প্রায় কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপর নির্বিচারে গুলী চালাচ্ছে। প্রায় প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের হত্যা করা হচ্ছে। ২৫ সেপ্টেন্বর ঝিনাইদহের মহেশপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলীতে রাজু আহমেদ (২৫) নামে বাংলাদেশী এক গরুর রাখাল নিহত হয়েছেন। রাজু আহমেদ চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার ধানখোলা গ্রামের জাকির হোসেনের ছেলে। সীমান্তে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের নোনাগঞ্জ ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা তাকে লক্ষ্য করে গুলী চালায়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে।
৬ এপ্রিল ভারতীয় বিএসএফ ৬ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে। সিলেটের গোয়াইনঘাটে এক বাংলাদেশীর প্রাণ হারিয়েছেন। সীমান্ত এলাকার বাড়ি ঘর তছনছ করে দিচ্ছে। ভারতীয় বাহিনীর নির্যাতনে কত বাংলাদেশী মানুষ আহত হয়ে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। শুধু পত্রিকার পাতায় আসে যেটুকু, আসে তার হিসাবটা রাখে দেশ প্রেমিক দু-একটা মানবাধিকার সংগঠন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের হিসেব মতে, ২০১২ সালে ৩৬ বাংলাদেশীকে বিএসএফ বা ভারতীয়রা হত্যা করেছে। ৯০টি ঘটনায় ৯৮ জনকে গুলীতে অথবা পিটিয়ে আহত করেছে। ৬৪ জনকে অপহরণ করা হয়েছে।
বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহম্মদ গত ২২ জানুযারি যশোরে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, ২০১৩ সালে বিএসএফের হাতে ৩৮ বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। আইন শালিস কেন্দ্রের কেন্দ্রে হিসেব মতে, ২০১৩ সালে ৮৩ বাংলাদেশীকে আহত করা হয়েছে। ২১৫ জনকে অপহরণ করা হয়েছে; কিন্তু ১২৯ জনের কোনো খবর পাওয়া যায়নি বা নিখোঁজ রয়েছেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৪ সালের মে পর্যন্ত ২৫২ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ। এ সময় আহত হয়েছে বিএসএফের হাতে ৪০৬ জন। এতে পতাকা বৈঠক হয়েছে ২ হাজার ২২০টি। মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্যমতে, ২০০০ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফ এবং ভারতীয় সন্ত্রাসীদের হাতে ১ হাজার ৪৭ বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। এর সাথে ২০১৩ সাল এবং চলতি বছরের প্রথম তিন মাস হিসেব করলে দেখা যায়, বিগত ১৪ বছরে সীমান্তে ১ হাজার ১০০ বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়েছে।
এই হত্যা, নির্যাতন এখন ও অব্যাহত রয়েছে। এখন বাংলাদেশে প্রবেশ করে বিজিবি জুলুম নির্যাতন চালাচ্ছে। বর্তমান সরকারের ভারত তোষণনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নতজানু মানসিকতা সীমান্ত হত্যার কোনো প্রতিবাদ হচ্ছে না। মুক্তিযুদ্ধে মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করায় দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্থান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটানের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক উপরে। আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক অনুজ্জ্বল দেশগুলোর সীমান্তে বিএসএফের আগ্রাসীনীতি এবং বেপরোয়া আচরণ করার সাহস দেখাতে পারে না। অথচ বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান উল্টো। সীমান্তে হত্যাকান্ড এবং যখন তখন বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে জুলুম নির্যাতন ঘটিয়ে চলেছে প্রতিবেশী দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীরা। অথচ প্রতিবাদ প্রতিকার নেই।
