“ছাত্রলীগের হত্যার এক দশক”
ছাত্রলীগ যেন একটি সব্যসাচী দল। যাদের কাছে খুন, রগ কাটা, নির্যাতন একটি সহজ ও রুটিন কাজে পরিণত হয়েছে। জাতীয় পত্রিকা ও গণমাধ্যমগুলোর রিপোর্টে এমন চিত্রই ফুটে উঠেছে। দৈনিক প্রথম আলো, যুগান্তর ও সাপ্তাহিক সোনার বাংলার রিপোর্ট ও কেস স্টাডিতে দেখা যায় গত এক দশকে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ একাই খুন করেছে অন্তত ১৮৪ জনকে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ঘৃণিত জঙ্গি সংগঠনসমূহের টোটাল স্টুডেন্টস হত্যা, এমনকি জঙ্গিদের হাতে সাধারণ মানুষ হত্যার হার, সংঘর্ষের হার ও হতাহতের হারকে ছাত্রলীগ ছাড়িয়ে গেছে মাত্র এক দশকেই।
প্রতি বছরেই তারা খুন করেছে প্রায় ১৮ জনকে। প্রকাশ্যে বিশ্বজিৎ হত্যাকান্ড, ঢাবির মেধাবী ছাত্র আবু বকর হত্যাকান্ডে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। তাছাড়া ২০১০ সালে বরিশাল পলিটেকনিকে দু’পক্ষের সংঘর্ষের সময় নজরুল ইসলামকে ধরে রেখে চুরি দিয়ে মুহুর্মুহু কোপানির দৃশ্য মানুষের মনে বীভৎসতার নতুন চিত্র তুলে ধরে। তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি শিশু ও সাংবাদিকও। ছাত্রলীগ নেতা তপুর নির্দেশে এসপি ফজলুল করিমকে হত্যা করা হয়।
ছাত্র সংগঠনটি শিক্ষা ও প্রগতির পথ ছেড়ে রুপান্তরিত হয় কিলিং মিশিনে। দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টে দেখা যায়, ২০০৯-২০১৪ সালের ২১ নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ বছরে সংঘর্ষ হয় অন্তত ৪৩২ টি, আহত হয় ১ হাজার ৫শতাদিকেরও বেশি। প্রথম পাঁচ বছরে খুন হয়েছে ৫৫ জন, কিন্তু পরবর্তী ৫ বছরে খুন হয় ১২৯ জন; যা প্রথম ৫বছেরর খুনের সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি।
দ্যা ডেইলি স্টার বাংলার রিপোর্টে দেখা যায় প্রথম আট বছরে ছাত্রলীগ হত্যা করে ১২৫ জনেরও বেশি। শুধু ২০১৮ সালেই ছাত্রলীগ হত্যা করে ৩১ জনকে(নভেম্বর পর্যন্ত)। প্রথম পাঁচ বছরের আহত(১,৫০০’র অধিক) ও সংঘর্ষের সংখ্যা দেখে বুঝা যায় শেষ পাঁচ বছরে আহত ও সংঘর্ষের সংখ্যা কেমন হতে পারে; যেখানে খুন হয়েছে দ্বিগুণের বেশি।
কেন খুনোখুনি করে ছাত্রলীগ?
পত্রিকাসমূহের রিপোর্ট ও কেস স্টাডিতে উঠে আসে এসব হত্যার পিছনে রয়েছে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার, দলীয় কোন্দল, মাদকাসক্তি, অস্ত্রবাজি, পদের লোভ ও নারীঘটিত সমস্যা। হত্যাকান্ডের বিচারে না হওয়া আর হলেও প্রকৃত অপরাধীদের যথোপযুক্ত শাস্তি না হওয়ায় তাদের খুনের পরিমাণ দিনদিন বেড়েই চলেছে। প্রথম আলোর তথ্যমতে, শুধু ২০১৮ সালের ২৬শে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসেই তারা হত্যা করেছে ৩১ জনকে। সাধারণ মানুষের মনে এখন প্রশ্ন জেগেছে আর কত খুন হলে, আর কত স্বজন হারালে ছাত্রলীগকে জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নত করে নিষিদ্ধ করা হবে।
প্রথম আলোর কেস স্টাডিতে উঠে আসে ছাত্রলীগের হত্যাকাণ্ড ও অন্তকোন্দলের ঘটনায় একশরও বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে বারে বারে; শিক্ষার সুস্থ পরিবেশ ব্যহত হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহে।
কিছু আলোচিত হত্যাকাণ্ড
২০০৯ সালের ১৩ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানীকে হত্যার মধ্যে দিয়ে ছাত্রলীগ খুনের যাত্রা শুরু করে, ৮ ফেব্রুয়ারি চবিতে দুই শিবিরকর্মী মুজাহিদ ও মাসুদকে, ৩১ মার্চ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ওরফে রাজীবকে খুন করে ছাত্রলীগ। এছাড়া ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রমৈত্রীর সহ-সভাপতি রেজানুল ইসলাম চৌধুরী, ৮ জানুয়ারি জাবির ছাত্রলীগ কর্মী জুবায়ের আহমেদকে, ২১ জানুয়ারি পাবনা টেক্সটাইল কলেজের ছাত্রলীগ কর্মী মোস্তফা কামাল শান্ত, ৮ ফেব্র“য়ারি (ছাত্রলীগের দাবি) ফারুক হোসেন, ১১ ফেব্রুয়ারি রাবির মহিউদ্দিন, ২৮ মার্চ হারুন অর রশিদ কায়সার, ১৫ এপ্রিল আসাদুজ্জামান, ১৫ আগস্ট নাসিম এবং ১৬ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী সোহেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ-পুলিশের সংঘর্ষে নির্মমভাবে খুন হন নিরীহ ও মেধাবী ছাত্র আবু বকর। ১২ জুলাই সিলেট এমসি কলেজে ছাত্রলীগ কর্মী পলাশকে খুন করে।
২০১৪ সালের ৪ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক রুস্তম আলী আকন্দ নিজ কক্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এই ছাত্র পরবর্তী সম্মেলনে সংগঠনের ওই হল শাখার সভাপতি পদপ্রার্থী ছিলেন। অভিযোগ রয়েছে, পদ নিয়ে সংগঠনের নেতা-কর্মীদের অন্তঃকোন্দলেই প্রাণ হারান তিনি। এ হত্যাকাণ্ডের বহু বছর পেরিয়ে গেলেও হত্যায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ।
২০১০ সালের ১৫ আগস্ট ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ মখদুম হলের তিনতলার ছাদ থেকে ফেলে দেওয়া হলে ছাত্রলীগ নেতা নাসিরুল্লাহ নাসিম মারা যান।
২০১৪ সালের ১৪ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে কুপিয়ে হত্যা করা হয় যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাঈমুল ইসলামকে। ঘটনায় জড়িত থাকায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই হত্যার বিচার তো দূরের কথা অভিযোগ পত্রই তৈরি করতে পারেনি পুলিশ।
২০১৪ বছরের ৩১ আগস্ট ঢাকায় সমাবেশ শেষ করে ফেরার পথে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয় চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা তৌকির ইসলামকে। আসনে বসা নিয়ে বিবাদের সূত্র ধরে সাতকানিয়া ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী তাঁকে ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দেন। তাঁকে টঙ্গীর নিমতলী থেকে উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পর মারা যান তৌকির। এ ঘটনায় কোনো মামলা পর্যন্ত হয়নি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নিজেদের সংঘর্ষে প্রথম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ওই বছরের ৩০ মার্চ। ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিহত হন কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ। অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় কলেজ। কিন্তু ওই ঘটনারও কোনো সুরাহা হয়নি।
