শহীদুল ইসলাম :
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও নাগরিক কর্তৃক ২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সালের ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত মোট ১৪৬ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। দশম সংসদের দশম অধিবেশনে গত সোমবার বিকেলে প্রশ্নোত্তর পর্বে সিলেট-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ উস সামাদ চৌধুরীর এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী সংসদকে এ তথ্য জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, এর মধ্যে বিএসএফ কর্তৃক ১০৯ জন এবং ভারতীয় নাগরিক কর্তৃক ৩৭ জনকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বিগত ২০১৪, ২০১৫ এবং চলতি বছর বিজিবি’র হাতে আটক যথাক্রমে ২০৯, ১৭৪ ও ৪০ জন ভারতীয় নাগরিককে বিএসএফ এর হাতে হস্তান্তর করার কথা উল্লেখ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই তথ্য হলো সরকারি ভাষ্য। প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। অর্থাৎ পরিসংখ্যানটা আরো লম্বা।
ভারত এই অঞ্চলের একটি বড় দেশ। তার সাথে বাংলাদেশ ছাড়াও সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমার, চীন, ভুটান, নেপাল, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও শ্রীলংকার। এর প্রতিটি দেশের সাথেই সীমান্ত উন্মুক্ত। বরং বাংলাদেশ সীমান্তেই সর্বাধিক কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। সেই হিসেবে বাংলাদেশ সীমান্তেই হত্যাকাণ্ড সবচেয়ে কম হওয়ার কথা। কিন্তু পরিসংখ্যানে দেখা যায় তার উল্টো। পাকিস্তানকে বলা হয় ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও চিরশত্রু রাষ্ট্র। সুতরাং পাকিস্তান সীমান্তেই বিএসএফের হাতে সর্বাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটার কথা। তাই পাকিস্তানের সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যানই তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ভারতের সাথে অন্য যেসব দেশের সীমান্ত আছে সেসব দেশের নাগরিক বিএসএফের হাতে মারা যাওয়ার কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। বাংলাদেশী নাগরিকদেরকেই তারা পাখির মতো গুলী করে নির্বিচারে হত্যা করছে। বিএসএফের টার্গেটই যেন বাংলাদেশীরা। অন্য কোন দেশের নাগরিককে তারা এভাবে হত্যা করে না। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো- অবৈধ অনুপ্রবেশ ঘটলে ভারতীয় নাগরিকদের হস্তান্তর করা হয়েছে বিএসএফের কাছে। অন্যদিকে বাংলাদেশীদের তারা দেখামাত্র গুলী করে হত্যা করে।
পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, সর্বাধিক হত্যাকাণ্ড ঘটছে বাংলাদেশ সীমান্তে। সীমান্তে তুলানামূলকভাবে পাকিস্তানী নাগরিকদের চেয়ে বিএসএফ-এর হাতে বাংলাদেশী নাগরিকদের নিহত হওয়ার সংখ্যা অনেক বেশি। ২০১৪ সালে বিএসএফ-এর হাতে ৩৩ জন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন। একই সময়ে পাক-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে ৯ জন পাকিস্তানী নাগরিক নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশ সীমান্তে যারা নিহত হয়েছেন তারা বেসামরিক নাগরিক। কিন্তু পাক-ভারত সীমান্তে নিহত পাকিস্তানি নাগরিকদের একটি অংশ সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য। ২০১৫ সালে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বেড়েছে আরও বেশি। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এভাবে বেসামরিক নাগরিক হত্যাকাণ্ড বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন উভয় দেশের মানবাধিকার নেতারা।
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে গত তিন বছরে বিএসএফ-এর হাতে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা বেড়েছে। আর এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে গুলী ও নির্যাতনে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করে বিএসএফ সদস্যরা। তাদের মধ্যে ১২ জনকে গুলী করে এবং ১৪ জনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশীকে। এরমধ্যে গুলী ও নির্যাতনে সমানসংখ্যক বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালে হত্যা করা হয়েছে ৪৬ জনকে। এদের মধ্যে ৩২ জনকে গুলী এবং ১৪ জনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়।
অন্যদিকে, ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত হত্যার তথ্য পাওয়া যায় উইকিপিডিয়ায়। তারা নিয়মিত এই ঘটনা হালনাগাদ করে। উইকি’র হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে ১৫ জন পাকিস্তানী নাগরিক নিহত হয়েছেন। ২০১৪ সালে ৯ জন এবং ২০১৫ সালে ২২ জন পাকিস্তানী নাগরিক নিহত হয়েছেন। এই সীমান্তে পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতেও প্রায় সম পরিমাণ ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন।
এ তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে নিহত বাংলাদেশী নাগরিকের সংখ্যা এ পর্যন্ত একশ’র বেশী। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হিসেবেই চার বছরে ১৪৬ জন। একই সময়ে পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে শুধু ৪৬ জন পাকিস্তানী নাগরিক নিহত হয়েছেন। নিহত পাকিস্তানী নাগরিকদের বড় একটি অংশ সামরিক এবং আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য। আর বাংলাদেশের নিহত নাগরিকরা সবাই নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ।
পরিসংখ্যানের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ভারতের মানবাধিকার সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)-এর প্রধান কিরীটি রায় বলেন, ‘আমাদের পরিসংখ্যান বলছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে যত হত্যাকাণ্ড ঘটে পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা তার চেয়ে অনেক কম। শুধু তাই নয় ভারতীয় নাগরিকরাও বিএসএফ-এর হাতে নিহত হচ্ছেন। গত এক বছরে বাংলাদেশ সংলগ্ন পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে ২৫ জন ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন। এরা বাঙালি। আর পুরো সীমান্তের হিসাব করলে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি হবে।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র আর পাকিস্তান ভারতের শত্রু রাষ্ট্র। কিন্তু সীমান্ত হত্যার পরিসংখ্যান তা বলে না। বন্ধু রাষ্ট্রের নাগরিকদের কি এভাবে হত্যা করা যায়? আর বাংলাদেশী যেসব নাগরিককে হত্যা করা হয় তারা নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ। তাদের গুলী করাই তো বেআইনি।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিচালক নূর খান বলেন, ‘এতদিন গরু চোরাচালানকে সীমান্ত হত্যার কারণ হিসেবে বলা হতো। কিন্তু এখন তো গরু চোরাচালান বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়। তারপরও সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যা বাড়ছে। আসলে সীমান্ত হত্যার পেছনে আসল কারণ হল ভারতের মনোভাব। ভারত কাশ্মীরসহ পাকিস্তান সীমান্তে নিয়োজিত বিএসএফ সদস্যদের এখনও ঘুরিয়ে আবার বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়োগ করে। তাদের অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী নয়। তাদের মনোভাব যুদ্ধংদেহি। ফলে পরিস্থিতির কোনও উন্নতি হচ্ছে না।’
২০১১ সালে বিএসএফ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধ পথে সীমান্ত পার হওয়া নাগরিকদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তি করে। আর ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকেও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হয় বারবার। কিন্তু সীমান্তে বিএসএফ প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার বন্ধ করেনি। পাল্টায়নি তাদের আচরণ।
পাকিস্তান ভারতের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ও বৈরী রাষ্ট্র। বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানের সাথে তাদের সীমান্ত দৈর্ঘ্যও অনেক বেশী। অথচ সীমান্তে তুলানামূলকভাবে পাকিস্তানী নাগরিকদের চেয়ে বিএসএফ-এর হাতে বাংলাদেশী নাগরিকদের নিহত হওয়ার সংখ্যা বেশি। সম্প্রতি একটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট মতে, ২০১৪ সালে যেখানে বিএসএফ-এর হাতে ৩৩ জন বাংলাদেশী নাগরিক নিহত হয়েছেন। সেখানে পাক-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে ৯ জন পাকিস্তানী নাগরিক নিহত হয়েছেন। পত্রিকাটির তথ্যমতে ২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ এই তিন বছরে বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ এর হাতে নিহত হয়েছে ১০০ জন, আর একই সময়ে পাকিস্তান সীমান্তে বিএসএফ এর হাতে নিহত হয়েছে ৪৬ জন পাকিস্তানী নাগরিক।