প্রতিবাদ প্রতিকার যেন পতাকা বৈঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। অপহরণ করা হয় অহরহ। অপহরণের পর অহরহ ফেরত আসার নজির রয়েছে। অনেকে নির্যাতন করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সরকারের মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এসব নির্যাতনের পক্ষে সাফাই গেয়ে বক্তব্য দেন। দুই বছর আগে কুড়িগ্রাম সীমান্তে বিএসএফের হাতে ফেলানী হত্যাকা- নিয়ে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয় তোলপাড় হয়। বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি বাড়াবার জন্য ভারত ঢাকঢোল পেটায়। কিন্তু বিচার হয় মুসিব প্রসবের মতো লোক দেখানো। ফেলানীর কাঁটাতারের ঝুলন্ত লাশ বিশ্বের পভাবশালী মিডিয়াগুলো প্রচার হলেও সেটা যেন মিথ্যে হয়ে যায়। আবার ও ফেলানীর বিচারের নামে নাটক চলছে। অপরাধীরা হয়ে যান নিরপরাধ। বাংলাদেশ নিয়ে প্রতিবাদ এবং নতুন করে বিচারের দাবি ওঠে। কিন্তু নতুন করে বিচার হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
২০১১ সালে ১৭ ডিসেন্বর ৪ জনকে বিএসএফ কর্তৃক গুলী করে হত্যা করা হয়। পরদিন ১৮ ডিসেন্বর জৈন্তাপুর সীমতান্তে আর এক বাংলাদেশীকে একই কায়দায় হত্যা করা হয়। ২০১২ সালের ৪ জানুয়ারি বিএসএফ জাফলং সীমান্তে এবং মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল সীমান্তে দুই বাংলাদেশীকে হত্যা করে। একই দিনে লালমনিরহাটে একজনকে নির্যাতন করে আহত করে। ১২ জানুয়ারি কলারোয়া সীমান্তে এক বাংলাদেশীকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে বিএসএফ। ১৯ জানুয়ারি জাতীয় দৈনিকগুলোয় দেখা যায়, নির্যাতনের আর বীভৎস চিত্র। চাঁপাইনবাবগঞ্জে এক যুবককে ধরে উলঙ্গ করে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়। এমন নির্যাতন করায় মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানায়। ২১ জানুয়ারি আরও এক বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়। একই দিকে বিজিবির এক হাবিলদারকে অপহরণ করা হয়। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় বিজিবির হাবিলদারকে ফেরত দেয় বিএসএফ।
এত নির্যাতনের মধ্যে ২৫ জানুয়ারি সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত হয় সীমান্তে বাংলাদেশীদের হত্যাকা-ের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন নয় সংসদীয় কমিটি। অথচ একই দিনে ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে বলা হয়, বাংলাদেশ সীমান্তে নির্যাতন ও হত্যাকা-ের জন্য নয়াদিল্লীকে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়া উচিত। সংসদীয় কমিটির উক্তির পরদিন আরো দুই বাংলাদেশী বিএসএফের গুলীতে নিহত হন। ভারত বাংলাদেশ প্রতিটি সরকার পর্যায়ের বৈঠকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় সীমান্তে আর গুলী চালানো হবে না। কিন্তু বেঠক শেষ হতে না হতে আরেকজন নিহত হন। ভারতীয় কর্তাব্যক্তিরা একের পর আমাদের কর্তাব্যক্তিদের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। তবে বিএসএফ মাঝে মাঝে গুলী চালান না। পাথর ছুড়ে বা পানিতে চুবিয়ে বাংলাদেশীদের হত্যা করে থাকে।
২০১২ সারের ৮ ফেব্রুয়ারি বিএসএফ সাফ জানিয়ে দিলেন সীমান্তে গুলী চলবে। তাদের মনের কথাটা অকপটে বললেন বিএসএফ প্রধান। এর আগে স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, সীমান্ত হত্যা নিয়ে রাষ্ট্র উদ্বিগ্ন নয়। গুলী অতীতে হয়েছে এখন ও হচ্ছে এবং ভবিষ্যতে হবে। সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় নিরাপত্তা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা সহজে অনুমেয়। এ সরকারের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, পৃথিবীর সব সমিান্তে এ ধরনের হত্যাকান্ড ঘটে। এ সরকারের মন্ত্রীরা সীমান্ত হত্যাকে আর উস্কে দিচ্ছে। নানা অনুসন্ধ্যান ও গবেষণায় দেখা গেছে, একমাত্র ইসরাঈল আর ফিলিস্তিন ছাড়া আর কোথাও সীমান্ত হত্যাকান্ডের নজির নেই।
এমনকি ভারতের সাথে অন্য পাঁচ রাষ্ট্রযথাÑ চীন, পাকিস্থান, ভুটান, নেপাল, সীমান্তে ও কোনো হত্যাকা- ঘটে না। বিএসএফ এই ৫ দেশের সীমান্তে প্রতিবেশী নাগরিকদের ওপর গুলী চালায় না। বরং ইসরাইলের চেয়ে বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বেশি হত্যাকা- চালায় ভারতীয় বিএসএফ। আমাদের ঘিরে রয়েছে ভারতের সীমান্ত। ভারত নামক সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাংলাদেশ নামক ভুখ-টি অবরুদ্ধ করে ফেলেছে। কাঁটাতারের বেড়ার পর তৈরি করেছে রিং রোড। এসব রিং রোড দিয়ে ভারতীয় যান সীমান্ত পাহারায় নিয়োজিত। নিরাপত্তার জন্য তাদের একটি বিরাট কৌশল। বিপরীতে বাংলাদেশের সীমান্তে পাহারা দেয়ার কোনো রাস্তা নেই। কাদামাটি মাড়িয়ে ধান ক্ষেতের আইল দিয়ে হেটে সীমান্ত টহল দিতে হয় বিজিবিকে।
কোথাও কোথাও ভারতের সীমান্ত পাহারার জন্য ১০টি সীমান্তরক্ষী ক্যাম্পের বিপরীতে রয়েছে একটি ক্যাম্প। ভারতের তুলনায় পর্যাপ্ত সামরিক উপকরণ নেই সীমান্ত পাহারাদার বাহিনীর কাছে। এছাড়া সীমান্ত পাহারাদার বাহিনীর আবাসিক সমস্যা প্রকট। তবে সম্মুখ আক্রমণে কখন ও বিডিআরকে পরাজিত করতে পারত না ভারতীয় বিএসএফ। সেই বিডিআর আজ আর নেই। বিডিআরের ধ্বংসস্তূপে নাম পরিবর্তন করে বাংলাধেশ বর্ডারগার্ড (বিজিপি) বা বাংলাদেশ সীমান্ত পাহারাদার বাহিনী গঠন করা হয়েছে। পরিবর্তন করা হয়েছে এ বাহিনীর পোশাক। আমাদের মন্ত্রীরা ঘোষণা করলেন, বিজিবিকে সীমান্ত রক্ষায় বিএসএফ প্রশিক্ষণ দেবে। বিডিআর হত্যাকা-ের পর সে বাহিনীর নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান ঘোষণা দিয়েছিলেন, বিডিআর-বিএসএফ মিলে আমাদের সীমান্ত পাহারা দেবে। বিডিআর প্রধানের এরকম বক্তব্য আমাদের ভাবিয়ে না তুলে পারে না। সম্প্রতি আগ্রাসী তৎপরতা নতুন করে যোগ হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ভারত সীমান্তরেখা পেরিয়ে জোর করে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
অতিসম্পতি মৌলভীবাজার জেলার ৩০০ একর জমি নেয়ার জন্য পুরনো কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে বাংলাদেশ ভূখ- দখল করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯৪৭ সালের আগে বাংলাদেশীরা এ ভূখ-টি ব্যবহার করেছে এ দেশের মানুষ। ভারত নতুন করে জায়গাটি দখলে নিতে চায়। ভারত সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত পুরো এলাকায় কারফিউ জারি করে রাখে। কোনো কোনো স্থানে কাঁটাতারে বিদ্যু সংযোগ দেয়া আছে। এছাড়া ভারত ফেনসিডির ঠেলে দিচ্ছে এপারে। এজন্য মাঝে মাঝে সীমান্ত গেট খুলে দেয়। সীমান্তের কাছে ফেনসিডিল কারখানার অবস্থান। বাংলাদেশীদের জন্য এ ফেনসিডির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক ও গবেষক
সংগ্রাম