২০০৯ সালে সরকার ঘোষণা দিল, ফিটনেসবিহীন গাড়ি আর চলবে না। রাজধানী থেকে ২০ বছরের পুরোনো সব বাস তুলে দেওয়া হবে। দুই বছর পর ওবায়দুল কাদের মন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন। সড়ক পরিবহন উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও তাঁর কাঁধে। এর পরের বছর (২০১২) এই পরিষদের সভায় মন্ত্রী ফিটনেসবিহীন যানবাহন তুলে দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। পরের বছরের জুনে এই পরিষদের আরেক সভায় একই ঘোষণা দেন তিনি। ঘোষণা দিতে দিতেই সরকারের মেয়াদ শেষ।
সরকারের শেষ সময়ে এসে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, এখন চাইলেও সবকিছু করা যায় না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর নতুন সরকার এল। ওবায়দুল কাদের আবার একই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেলেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর বিমানবন্দর এলাকায় যানজট নিরসন-সংক্রান্ত এক কর্মসূচিতে ফিটনেসবিহীন গাড়ি তুলে দেওয়ার ঘোষণা পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি। এরপর বিআরটিএর তৎকালীন চেয়ারম্যানকে প্রধান করে ১১ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়।
দীর্ঘ আট বছর ধরে দেশবাসী শুধু ঘোষণাই শুনল। কোনো ঘোষণারই যে রূপায়ণ হলো না, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল স্কুল-কলেজের ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। নড়বড়ে-ভাঙাচোরা বাস, লাইসেন্সবিহীন চালক, নিয়ম না মানার প্রতিযোগিতা—সবই দৃশ্যমান। মন্ত্রী, পুলিশ বা সরকারি গাড়ির চালকও যে ‘ফিটনেসবিহীন’ সেটা কিন্তু শিক্ষার্থীদেরই আবিষ্কার।
ওবায়দুল কাদের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন সাত বছর। এই মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব নজরুল ইসলাম পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন প্রায় তিন বছর। বিআরটিএর বর্তমান চেয়ারম্যান মশিয়ার রহমান সংস্থাটির পরিচালক ছিলেন ছয় বছর। প্রায় দুই বছর ধরে তিনি সংস্থাটির চেয়ারম্যান। বিআরটিএর ঢাকা ও এর আশপাশের পরিবহনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব মিরপুর কার্যালয়ের। এই কার্যালয়ের মূল দায়িত্বে যে কর্মকর্তা, তিনিও সেখানে নানা দায়িত্বে আছেন প্রায় সাত বছর ধরে। মন্ত্রণালয় ও বিআরটিএর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো দীর্ঘদিন ধরে অলংকৃত করছেন এই কয়েকজন ব্যক্তি।
মন্ত্রী মাঝেমধ্যেই ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিদর্শনে গেছেন। সড়কে দৌড়ঝাঁপ করেন। কখনো নিজেই যাত্রী সেজে বাসে উঠে বাড়তি ভাড়া আদায় হচ্ছে কি না পরীক্ষা করেন। কিন্তু সড়কে শৃঙ্খলা আনার বিষয়ে মৌলিক কোনো উদ্যোগ বা কর্মকাণ্ড নেই।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মন্ত্রণালয়ে থাকেন কম। রাস্তায় দৌড়ঝাঁপের পাশাপাশি দলীয় কার্যালয়ে নানা সভা-সমাবেশে যান তিনি। মন্ত্রণালয়ের বা বিভাগের ফাইল অনেক সময় ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা সঙ্গে করে নিয়ে সই করান।
সড়ক পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকদের ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি একাধারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। আবার ঢাকা ও দূরপাল্লার পথে তাঁর পারিবারিক কোম্পানির বাস চলে। সারা দেশের মালিক সমিতির সভাপতি পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান এবং মহাসচিব ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ। ঢাকায় নৌমন্ত্রী, একাধিক বর্তমান ও সাবেক সাংসদ, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা এবং মহানগর পুলিশের বড় কর্তাদের আত্মীয়দের বাস চলাচল করে। শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুজন শিক্ষার্থীকে বেপরোয়া চালক চাপা দেওয়ার পর সবার আগে প্রতিক্রিয়া দেন শাজাহান খানই। তাঁকে নিয়েই সমালোচনা হয়। কিন্তু রাজনৈতিক মালিক-শ্রমিকদের দৌরাত্ম্য বন্ধে সড়ক মন্ত্রণালয় যেকোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি, সেটা অনেকটাই চাপা পড়ে যায়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে বারবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তাঁর মুঠোফোনে খুদেবার্তা পাঠানো হয়েছে। কিন্তু তাঁকে পাওয়া যায়নি।