এ ছাড়া ২০১০ সালের ১২ জুলাই সিলেট এম সি কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী উদয়েন্দু সিংহকে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের একটি অংশ। একই বছরের ১৯ জুলাই রাজধানীর গোড়ানে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হন ছাত্রলীগের নেতা আলী রেজা। ২০১১ সালের ৯ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের কর্মী জুবায়ের আহমেদ একই সংগঠনের কর্মীদের হামলায় নিহত হন। ২০১২ সালের ১৬ জুলাই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগের নেতা আবদুলাহ আল হাসান সোহেল মারা যান।
ছাত্রলীগের হত্যাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হত্যাকাণ্ড ছিল প্রকাশ্যে মিডিয়ার সামনে কুপিয়ে বিশ্বজিৎ হত্যা। রাজনীতি যে এত নিষ্ঠুর, মানুষ যে এত নৃশংস এবং একটি ছাত্রসংগঠন যে এমন দানব হতে পারে, তা ভাবলেও গা শিউরে ওঠে। বিশ্বজিৎ দাস নামের যে যুবকটি রোববার ভোরে বাসা থেকে নিজের কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন, তিনি কি ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করছিলেন, মৃত্যুদূত তাঁর সামনে অপেক্ষা করে আছে। আর সেই মৃত্যুদূতের নাম ছাত্রলীগ। ছাত্রলীগ নামধারী কতিপয় দুর্বৃত্ত তাঁকে পিটিয়ে, কুপিয়ে পুরো শরীর রক্তাক্ত করে হত্যা করেছে। রক্তে পুরো শরীর, জামাকাপড় ভেসে যাচ্ছে, তিনি করজোড়ে ক্ষমা চাইছেন, বারবার বলছেন, ‘আমি রাজনীতি করি না, আমি ছাত্রদল বা শিবির করি না, আমি হিন্দু। আমি দরজিখানায় কাজ করি।’ কিন্তু ছাত্রলীগের বীর পুঙ্গবেরা তাঁকে ক্ষমা করেনি। সর্বশক্তি নিয়ে তাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যখন যুবকটি তাদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে কাছের হাসপাতালে যেতে চাইলেন তাতেও তারা বাদ সাধল। ওরা তাঁকে চিকিৎসাও নিতে দেবে না।
এই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে দেশের মানুষ ভেবেছিলো এই হত্যার হয়তো সঠিক বিচার হবে। ছাত্রলীগের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে শুধু এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছিলো। কিন্তু হাসিনা সরকার বিচারালয়কে ব্যবহার করে সমস্ত ছাত্রলীগের খুনীদের সাজা মওকুফ করে নিয়েছে। যাদের সাজা হয়েছে তারা সবাই পলাতক। নামে পলাতক হলেও তারা আসলে পলাতক নয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে পুলিশ তাদের এরেস্ট করছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু বকর হত্যার ঘটনা ঘটে ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। সেদিন এফ রহমান হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু বকর নিহত হন। বহু বছর পেরিয়ে গেলেও ওই ঘটনার বিচার হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিলেও বিচার পায়নি আবু বকরের পরিবার।
বকরের বাবা রুস্তম আলী (৭০) আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা মারামারি করল, তারা ক্লাস করে, রাজনীতি করে। কিন্তু আমার সোনার ছেলে মইর্যা গেল, কোনো বিচার নাই। আমি একটা দিনমজুর। আমার জজ-ব্যারিস্টার, এমপি-মিনিস্টার নাই। আমি ক্যামনে তাদের সাথে পারমু?’
২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেট এলাকায় একটি ভবনের দ্বিতীয় তলার ভাড়া বাসা থেকে দিয়াজের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। সেদিন বাসায় দিয়াজ ছাড়া পরিবারের আর কেউ ছিল না।
ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের দিয়াজ গ্রুপের প্রধান দিয়াজ ইরফান চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৫ কোটি টাকার টেন্ডারের বলি হয়েছেন!
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরী আত্মহত্যা করেননি, তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে—দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল রোববার বিকেলে প্রথম আলোকে এ কথা বলেছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পুলিশ সুপার মো. হুমায়ুন কবির।