পদ বাণিজ্য

ছাত্রলীগের পদ বাণিজ্য

ছাত্রলীগে পদ পেতে হলে নেতাদের সন্তুষ্ট করতে হবে। আর নেতাদের সন্তুষ্ট করতে লাগবে টাকা। এভাবে টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগে পদ পাওয়া একেবারেই স্বাভাবিক ও নিয়মিত ঘটনা। এখানেও যেসব স্থানে পদ বাণিজ্য করতে গিয়ে সংঘর্ষ হয়েছে সেসব ঘটনাই কেবল পত্র-পত্রিকায় এসেছে।

অনেকেই টাকা বিনিয়োগ করে ছাত্রলীগের পদ-পদবি পেতে চায় কারণ ছাত্রলীগ পদ পাওয়া এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে লাভজনক পেশা। ছাত্রলীগের ছোটখাটো নেতা, ওয়ার্ড বা ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাদের মাসিক আয় ক্ষেত্রভেদে ২ থেকে ৫ লক্ষ টাকা। এলাকার সব ধরনের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, টেন্ডার পাওয়া এবং যারা ঠিকাদারি কাজ করছে তাদের থেকে মোটা অংকের টাকা নেয়া এগুলো নৈমিত্তিক ব্যাপার। ক্যাম্পাসগুলোতে ভর্তি বাণিজ্যতো আছেই।

তাছাড়া এদেশে জন্মলগ্ন থেকেই ছাত্রলীগ খাবার হোটেল, ক্যান্টিনে কখনোই বিল দেয় না। এদেশে সবগুলো হোটেলে ছাত্রলীগের জন্য খাবার ফ্রি। এটা একধরণের নিয়মে পরিণত হয়েছে। শুধু খাবার নয় একটু প্রভাবশালী হলে থাকার জন্য ফ্ল্যাট, যে কোন শপিং করা সবই ফ্রি হয়ে যায়। ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতাদের কাছ থেকে টাকা চাইবে এই স্পর্ধা বাংলাদেশে গত দশবছর কেউ দেখাতে পারে নি।

‘ছাত্রলীগ হলেই ধনী’ এই শিরোনামে ১২ সালের ২১ ডিসেম্বর বাংলানিউজ২৪ এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ছাত্রলীগ `সোনার ডিম পাড়া হাঁস`। ছাত্রলীগের নেতৃত্ব যেন এক জাদুর কাঠি, যার ছোঁয়ায় ছাত্রনেতারা রাতারাতি বিত্তশালী বনে যান। ছাত্ররাজনীতিকে পুঁজি করে অনেক ছাত্র নেতাই আজ রীতিমতো কোটিপতি। তাই অনেকেই চায় টাকা বিনিয়োগ করে পদ বাগিয়ে নিতে।

১৪ জানুয়ারি ২০১৮ সালে পূর্ব-পশ্চিমবিডিতে নরসিংদীর বাণিজ্যের ঘটনা উঠে এসেছে। ২ লাখ টাকার বিনিময়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন শীর্ষ নেতার নাম ভাঙিয়ে পদ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এহেসানুল ইসলাম রিমনের বিরুদ্ধে। নবগঠিত মনোহরদী উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে এ টাকার লেনদেন হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, গত ১৮ ডিসেম্বর মনোহরদী উপজেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের আগের দিন উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হওয়া মামুনুর ইসলাম নাঈম রিমনকে ২ লাখ টাকা ক্যাশ বুঝিয়ে দেন। এরপর দিনই তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য, মনোহরদী উপজেলা ছাত্রলীগের নতুন সাধারণ সম্পাদকের ছাত্রত্ব ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়র এমবিএ’র ছাত্র। কিন্তু তিনি রাজনীতি করেন মনোহরদীতে। শেষ হয়েছে কয়েক বছর আগে। বর্তমানে তিনি একজন ঠিকাদার হিসাবেই নিজ এলাকায় পরিচিত।

‘সম্মেলনের আগে ছাত্রলীগে পদ দেওয়ার হিড়িক’ শিরোনামে ২৫ এপ্রিল বিডিনিউজ২৪ এ পদ বাণিজ্যের একটি নিউজ প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, ২০১৮ সালে সম্মেলনের ঠিক আগ মুহূর্তে ছাত্রলীগের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শাখায় ব্যাপক হারে ‘পদ বিতরণ’র অভিযোগ পাওয়া গিয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় এমন অভিযোগ করেছেন অনেক নেতা। এই নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক রিপোর্ট হয়েছে।

১১ জুন ২০১৪ সালে দৈনিক অর্থসূচকের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। কোনো ধরণের সম্মেলন ছাড়াই টাকার বিনিময়ে নেতারা ইউনিয়ন কমিটি গঠন করছেন বলে দাবি করেছেন পদপ্রত্যাশী কয়েকজন নেতা।

ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী মো. আকরাম হোসেন বলেন, কমিটিতে পদ দেওয়ার কথা বলে আমার কাছেও টাকা চাওয়া হয়েছিল। আমি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় কমিটিতে আমাকে রাখা হয়নি। টাকার বিনিময়ে অছাত্র ও বিবাহিত ব্যক্তিকে ছাত্রলীগের নেতা বানানো হয়েছে। টাকা চাওয়ার প্রমাণ রয়েছে আমার কাছে।

সন্দ্বীপ উপজেলা ছাত্রলীগের ৭১ সদস্য বিশিষ্ট পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে পদ নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের ৩ দিনেও রহস্যজনকভাবে প্রকাশ করা হয়নি তালিকা। অভিযোগ উঠেছে, উপজেলা সভাপতি মাহফুজুর রহমান সুমন তালিকা প্রকাশ না করে ইচ্ছেমতো যাকে তাকে টাকার বিনিময়ে পদ দিচ্ছেন।

যুগান্তরে ২৫ জুলাই ২০১৫ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে খোদ কেন্দ্রীয় কমিটির বিরুদ্ধে পদ বাণিজ্যর অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। বলা হয়, বর্তমান কমিটি ২০১১ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ২০১। কয়েক দফায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করায় সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল চার শতাধিক বলে অভিযোগ করেন ছাত্রলীগ নেতারা। পদ বাণিজ্যের মাধ্যমেই কমিটির কলেবর দ্বিগুণ করা হয়।

পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সময় অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু বাস্তবে ওই নেতাকে সংশ্লিষ্ট পদ দেয়া হয়নি। ২০১ সদস্যের কমিটিতে তার নাম নেই। ফলে সংগঠনের ওয়েবসাইটেও তাদের নাম ওঠেনি। অথচ ওই নেতার কাছে, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত পদ প্রাপ্তির বিষয়ে চিঠি আছে। সেই চিঠি ভাঙিয়ে তদবির, চাঁদাবাজি এবং টেন্ডারবাজি করছে বলে তৃণমূল থেকে অভিযোগ উঠেছে। পদ বাণিজ্যের বিষয়টি আরও ওপেন সিক্রেট জেলা ও বিভিন্ন ইউনিট কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে বড় অংকের টাকার খেলা হয়ে থাকে। ছাত্রলীগের সর্বশেষ পাবনা জেলা ও মিরপুর বাঙলা কলেজের কমিটি গঠন নিয়ে এমন বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সোনারগাঁও এর ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদুল হাসান জানান, ছাত্রলীগের বারদী ইউনিয়ন কমিটিকে অযোগ্য লোকদের মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে কমিটিকে স্থান দিয়েছেন। যারা মাঠের ত্যাগী ও পরিচ্ছন্ন নেতাদেরকে মূল্যায়ন করা হয়নি। স্থানীয় আওয়ামীলীগ ও যুবলীগ নেতাদের অবগত না করে অযোগ্য নাজমুল হাসানকে সভাপতি ও মনিরুজ্জামান সবুজকে সাধারন সম্পাদক করা হয়েছে। যাদেরকে ২০০ টাকার বিনিময়ে বিএনপির মিছিলে অংশ নিতে দেখা যায় তাদেরকে কমিটিকে স্থান দেওয়া হয়েছে। এ কমিটি অবিলম্বে বিলুপ্ত করার দাবি করেন তিনি।

২০১২ সালের ২৭ আগস্ট প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যায়, তিন কোটি টাকার জমি কিনছেন ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সভাপতি তাজউদ্দীন আহমেদ ওরফে রানা। ‘রেজিস্ট্রি বায়নাসূত্রে এই জমির মালিক তাজউদ্দীন আহমেদ রানা’— এমন সাইনবোর্ড দেখে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনের প্রশ্ন, জেলা কমিটির একজন ছাত্রনেতা এমন বিত্তশালী হয়ে উঠলেন কীভাবে? নেপথ্যের ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, ছাত্রলীগে পদ-পদবি বেচাকেনার অভিযোগ এখন স্থানীয়ভাবে আলোচিত।

পদ বাণিজ্য

পদ বাণিজ্য

পদ বাণিজ্য

পদ বাণিজ্য

পদ বাণিজ্য

পদ বাণিজ্য