আহমদ আশিকুল হামিদ : গত সপ্তাহের নিবন্ধে ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির আসন্ন বাংলাদেশ সফর নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বাংলাদেশের এক দেশ তথা ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতির ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে আবারও একই ভারতকে টেনে আনায় কেউ কেউ অবাক হতে পারেন। কিন্তু এরও পেছনে বিশেষ কারণ রয়েছে। বড় কথা, সে কারণও ভারতই তৈরি করেছে। পাঠকদের নিশ্চয়ই মনে পড়বে, ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পিলখানায় দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের হত্যাকান্ডের পরপর সবার আগে ভারতীয়রা দৃশ্যপটে এসেছিলেন। ভারতের মিডিয়া তখন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর তথ্যযুদ্ধ শুরু করেছিল। ভারতের নানা পর্যায়ের পন্ডিতরা সে সময় বিভিন্ন আবিষ্কারের তথ্য জানিয়েছিলেন। নিজেদের মনের মতো করে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও হাজির করেছিলেন তারা। বলেছিলেন, বিডিআরের কথিত বিদ্রোহ সফল হলে নাকি ‘ডানপন্থী’ বিএনপি ও ‘ইসলামিস্ট’ জামায়াতে ইসলামীর জোট ক্ষমতায় ফিরে আসতো! বিডিআর বিদ্রোহের ‘ষড়যন্ত্র’ নাকি সে উদ্দেশ্যেই তৈরি করা হয়েছিল এবং ষড়যন্ত্রের নাকি দীর্ঘমেয়াদী ‘গেম প্ল্যান’ও ছিল!
অতি সম্প্রতিও নতুন করে ভারতের সে পন্ডিতদেরই কয়েকজনকে দৃশ্যপটে দেখা গেছে। আবিষ্কারের কথা এবং ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণও তারা যথেষ্টই শুনিয়ে চলেছেন। এদের একজন ভাস্কর রায়- যার আসল পরিচিতি হলো, তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা র-এর একজন শীর্ষস্থানীয় গবেষক ও নীতিনির্ধারক। দ্বিতীয় জন ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক ও কূটনীতিক কুলদিপ নায়ার। কথিত ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পরপর দৃশ্যপটে এসেছেন তারা। র-এর মুখপত্র ‘সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ ২৪ জানুয়ারি ও ১ ফেব্রুয়ারি ‘টেরোরিজম অ্যান্ড ফান্ডামেন্টালিজম হন্ট বাংলাদেশ’ এবং ‘ফয়েল্ড বাংলা ক্যু- ম্যানি টার্গেটস টু এ সিঙ্গেল গোল’ শিরোনামে প্রকাশিত দুটি নিবন্ধের সারকথায় ভাস্কর রায় বলেছেন, এবারও নাকি বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতা দখল করার লক্ষ্য নিয়েই অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছে। বিএনপিও নাকি জামায়াতের মতো ‘ইসলামিস্ট’ একটি দল এবং জামায়াতের নাকি হিজবুত তাহরীরসহ বিভিন্ন ইসলামপন্থী শ’ দেড়েক সন্ত্রাসী গ্রুপ ও দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে! এসব গ্রুপ ও দলকে দিয়েই নাকি সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। দৈনিক ‘আমার দেশ’, জামায়াতের দুটি পত্রিকা (দৈনিক ‘সংগ্রাম’ ও ‘নয়া দিগন্ত’?) এবং টিভি চ্যানেল ‘দিগন্ত’ নাকি অভ্যুত্থান চেষ্টাকে সমর্থন যুগিয়ে এসেছে। ভাস্কর রায়ের অভিমত, চারদলীয় জোট সরকারের আমলে মাদরাসা ছাত্রদের ব্যাপকভাবে সেনাবাহিনীতে ঢোকানো হয়েছিল এবং তারাই অভ্যুত্থান চেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছে! ওদিকে ‘গাল্ফ নিউজ’-এর ২৮ জানুয়ারি সংখ্যার বিশেষ নিবন্ধে কুলদিপ নায়ারও একই সুরে বলেছেন, শেখ হাসিনার সরকার ইসলামী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে বলেই সেনাবাহিনীর ভেতরে ধর্মান্ধ ইসলামিস্টরা অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছিলেন। মিস্টার নায়ারের মতে ব্যর্থ অভ্যুত্থান দিল্লীর জন্য সতর্কবার্তা হিসেবে এসেছে এবং দিল্লীর উচিত বাংলাদেশের জনগণকে জানিয়ে দেয়া, শেখ হাসিনাকে রক্ষার জন্য দিল্লী ‘যেকোনো সীমা পর্যন্ত’ পদক্ষেপ নেবে। অর্থাৎ প্রয়োজনে সেনাবাহিনী পাঠিয়ে হলেও শেখ হাসিনাকে রক্ষা করবে।