তবে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব নজরুল ইসলাম এ বিষয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, তাঁদের দিক থেকে চেষ্টার কোনো ঘাটতি নেই। আর সড়কে শৃঙ্খলার বিষয়টি তাঁর বিভাগের একার কাজ নয়। এর সঙ্গে অন্য আরও সরকারি সংস্থা জড়িত। গণপরিবহনে ভাড়া-নৈরাজ্য সম্পর্কে সচিব বলেন, ‘নৈরাজ্য আছে, এর সঙ্গে আমি একমত না। এটা আপনার কথা।’ পুরোনো যানবাহন তুলে দেওয়ার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের কোনো সিদ্ধান্ত নেই বলে দাবি করেন তিনি।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পাঁচটি নির্দেশনা দিয়েছিলেন। যে প্রধানমন্ত্রীকে সবাই একবাক্যে মানেন। এখন আমরা জানতে চাই, এসব নির্দেশনার কোনটি এবং কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তাহলে বলতে হবে এটা দায়িত্বের চরম অবহেলা। পরিবহন খাতে ব্যয়ের জবাবদিহির অভাব এবং দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। জনগণ কেন সেবা পাচ্ছে না, এটা সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।’
ঢাকায় গণপরিবহনে দুরবস্থা
রিকশা বাদ দিলে ঢাকার গণপরিবহনব্যবস্থার মূলভিত্তি বাস। এরপরই সিএনজিচালিত অটোরিকশা। একসময় কিঞ্চিৎ ভূমিকা ছিল ট্যাক্সিক্যাবের। এখন তাও চলছে না। গণপরিবহনের এই তিন খাতেই রীতিমতো নৈরাজ্য চলছে।
ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট নেটওয়ার্ক ডেভেলপমেন্ট প্রকল্প নামে ২০০৯ ও ২০১৪ সালে দুটি সমীক্ষা করে জাপানের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা জাইকা। এই সমীক্ষা বলছে, যানবাহন ব্যবহার করে ঢাকায় প্রতিদিন ৩ কোটি ৩০ লাখ বার যাতায়াত হয়। এর ৭২ শতাংশ যাতায়াত হয় বাসে। আর বাস ও অটোরিকশায় যাতায়াত হয় ৮৭ দশমিক ৪ শতাংশ। বাকিটা কার ও অন্যান্য যানবাহনে।
ঢাকাবাসীর ভরসা যে বাস, এর চলাচলের অনুমোদন দেওয়া, ভাড়া নির্ধারণ, ফিটনেস সনদ দেওয়া—সবই সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু তাদের নির্ধারণ করে দেওয়া ভাড়া, থামার জায়গা মানছেন না মালিক-শ্রমিকেরা। ফিটনেস সনদ নেই এমন বাসও চলছে রাজধানী শহরে। যেগুলোর ফিটনেস সনদ আছে, সেগুলো বাসেরও ছাল-বাকল নেই।
বিআরটিএ বলছে, ঢাকায় ফিটনেসবিহীন যানবাহন ২ লাখ ১৬ হাজার। ফিটনেস দুই ধরনের। একটি যানের বাহ্যিক দিক, অন্যটি কারিগরি। ফিটনেস সনদ দিতে হলে ৬০ ধরনের বিষয় যাচাই করতে হয়। কারিগরি দিক বাদ দিলে শুধু বাহ্যিক বিবেচনাতেই ঢাকার ৮০-৯০ শতাংশ বাস-মিনিবাস চলাচলের অনুপযোগী। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক বাস শৃঙ্খলায় আনার একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি একদল বিশেষজ্ঞ দিয়ে গত বছর একটি সমীক্ষাও করেন। এই সমীক্ষা বলছে, বর্তমানে ঢাকায় চলাচলরত অর্ধেক বাস-মিনিবাস ঢাকায় চলাচলের অনুপযোগী।
রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশার অনুমোদন আছে প্রায় ১৪ হাজার। ২০০২ সালে চালু হওয়ার পর দুই-তিন বছর সরকারনির্ধারিত ভাড়া মেনে চলেছে। এখন আইন না মানাই নিয়ম। যাত্রী চাইলে যেকোনো স্থানে যেতে বাধ্য—নীতিমালার এ বিষয়টি পরিহাসে পরিণত হয়েছে। মন্ত্রণালয় যাত্রীদের সুরক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করে গত ১০ বছরে পাঁচবার ভাড়া বাড়িয়েছে। মালিকদের দাবির মুখে ভাঙাচোরা অটোরিকশার মেয়াদ দুই দফা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকারের এমন আশকারা পেয়ে মালিক-শ্রমিকেরা যাত্রীদের আরও জিম্মি করার সুযোগ পাচ্ছেন।
