ছাত্রলীগের ছাত্র সংগঠন হিসেবে যেখানে ছাত্রদের অধিকার নিশ্চিত করার কথা সেখানে প্রাধান্য পেয়েছে সন্ত্রাস। এমন কোন উচ্চ বিদ্যাপীঠ নেই যেখানে ছাত্রলীগ সন্ত্রাস সৃষ্টি বা সৃষ্টির পায়তারা করে নাই। এমন কি স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীরাও রেহাই পায় নি ওদের হাত থেকে। গত দশ বছরে শিক্ষাঙ্গনে অন্তঃকোন্দল বা ভিন্নমতের উপর চড়াও হওয়াসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মারধর; প্রক্টর,উপাচার্যকে হুমকি,কখনো কখনো উনাদের কার্যালয়ে তালা, ভাংচুর; কর্মচারী লাঞ্চনা; বিভিন্ন সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কিংবা দাবি আদায়ের আন্দোলনে হামলা এসব অপকর্মের মধ্যেই কেটেছে ছাত্রলীগের। এরকম হামলার সংখ্যা ৩৫০ রও বেশী। আর নিহতের সংখ্যা প্রায় অর্ধশত।
এই আওয়ামী শাসনে ছাত্রলীগের প্রথম সংঘাত সংঘটিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৬ ফেব্র“য়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। ছাত্রদের জন্য প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ছাত্রাবাস নির্মাণকাজের দরপত্রের ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ওই সংঘর্ষ।
প্রথম আলো ও যুগান্তরে প্রকাশিত সংবাদের গবেষণা করে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে কোন্দল, সংঘর্ষ, সাধারণ ও বিরোধীমতের উপর হামলা,ছাত্রী নির্যাতনসহ অনুষ্ঠান পণ্ডের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৩৭৫ টি। শুধুমাত্র ছাত্রলীগের হাতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৪৮ জন। এসব ঘটনায় আহতের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আহত বা মারধরের শিকার হয়েছেন অন্তত ১৭১১জন, এছাড়াও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে অন্তত ১২৬ টি, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘটনা ঘটেছে ৮০ বারেরও অধিক। অন্যদিকে উপাচার্যের কক্ষে,শ্রেনীকক্ষে কিংবা প্রক্টরের কক্ষে তালা,ভাংচুর,হুমকির ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৫০ টি। এসবকিছুর পর কর্মকর্তা, কর্মচারী নির্যাতন তো আছেই। এহেন অপরাধের দরুণ শুধু মাত্র ২০১৩-২০১৮ সালেই মামলা,অভিযোগসহ গ্রেফতার কিংবা বহিষ্কারের ঘটনা ঘটেছে ৭০ টিরও অধিক আর এর শিকার হয়ছেন অন্তত ৩১৬ জনেরও অধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মী।
ছাত্রলীগের হত্যার রাজনীতি শুরু হয় ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানীকে হত্যার মধ্যে দিয়ে। আর এ রিপোর্টের আগ পর্যন্ত শিক্ষাঙ্গনে ছাত্রলীগের সর্বশেষ হত্যার শিকার ১০ম শ্রেণীর ছাত্র আদনান ইসফার। ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারির খুনটি বিশেষভাবে আলোচিত। এতে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের নোংরা রাজনীতির বলি হয় কলেজিয়েট স্কুলের ১০ম শ্রেণীর ছাত্র আদনান ইসফার। স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে তাকে হত্যা করে চন্দনপুরা এলাকার ছাত্রলীগ নেতা সাব্বিরের অনুসারী মাঈন।
এছাড়াও এই দশ বছরের কিছু আলোচিত ঘটনাগুলো হলো:
৩১ মার্চ, ২০০৯ তারিখেই প্রথম অন্তঃকোন্দলের শিকার হোন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র কলেজে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ওরফে রাজীব। নিজেদের মধ্যে সংঘাত করতে গিয়েই তাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে নিজের দলেরই ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। এরকম ঘটনা এখানেই শেষ না।