পন্ডিত নামধারীরা শুধু নন, ভারত সরকারও যে একই মনোভাব পোষণ করে সে সম্পর্কে জানা গেছে কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারের খবরে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নজীরবিহীন সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে কথিত ব্যর্থ অভ্যুত্থানের খবর রটিয়ে দেয়ার পরপর ২১ জানুয়ারি আনন্দবাজার জানিয়েছে, এবার শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ঢাকা-দিল্লীর মধ্যে যে ‘মৈত্রীর পরিবেশ’ তৈরি হয়েছে তাকে ‘ভেস্তে’ দেয়াটাই নাকি কথিত ব্যর্থ অভ্যুত্থানের লক্ষ্য ছিল। দু’দেশের গোয়েন্দারাই নাকি জানিয়েছে, বিএনপি, জামায়াত ও হিজবুত তাহরীর ‘একজোট’ হয়ে কাজ করেছে। তাদের আসল লক্ষ্য নাকি ছিল নয়াদিল্লী। আনন্দবাজার আরো জানিয়েছে, শেখ হাসিনা ক’দিন আগে ত্রিপুরা ঘুরে যাওয়ার পর যখন ‘আস্থাবর্ধক’ আরও অনেক পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে তখন হাসিনা সরকারের অবস্থান যাতে কোনোভাবেই দুর্বল না হয়ে পড়ে সেজন্য ‘স্পষ্ট ও কড়া অবস্থান’ নেয়ার এবং শেখ হাসিনাকে ‘সব রকম’ সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। সেই ‘বার্তা’ ঢাকার সরকারকেও জানিয়ে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপও যে নেয়া হয়েছিল সে সম্পর্কে জানা গেছে ভারতের প্রভাবশালী সাময়িকী ‘ইন্ডিয়া টুডে’র এক বিশেষ রিপোর্টে। ‘ঢাকা কন্সপিরেসি’ শিরোনামের এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান চেষ্টার কথা ভারত ডিসেম্বরেই শেখ হাসিনাকে জানিয়ে দিয়েছিল। ভারত এই সাথে পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরায় হেলিকপ্টার তৈরি রেখেছিল। উদ্দেশ্য ছিল সত্যি অভ্যুত্থান সংঘটিত হলে শেখ হাসিনাসহ মন্ত্রী ও নেতাদের ভারতে নিয়ে আসা। ‘ইন্ডিয়া টুডে’র রিপোর্টে অন্য একটি গুরুতর তথ্যও জানানো হয়েছে। তথ্যটি হলো, ‘এমআই’ তথা মিলিটারি ইন্টেলিজেন্স নামের একটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশে তৎপর রয়েছে এবং ‘এমআই’-এর পক্ষ থেকেই শেখ হাসিনাকে খবর দেয়া হয়েছিল। বলা দরকার, এতদিন শুধু ‘র’-এর তৎপরতা সম্পর্কে জানা যেতো। এবার জানা গেলো, ‘র’-এর পাশাপাশি ‘এমআই’ নামের আরো একটি গোয়েন্দা সংস্থাও বাংলাদেশে তৎপরতা চালাচ্ছে। সংস্থাটি যে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর মধ্যেও তৎপর রয়েছে সে কথা নিশ্চয়ই পৃথকভাবে উল্লেখ করার প্রয়োজন পড়ে না।
এসব তথ্য এবং কথিত ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানসহ সামগ্রিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই প্রণব মুখার্জির আসন্ন সফরকে কেন্দ্র করে নতুন পর্যায়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। কারণ, মাস পাঁচেক আগে, গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তখনও দু’ দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে প্রচারণা যথেষ্টই চালানো হয়েছিল। অন্যদিকে বাংলাদেশের ভাগ্যে প্রাপ্তিযোগ বলতে তেমন কিছুই ঘটেনি। তা সত্ত্বেও ক্ষমতাসীনরা কিন্তু গালগল্প শেষ করার নাম করেননি। কোনো কোনো বিশেষজন তো একথা পর্যন্ত বলেছিলেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্যে ‘গাত্রদাহ’ হচ্ছে বলেই নাকি বিরোধী দলগুলো ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতির সমালোচনা করছে! বলা বাহুল্য, পর্যালোচনা কিন্তু এ ধরনের বক্তব্য ও দাবিকে মোটেও সমর্থন করে না।
আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রনীতি যে ভারতমুখী হবে এ সম্পর্কে জানা রয়েছে সাধারণ মানুষেরও। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনো কোনো মহলের ধারণা ছিল, নিজেদের বুকে ও পিঠে লেগে যাওয়া ভারতপন্থী পরিচিতির দুর্নাম কাটিয়ে ওঠার স্বার্থে হলেও শেখ হাসিনারা এবার অন্তত একটু রয়ে-সয়ে পা বাড়াবেন। অন্যদিকে ঘটে চলেছে উল্টোটা। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যখন একথা বলার সুযোগই নেই যে, বাংলাদেশের স্বাধীন দেশসুলভ নিজস্ব কোনো পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে। কথাটা আরো একবার প্রমাণিত হয়েছে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ওই সফরকালে। এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রচারণা চালিয়ে আসার পরও আওয়ামী লীগ সরকার তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে ভারতকে দিয়ে স্বাক্ষর করাতে পারেনি। অজুহাত হিসেবে ভারতীয়রা হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিকে সামনে এনেছিলেন। ভারতের জাতীয় স্বার্থে ‘বাঙালি’ নেত্রী মমতা ব্যানার্জিও ঘাড় বাঁকিয়ে বসার কৌশল নিয়েছেন। ফলে ‘ভেস্তে’ গেছে বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তি।
ওদিকে তিস্তা চুক্তি থেকে পিছিয়ে গেলেও ভারত কিন্তু নিজেরটা কড়ায়-গন্ডায় আদায় করে নিয়েছে। অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু ‘ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট’ বা কাঠামোগত চুক্তির পর্যালোচনায় দেখা যাবে এর মাধ্যমে বাংলাদেশকে আসলে সর্বাত্মকভাবেই ভারতের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে। এই চুক্তি ১৯৭২ সালের ২৫ বছর মেয়াদী চুক্তির চাইতেও ভয়াবহ। আগের চুক্তিতে তবু ২৫ বছরের মেয়াদ ছিল, যার পর চুক্তি বহাল রাখার বা না রাখার অধিকার পেয়েছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এবারের চুক্তিতে কোনো মেয়াদের উল্লেখ নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশ কখনো এই চুক্তি বাতিল বা অকার্যকর করার সুযোগ পাবে না। সে অধিকারই চুক্তিতে দেয়া হয়নি। চুক্তিটিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সামরিক সকল দিক থেকেই বাংলাদেশকে গোলামির জিঞ্জিরে বেঁধে ফেলেছে ভারত। এই চুক্তির শর্তানুযায়ী ভারতের অভ্যন্তরীণ সকল বিষয়েও বাংলাদেশকে ভারতের পক্ষে ভূমিকা পালন করতে হবে। দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধ্বংস করে দেয়ার প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে এমনকি সামরিকভাবেও জড়িয়ে পড়তে হবে। যার ফলে বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর যুদ্ধ চলে আসবে বাংলাদেশের ভেতরে।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রেও ভারতকে অনুসরণ করতে হবে। এমন কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক রাখতে ও বাণিজ্যসহ দ্বিপাক্ষিক ভিত্তিতে লেনদেন করতে পারবে না যার সঙ্গে ভারতের শত্রুতা রয়েছে। বিষয়টি গুরুত্ব অর্জন করেছে বিশেষ করে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে। এখানে ঐতিহাসিক দু-একটি তথ্য স্মরণ করা দরকার। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের কোনো সমরাস্ত্র পেতে পারেনি। সমর্থন দেয়ার সুযোগ নিয়ে যুদ্ধের পরপর ভারতের সেনারা পাকিস্তানীদের সমুদয় সমরাস্ত্র লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামী জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর হিসাবে এসব সমরাস্ত্রের দাম ছিল প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর ফলে সামরিক শক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছিল। সশস্ত্র বাহিনীর হাতে কোনো অস্ত্রই ছিল না। অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছিল ১৯৭৫-এর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর। বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল গণচীন। বস্তুত গণচীনের আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী। গাজীপুরে অবস্থিত সমরাস্ত্র কারখানায় অস্ত্র তৈরির মাধ্যমে তো বটেই, রফতানির পথেও গণচীনই বাংলাদেশকে অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দিয়ে চলেছে। ট্যাংক থেকে যুদ্ধবিমান পর্যন্ত বাংলাদেশের ৯০ শতাংশেরও বেশি সমরাস্ত্র এসেছে গণচীন থেকে। বর্তমান সময়েও বেশ কিছু অত্যাধুনিক ট্যাংক এবং জঙ্গি বিমানসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পাইপলাইনে রয়েছে। অর্থাৎ গণচীনের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করার কথা কল্পনা করাও সম্ভব নয়।
এমন বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বলা যায়, ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট বা কাঠামোগত চুক্তির ফলে চীনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত সুসম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হবে। কারণ, সরকারের এই ভারতপ্রীতিকে চীন সহজভাবে নাও নিতে পারে। চীন ও ভারতের দ্বনদ্বমূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তো বটেই, নিজের সমরাস্ত্রের গোপনীয়তা রক্ষার ব্যাপারে চীনের সতর্কতাও একটি বড় কারণ হয়ে উঠবে। চীন ভাবতেই পারে, এত যেখানে ঘনিষ্ঠতা সেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে ভারত চীনের সামরিক প্রযুক্তি চালান করে নিয়ে যাবে- যা চীনের মতো পারমাণবিক শক্তিধর একটি রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এর ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কে অবনতি ঘটতে পারে, চীন এমনকি সামরিক সহযোগিতা বন্ধও করতে পারে। তেমন অবস্থায় বাংলাদেশকে সম্পূর্ণরূপেই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে- যার অর্থ, বাংলাদেশের আসলে যুদ্ধ করার ক্ষমতাই থাকবে না। এমন অবস্থা ভারতের অধীনস্থ হয়ে পড়ার নামান্তর মাত্র।
সীমান্ত সমস্যার সমাধানের ব্যাপারেও আওয়ামী লীগ সরকারের ভূমিকা দেশের জন্য ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে। মনমোহন সিং-এর সফরকালে অমীমাংসিত ও অপদখলীয় ভূমি উদ্ধারের ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়েছে বলে যে কল্পকাহিনী সরকার শুনিয়েছে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো রকম। যেমন বাংলাদেশকে মাত্র ৩৫৭ একর জমি দিয়ে আসাম পেয়ে গেছে ১২৩৯ একর জমি। এজন্য এবং উলফাসহ আসামের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা ও সমর্থনের জন্য শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ। বাংলাদেশ সংলগ্ন ভারতের আরেক রাজ্য মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী ড. মুকুল সাংমাও বাংলাদেশকে মাত্র ৪১ একর জমি দেয়ার বিনিময়ে ২৪০ একর পাওয়ায় শেখ হাসিনাকে ‘ধন্যবাদ’ জানিয়েছেন! ওদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর ও চুয়াডাঙ্গা জেলার সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশীদের হাজার হাজার একর জমির মালিকানা নিত্তি না করেই বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করছে। এভাবেই সীমান্ত সমস্যার ‘সমাধান’ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার! উল্লেখ্য, বাংলাদেশ জমি হস্তান্তর করে ফেললেও ছিটমহল বিনিময়ের ব্যাপারে হাসিনা-মনমোহন চুক্তিতে মমতা ব্যানার্জী কিন্তু এখনও সম্মতি দেননি। প্রধান বিরোধী দল বিজেপিরও আপত্তি রয়েছে। কারণ জানাতে গিয়ে ২৬ জানুয়ারি আনন্দবাজার লিখেছে, চুক্তিতে বলা হয়েছে, বিনিময় প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশকে বাড়তি জমি দিতে হলে ভারত আপত্তি করবে না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কোনো জমি দিতে মমতা একেবারেই রাজি নন। এজন্যই হাসিনা-মনমোহন চুক্তির ওপর এখনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার ‘সিলমোহর’ পড়েনি।
সরকার সবচেয়ে নোংরা মিথ্যাচার করেছে ট্রানজিটের আড়ালে ভারতকে করিডোর দেয়ার প্রশ্নে। তিস্তা চুক্তি না করার কারণে ট্রানজিট (আসলে করিডোর) চুক্তি করেনি বলে গর্ব করলেও বাস্তবে ভারতীয় যানবাহন ইতোমধ্যেই চলাচল শুরু করেছে। গাড়িগুলোও আবার একশ-দেড়শ চাকার। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে ইতোমধ্যে ভারতীয় মালামাল পরিবহনের নির্দেশ দিয়েছে। অর্থাৎ প্রকাশ না করা হলেও সরকার ভারতকে করিডোর দিয়ে ফেলেছে। সব মিলিয়ে অবস্থা এমন হয়েছে যখন নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মনমোহন সিং-এর সফরের সময় শেখ হাসিনা কিছুই অর্জন করতে পারেননি। বিশেষ করে তিস্তা চুক্তি করতে না পারাটা ছিল এক শোচনীয় ব্যর্থতা। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা শুনিয়েছিলেন উল্টো কথা। বলেছিলেন, তিস্তা চুক্তি না হওয়ায় বাংলাদেশ নাকি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। প্রশ্ন উঠেছিল, ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হতে হলে আর কতভাবে ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হতে হবে? ক্ষমতাসীনদের অন্য একটি কথায়ও হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছিল। তারা বলেছিলেন, সরকার ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতি’তে বিশ্বাস করে না বলেই নাকি তিস্তা চুক্তি করেনি! অন্যদিকে সব মন্ত্রীকে গ্যালারিতে বসিয়ে রেখে এবং দু’জন মাত্র ‘সুপার উপদেষ্টা’র হাতে সবকিছু ছেড়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা কিন্তু প্রমাণ করেছিলেন, ভারতের স্বার্থ হাসিল করে দেয়ার শর্তেই তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। তাকে তাই এখন কৃতজ্ঞতার দায় শোধ করতে হচ্ছে।
এভাবে সংক্ষিপ্ত পর্যলোচনায়ও পরিষ্কার হয়ে যাবে, আওয়ামী মহাজোট সরকার আসলে সর্বতোভাবে ভারতের স্বার্থেই ভূমিকা পালন করে চলেছে। এজন্য সরকার এমন সব পদক্ষেপই নিচ্ছে, যেগুলো এমনকি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্বের জন্যও বিপজ্জনক। সরকারের এই নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণে ভারতও বাংলাদেশকে সামান্য ‘গণনায়’ পর্যন্ত আনছে না। দেশপ্রেমিকরা উদ্বিগ্ন এজন্য যে, এবারের আওয়ামী লীগ সরকার আসলেও বাংলাদেশের নাড়ি ধরে টান দিয়েছে। বিপন্ন করে ফেলেছে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে।