেকের পরিচয় এখনো মেলেনি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, আসন্ন ঈদে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা ও প্রতিরোধ করতে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী সব জায়গায় সক্রিয় রয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর নিজস্ব পরিকল্পনার মাধ্যমে ঢাকা শহরসহ অন্য সব জায়গায় সিকিউর করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। আমাদের ভ্রাম্যমাণ পুলিশ ও চেকপোস্টগুলো সতর্ক অবস্থানে থাকবে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক গত বৃহস্পতিবার বলেন, ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে সারা দেশে নিñিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ঈদ ঘিরে এ বছর চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, অজ্ঞান-মলম পার্টির দৌরাত্ম্য, বিভিন্ন ধরনের প্রতারণা নেই বললেই চলে। আশা করি সারা দেশে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয় ছিন্ন করে কোনো নাশকতা ঘটানো সম্ভব হবে না।