২০১০ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সৃষ্ট রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ও একই সংগঠনের কর্মীদের মেরে ছাদ থেকে ফেলে দেয়ার মতো নৃশংসতাই ছিল বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। এ সময় প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের চারজন কর্মীকে তিনতলা থেকে ফেলে দিয়েছিলেন ছাত্রলীগনামধারী ক্যাডাররা, যাঁদের একজন মারা যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থী আবু বকর হত্যা ছিলো ২০১০ সালের সবচেয়ে আলোচিত খবর।সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাতে স্যার এ এফ রহমান হলে সিট দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় আহত হয়ে এক দিন পর মারা যান। ওই সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হন। আবু বকর তৃতীয় সেমিস্টার পর্যন্ত সিজিপিএ-৪-এর মধ্যে ৩.৭৫ পেয়েছিলেন। চতুর্থ সেমিস্টারের ফল বের হওয়ার আগে তিনি খুন হন।
১৩ মার্চ ২০১০ তারিখে, দেহব্যবসা নিয়ে ইডেনে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। এতে অন্তত ১০ জন আহত হয়। এ ব্যাপারে সমাজকর্ম বিভাগের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী মাহফুজা খানম স্বর্ণা বলেন, সাধারণ সম্পাদক নিঝুম ও সভাপতি তানিয়া আমাকে সব ধরনের অফার করেছে। বিভিন্ন নেতার বাসায় যাওয়ার জন্য আমাকে চাপ প্রয়োগ করছে। আমি তাদের কথা না শুনায় আমার রুম ভাংচুর করে তালা দিয়ে সবকিছু নিয়ে গেছে। তিনি বলেন, বৃহ¯পতিবার রাতেও আমাকে এক নেতার বাড়ি যেতে বলেছিলো নিঝুম। তার কথা না শুনায় তার কর্মীরা আমাকে মারধর করেছে।
২০১১ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছাত্রদলের কমিটি গঠনের চেষ্টার অভিযোগে আবিদসহ চারজনকে ২০ অক্টোবর, বুধবার ছাত্রলীগ কর্মীরা বেধড়ক পেটায়। এই চারজনকে একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হওয়ায় বৃহ¯পতিবার বিকেলে আবিদকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) আনা হয়। পরব্রতীতে পরবর্তীতে শুক্রবার রাতে আবিদের মৃত্য হয়।
২০১২ সালের আগস্টে সবচেয়ে বড় ঘটনা ছিল কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইবিতে চাকরি বাণিজ্য নিয়ে ছাত্রলীগ তাণ্ডব চালায়। সেখানে পুলিশ-ছাত্রলীগের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় ২৫ আগস্ট থেকে ১৫ দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায় এই বিশ্ববিদ্যালয়।
২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হয় এক শিশু। এর নেপথ্যেও ছিল দরপত্র ও নিয়োগ-বাণিজ্যের টাকা ভাগাভাগি।প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দু’গ্রুপের ক্যাডারদের মধ্যে গুলি বিনিময়কালে গুলিবিদ্ধ হয় ১০ বছরের শিশু রাব্বি। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশের রাস্তায় বসে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয় এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধী অবস্থায় মারা যায়। শিশু রাব্বির মর্মান্তিক মৃত্যুতে এলাকায় চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২টি হলে হামলাও অগ্নিসংযোগ করে। উক্ত সংঘর্ষের জের ও উত্তেজনাকর পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে বাকৃবি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
২০১৪ সালের ১৯ এবং ২০ ফেব্রুয়ারি রংপুরের রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কার্যালয়ে ভাঙচুর চালায় বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। তাদের পছন্দের প্রার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে নিয়োগ দেয়া হয়নি বলে এই অন্যায় হামলা চালায় তারা। ২৮ আগস্ট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকর্ম বিভাগের চেয়ারম্যানকে কুপিয়ে জখম করে ছাত্রলীগের ওয়েস আহমেদ নামে এক ছাত্র। আর এ ঘটনাকে পুঁজি করে ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে ছাত্রলীগের অঞ্জন-উত্তম গ্রুপের নেতাকর্মীরা।