১৯৯৮ সালে ঢাকায় ট্যাক্সিক্যাব নামানোর পর পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে তা ধ্বংস হয়ে যায়। প্রায় এক দশক রাজধানী শহর ট্যাক্সিক্যাবশূন্য ছিল। বর্তমানে কিছুদিন ধরে অবশ্য উবার সেবা জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
পরিবহন খাতের নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সেবা দেওয়ার দায়িত্বও বিআরটিএর। প্রতিষ্ঠানটি গত বছর যানবাহনের মালিক ও চালকের কাছ থেকে ১ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা আয় করে। কিন্তু কর ও ফি দেওয়ার পরও সেবা পাচ্ছে না মানুষ। বিআরটিএর প্রতিটি কার্যালয়ে দালালে ভরা। হয়রানি এড়াতে মানুষ ঘুষের আশ্রয় নিচ্ছে। সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই কদিন পরপর অভিযান চালিয়ে দালাল ধরছেন।
সওজের কাজ হচ্ছে সড়ক ও সেতু নির্মাণ ও মেরামত। এই সংস্থার অধীনে সারা দেশে প্রায় ২১ হাজার কিলোমিটার সড়ক আছে। এই সংস্থার অধীনে প্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৩৪টি প্রকল্প চলমান। এরপরও সারা বছর ভাঙাচোরা সড়কের ভোগান্তি পোহাতে হয় মানুষকে।
যানজটে আর্থিক ক্ষতি
গত মার্চে প্রকাশিত বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুসারে, যানজটের কারণে রাজধানীতে একটি যানবাহন ঘণ্টায় যেতে পারে গড়ে পাঁচ কিলোমিটার। এর ফলে ঢাকায় দৈনিক ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক গবেষণায় বলা হয়, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা ছিল গড়ে ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়ে কম।
সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি
গত বছর আগস্টে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) এক গবেষণায় এসেছে, দেশে সড়ক দুর্ঘটনা এবং এর প্রভাবে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এসব দুর্ঘটনার কারণে বছরে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ২ থেকে ৩ শতাংশ হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
গত সাড়ে তিন বছরে সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২৫ হাজার ১২০ জন। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে ২০ জন। এই সময়ে আহত হয়েছেন ৬২ হাজার ৪৮২ জন। এই হিসাব যাত্রী কল্যাণ সমিতির। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৬ সালের প্রতিবেদন বলছে, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে প্রাণহানি প্রায় ২১ হাজার।
জনবল ও ব্যয়
সড়ক পরিবহন বিভাগের অধীন সংস্থাগুলো হচ্ছে সওজ, বিআরটিএ, বিআরটিসি ও ডিটিসিএ। মন্ত্রণালয় ও এসব সংস্থায় স্থায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারী আছেন ৬ হাজার ৩৩০ জন। সওজের অধীনে আরও প্রায় ৬ হাজার কর্মী অস্থায়ীভাবে কাজ করেন। আর মেট্রোরেল প্রকল্প একটি কোম্পানির অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এর কর্মকর্তা-কর্মচারী সংখ্যা শ খানেক।
মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো ২০০৯ সাল থেকে গত জুন পর্যন্ত ৯ বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় করেছে। এর মধ্যে প্রায় ৫৫ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অধীনে। ৩ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি খরচ হয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্পে।
প্রাণঘাতী ভাঙাচোরা সড়ক
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজের) গত মে মাসে প্রকাশিত তথ্য বলছে, দেশের ২৬ দশমিক ৩২ শতাংশ সড়ক ও মহাসড়ক বেহাল। বেহাল সড়কের পরিমাণ ৪ হাজার ৭৩২ কিলোমিটার। সারা দেশে সওজের অধীন সড়ক আছে ২১ হাজার কিলোমিটারের একটু বেশি। সওজের কর্মকর্তারা বলছেন, এই হিসাব গত শুকনো মৌসুমের। এখন বর্ষা শুরুর পর বেহাল সড়কের পরিমাণ আরও বেড়েছে।
২০১১ সালে চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর পর সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি সড়ক নিরাপত্তা উপকমিটি গঠন করে। কমিটি ৫২টি সুপারিশ করে। এর বেশির ভাগ ছিল আইন প্রয়োগ, সচেতনতা সৃষ্টি, চালকের প্রশিক্ষণ ও তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা। এর বাইরে মহাসড়কে ক্যামেরা ও পুলিশের তল্লাশিচৌকি বসানো এবং সড়ক খাতের আইন যুগোপযোগী করার সুপারিশ করে কমিটি। সড়ক খাতে ভবিষ্যতে নেওয়া প্রকল্পের খরচের ১ থেকে ৫ শতাংশ সড়ক নিরাপত্তা তহবিল হিসেবে বরাদ্দের সুপারিশও করা হয়েছিল।
জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এক দশকে সারা বিশ্বে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি অর্ধেক কমিয়ে আনার ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশ এই ঘোষণাপত্রে সই করে। জাতিসংঘ এর সদস্যদেশগুলোকে ভবিষ্যৎ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের ব্যয়ের ১ থেকে ১০ শতাংশ সড়ক নিরাপত্তার কাজে ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল। দেশে মহাসড়কের ১৪৪টি স্থানে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের ১৬৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প ছাড়া আর তেমন কিছুই নেই।
সড়ক নিরাপত্তার সিদ্ধান্ত ঝুলে থাকছে
২০১৫ সালে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের এক বৈঠকে দুর্ঘটনা কমাতে মহাসড়কের সর্বোচ্চ গতিবেগ ৮০ কিলোমিটার নির্ধারণ করার কথা জানান মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ২০০৯ সালে প্রতিটি যানবাহনে নির্দিষ্ট গতিসীমা মেনে চলার যন্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেন হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। এসব সিদ্ধান্ত বা আদেশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি।
২০১৬ সালে দেশের ২২টি মহাসড়কে অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। এরপর গত বছর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ সড়ক থেকে নছিমন, করিমন, ভটভটি তুলে দেওয়ার নির্দেশনা দেন। এসব সিদ্ধান্তও বাস্তবায়ন হয়নি।
সড়ক নিরাপত্তা সড়কের ওপর চাপ কমাতে কত চাকার মালবাহী যানবাহন কী পরিমাণ ওজন বহন করতে পারবে, এর একটা নীতিমালা করে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়। বাড়তি মালামাল বহনের জন্য জরিমানা আরোপেরও বিধান রাখা হয়। বাড়তি মালামাল পরিবহনের জন্য মালবাহী যানের আকৃতিও পরিবর্তন করা হয়। বিশেষজ্ঞরা এটাকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেন। কিছুদিন অতিরিক্ত মাল বহন ও যানবাহনের আকৃতি পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগও করা হয়। গত বছর পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের আন্দোলনের পর পিছু হটে সরকার। নীতিমালার চেয়ে ৬ থেকে ৮ টন পর্যন্ত বাড়তি মালামাল বহনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, গণপরিবহন বা সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে সরকারের বোঝার এবং সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ ঘাটতি আছে। তা না হলে সিরিয়ার দামেস্কের সঙ্গে ঢাকার তুলনা হতো না। এটা খুবই লজ্জার বিষয়। তিনি বলেন, বড় বড় প্রকল্প নিয়ে টাকা খরচ করা সহজ। কারণ, এর মধ্যে অনেকের কমিশন পাওয়ার বিষয় আছে। কিন্তু সেবা দেওয়াটা কঠিন। গণপরিবহনব্যবস্থায় টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু সেবা বা শৃঙ্খলা নিশ্চিত করার কাজটি করা হয়নি।