সাংবাদিক নির্যাতন

সংবাদপত্রকে একটা দেশের দর্পণ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই সংবাদপত্র চেক এন্ড ব্যালেন্সের কাজ করে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই আমাদের সংবিধানে ব্যাপারে স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু এই মহাজোট সরকার আসার পর বিভিন্ন সময় এরা সংবাদকর্মীদের উপর চড়াও হয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগ ছিলো এসব ব্যাপারে বেপরোয়া। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করায় বা করার জন্য সংবাদ সংগ্রহের উদ্যোগ নিলেই ছাত্রলীগ বিভিন্ন সময় তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বড় বড় প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময়ে তারা সাংবাদিকদের মারধর, লাঞ্চিত, ক্যামেরা ভাংচুর, এমন কি হত্যাও করেছে। এ ধরনের অপরাধের জন্য বিভিন্ন সময় দল আবার কখনো কখনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বহিষ্কৃত হয়েছে ছাত্রলীগের বিভিন্ন নেতাকর্মী। গত পাঁচ বছরের প্রথম আলো ও যুগান্তরের রিপোর্ট গবেষণা করে দেখা গেছে, ছাত্রলীগের হাতে বিভিন্ন সময় হামলা, মামলা, লাঞ্চনাসহ সাংবাদিক মারধরের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৫০ টি। আর এতে আহত হয়েছেন প্রায় ৬০-৭০ জন এবং নিহত হয়ছেন ১ জন। এছাড়া আগুন,ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ২০ টি। এ রকম অপকর্মের জন্য বিভিন্ন সময় বহিস্কৃত হয়েছেন অন্তত ৫০-৬০ জন নেতাকর্মী।

২০১৩ সালে নয়াদিগন্ত অফিসে আক্রমণের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগের সাংবাদিক নির্যাতন শুরু হয়। অফিস ভাংচুর ও নির্বাহী সম্পাদক এতে আহত হন। এপ্রিলে হামলার শিকার হোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার সাংবাদিক। পহেলা বৈশাখের নামে চাঁদাবাজি করার সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়ায় তাদের উপর হামলা করা হয়। মে মাসের ২৮ তারিখে লাঞ্চনার স্বীকার হোন এম সি কলেজ সাংবাদিক। এ সময় তার ক্যামেরা ভাংচুর করা হয়। আর জুলাইতে চবির সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয় ছাত্রলীগ।

২০১৪ সালে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রলীগ নামধারী ইন্টার্নদের মারধরের শিকার হোন চার সাংবাদিক। এছাড়াও বাকৃবিতে ছাত্রলীগ সভাপতি সাংবাদিকদের দেখে নেয়ার হুমকি দেন এপ্রিলে। এ বছরে সাংবাদিকদের উপর আক্রমণের সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটে জুলাইতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ সাংবাদিককে কোপিয়ে জখম করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। নভেম্বরে ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে নরসিংদিতে মানববন্ধন করে ঐ জেলার সাংবাদিকরা। এপ্রিল ১৪, ২০১৫ তারিখে বৈশাখী অনুষ্ঠান থেকে ফেরার পথে ছাত্রীদের ইভটিজিং করায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শাখা ছাত্রলীগের কর্মী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ৭ম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাজমুলকে গণধোলাই দেয় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনার ছবি তোলায় ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে বাংলা ট্রিবিউনের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি লাঞ্ছিত হন।

১৪ জুন ২০১৫ তারিখে রাবি যুগান্তর প্রতিনিধিকে হুমকি দেয় ছাত্রলীগ নেতা। ৫ ই আগস্ট সাংবাদিক হামলার দায়ে বহিষ্কৃত হন জগন্নাত বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকর্মী। ২১ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে, শাহবাগে ঢাকা জেলা পুলিশের এএসপি মশিউর রহমান ও ছাত্রলীগ কর্মী আতিকুল বাশার দুই সংবাদ কর্মীকে মারধর করেন। এ সময় দুই সংবাদ কর্মী তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করছিলেন। আর মদ্যপ অবস্থায় বেসামাল ছিলেন এএসপি মশিউর ও ছাত্রলীগ কর্মী বাশার। আহত দুই সংবাদ কর্মী হলেন- বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এশিয়ান টিভির সিনিয়র রিপোর্টার নুরে আলম ও ক্যামেরাপারসন দিদার হোসেন।

২০১৬ সাল ছিলো সাংবাদিক নির্যাতনের অন্যতম একটা বছর। জানুয়ারি মাসের ১৯ তারিখেই মাগুরার সাংবাদিককে কুপিয়ে জখম করে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা। ১৭ ফেব্র“য়ারীতে ছাত্রলীগ নেতার হাতে আহত হন প্রথম আলোর আলোকচিত্রী। ২ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় পত্রিকার কার্যালয়ে আক্রমণ করে ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। এছাড়া আগস্টে চবিতে ৩ ছাত্রলীগ বহিস্কৃত হয় সাংবাদিক নির্যাতনের দায়ে। অক্টোবরে জাবিতেও একি কারণে বহিস্কৃত হোন ৩ ছাত্রলীগ কর্মী।

২ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ তে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় মাথায় গুলিবিদ্ধ সমকাল-এর শাহজাদপুর প্রতিনিধি আবদুল হাকিম (শিমুল) ৩ তারিখ শুক্রবারে মারা গেছেন। এ খবর শুনে তাঁর নানি রোকেয়া বেগমও মারা যান।এছাড়া ১৭ জানুয়ারীতে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় এটিএন বাংলার সাংবাদিকের মোটরগাড়ীসহ ৭ টি গাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে জুলাইতে বাকৃবিতে সাংবাদিকতায় না জড়ানো হুমকি দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের। একই মাসে জগন্নাতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় সাংবাদিকসহ ৫ জন আহত হন। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের ভাংচুরের ছবি তুলায় সাংবাদিককে মারধর করা হয়। ২৯ সে জুলাইতে হামলার প্রতিবাদে মানববন্ধন করে সাংবাদিকরা।

২০১৮ সালেও ছাত্রলীগ তাদের নির্যাতন থেকে সাংবাদিকদের ইস্তফা দেন নাই। বিশেষ করে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে নিউজ কাভার দিতে গিয়ে সাংবাদিকরা নির্মম নির্যাতনের শিকার হোন সাংবাদিকরা। এছাড়া সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানের উপর ছাত্রলীগের হামলা ছিলো ন্যাক্কারজনক। কোটা আন্দোলনের নিউজ কাভার করতে যেয়ে এপ্রিল মাসের বিভিন্ন সময়ে ঢাবি, শেবাকৃবি, জাবি, জবিতে অন্তত ১০ জন সাংবাদিক আহত হয়। অন্যদিকে, আগস্ট মাসে ঢাকায় সড়ক আন্দোলনের নিউজ সংগ্রহের জন্য কর্তব্যরত সাংবাদিকের উপর ছাত্রলীগ চড়াও হয়। এতে অন্তত ১০ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে জখম হোন। সাংবাদিক নির্যাতনের সর্বশেষ শিকার নভেম্বরের ১৭ তারিখ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক।

সংবাদপত্রকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়। যদি সংবাদপত্র তাদের কাজ ঠিকমত চালাতে না পারে তাহলে কোন রাষ্ট্রের পক্ষেই পৃথিবীর বুকে মাথা উচু দাঁড়ানো সম্ভব না। এভাবে সংবাদকর্মী ও সংবাদমাধ্যমের উপর আঘাত মানেই হচ্ছে দেশের অগ্রযাত্রাকে স্থিমিত করে দেয়া। তাই সরকারের ছাত্রসংঠন হিসেবে ছাত্রলীগের কাছ থেকে এমন সন্ত্রাসী কার্যক্রম কখনোই কাম্য নয়।

সাংবাদিক নির্যাতন

সাংবাদিক নির্যাতন

সাংবাদিক নির্যাতন

সাংবাদিক নির্যাতন

সাংবাদিক নির্যাতন

সাংবাদিক নির্যাতন