৩০ আগস্ট বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি আশরাফ মিল্টনকে পিটিয়ে আহত করে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
১২ আগস্ট, ২০১৫ সালে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে সিলেটের মদন মোহন কলেজে একই গ্রুপের কর্মীর ছুরিকাঘাতে আব্দুল আলীম নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হয়েছেন। ১১ আগস্টে ছাত্রলীগের বিধান গ্রুপের সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। পরদিন দুপুরে এর জের ধরে একই গ্রুপের কয়েকজন সিনিয়র কর্মী কলেজ ক্যাম্পাসে ঢুকে আব্দুল আলীমকে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
২৯ মে ২০১৬ তারিখে, বরিশাল পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ছাত্রলীগের এক পক্ষের হামলায় নিহত হয় ছাত্রলীগের কর্মী মো. রেজাউল করিম ওরফে রেজা। আহত রায়হান বলেন, গত সপ্তাহে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট-সংলগ্ন আমীর কুটির এলাকার বাসিন্দা মো. জাহিদ ধারালো অস্ত্রসহ বহিরাগত নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে। তাঁরা ছাত্রদের কাছে চাঁদা দাবি করে এবং নানা হুমকি-ধমকি দেয়। তখন রেজা ও তাঁর সহযোগীরা ক্যাম্পাসের মধ্যেই বহিরাগতদের পিটুনি দেয়। একপর্যায়ে একটি ধারালো অস্ত্রসহ জাহিদকে পুলিশের হাতে তুলে দেন রেজা। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই সে ছাড়া পেয়ে যায়। ছাড়া পেয়ে ছাত্রলীগের এক পক্ষের ছত্রচ্ছায়ায় ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থান নেন। রাতে ক্যাম্পাসে ঢোকার পথে রেজাসহ তাঁদের এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করেন।
২০ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে গত বছরের অক্টোবরে শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নির্বাহী কমিটির সদস্য আবদুল্লাহ আল কায়সারকে সাময়িক বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ড. ইউনূস ভবনের তৃতীয় তলায় পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে ছাত্রলীগের একাংশ হলের সামনে অবস্থান নেয়। এতে পরীক্ষার্থীরা হলে ঢুকতে পারেনি। আন্দোলনকারীরা শাটল ট্রেনের হোস পাইপ কেটে দেওয়ায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে।
৩০ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের এক ছাত্রীকে নির্যাতনের করে হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইফাত জাহান এশা। হলের সাধারণ ছাত্রীরা অভিযোগ করেন, মঙ্গলবার দিবাগত রাতে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী মোর্শেদা আক্তারকে নিজের কক্ষে নিয়ে মারধর করেন ইফফাত জাহান। একপর্যায়ে মোর্শেদার পা কেটে যায়। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রীদের আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই কক্ষে নিয়ে মারধর করে আসছিলেন ইফফাত জাহান। তবে নির্যাতনের শিকার ছাত্রীরা ভয়ে কাউকে কিছু বলেনি।
২০০৯ সাল থেকেই সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে ব্যাপক সমালোচিত হয় ছাত্রলীগ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নানা পদক্ষেপের পরও ছাত্রলীগের লাগাম টানা সম্ভব হয়নি। ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল সংগঠনের দায়িত্ব থেকেও সরে দাঁড়ান ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী। পরবর্তীতে সংগঠনটি দেখাশোনা করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় ছাত্রলীগের এক সময়ের সভাপতি ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ওবায়দুল কাদেরকে।
ভোরের কাগজের এক রিপোর্টে দেখা যায়, শিক্ষাবিদরা বলছেন, ছাত্র সংগঠনগুলোর এ ধরনের লাগামহীন আচরণের মূল কারণ হচ্ছে, ছাত্র সংগঠনগুলোকে মূল রাজনৈতিক দলগুলোর পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা।