গত দশবছরে ছাত্রলীগ যে ধরণের কাজ করেছে এবং করে যাচ্ছে তাতে তাদের হাতে অস্ত্র থাকাটা খুব স্বাভাবিক। গত দশ বছরে ছাত্রলীগ অস্ত্রের সহজলভ্যতা এনে দিয়েছে। শুধু বড় নেতারা নয়, গ্রাম গঞ্জে ওয়ার্ড ইউনিয়ন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে অস্ত্র। চাঁদাবাজি, অস্ত্রবাজি, খুন, নারী নির্যাতন, টেন্ডার, ভর্তি বাণিজ্য, পদ বাণিজ্য, আধিপত্য বিস্তার, দলীয় কোন্দলে মারামারি, বিরোধী মতকে হত্যা করা সব কাজেই অস্ত্র মোক্ষম উপাদান।
গত এক দশকে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ খুন করেছে অন্তত ১৮৪ জনকে। গোলাগুলিতে আহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
ছাত্রলীগ বুলেটের আঘাত থেকে শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউ রেহাই পায়নি। এমনকি রেহাই পায়নি মায়ের গর্ভে থাকা শিশুও। ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই মাগুরায় ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ আধিপত্য নিয়ে গোলাগুলি শুরু করে। ছাত্রলীগের নির্বিচার গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন অন্তঃসত্ত্বা নাজমা বেগম। সেই সাথে তার চাচা শ্বশুর মমিন ভূঁইয়াও গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন মমিন ভূঁইয়া। অন্তঃসত্ত্বা নাজমা বেগমের সাথে গুলিতে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় গর্ভস্থ শিশু।
রাবিতে ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে চড়াও হয়েছেন। এ সময় তাঁদের অনেককে গুলি করতে ও ইটপাটকেল ছুড়তে দেখা গেছে। এ সময় পুলিশ রাবার বুলেট, ছররা গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে। এতে শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন।
রাবিতে ১২ সালের অক্টোবরের দশ তারিখ ছাত্রলীগ অস্ত্রের মহড়া চালিয়েছে। ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে বেলা ১১টার দিকে চলা সংঘর্ষে ৫০টিরও বেশি গুলি ছোড়া হয়। এ ঘটনায় তিনজন গুলিবিদ্ধসহ আহত হন ২৫ জন। তাঁদের মধ্যে কুপিয়ে আহত করা হয় দুজনকে। প্রথম আলো পত্রিকায় পাওয়া যায় পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গুলি করছে ছাত্রশিবিরের কর্মীদের। ।
২০১২ সালে বহিষ্কার করলেও অস্ত্রধারী তুহিনকে ১৩ সালের ২২ জুলাইতে তাকে আবার দলে নেয়া হয়। শুধু দলে নেয়া হয় তাকে রাবির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেয়া হয়।
২০১২ সালের ১৫ জুলাই রাতে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের বিদায়ী সভাপতি মোহাম্মদ আলী ও বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক আবু হুসাইন পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র এবং ছাত্রলীগের কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান। এ ঘটনায় ১৭ জুলাই ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ নোমানের দায়ের করা মামলায় তৌহিদ আল হোসেনকে তুহিনকে আসামি করা হয়। ওই ঘটনার জের ধরে তাঁকে ১৬ জুলাই সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। ২২ নভেম্বর তাঁকেসহ ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আটজন নেতা-কর্মীর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে নেয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি। সূত্র আরও জানায়, ২০১১ সালের ২১ আগস্ট নগরের পদ্মা আবাসিক এলাকার একটি বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় দায়ের করা মামলায় গত বছরের ১৯ এপ্রিল পুলিশ তৌহিদ আল হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়।
১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর অস্ত্রবাজ হিসেবে পরিচিত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক সজিবুল ইসলাম সজিবের বিরুদ্ধে এবার অস্ত্র প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার অভিযোগ উঠেছে। সজিবের সেই অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বিসিএস ক্যাডার থেকে শুরু করে স্থানীয় সন্ত্রাসী ও চরমপন্থিরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন বলে জানা গেছে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের পেছনের নির্জন স্থানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়ার ছবি প্রকাশ হয়ে গেলে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। ছবিগুলোতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের এক শিক্ষক এবং এক বিসিএস ক্যাডারকেও আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ নিতে দেখা গেছে। সজিবের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদক ব্যবসারও অভিযোগ এখন সবার মুখে মুখে।
১৪ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ‘ছাত্রলীগের হাতে জেমস বন্ডের অস্ত্র!’ শিরোনামে যুগান্তর পত্রিকা তাদের প্রতিবেদনে বলে রাবিতে ছাত্রলীগ বেছে নিয়েছে জেমস বন্ড সিরিজের চলচ্চিত্র ‘ডাই অ্যানাদার ডে’ সিনেমায় ব্যবহৃত ‘বেরেটা টম ক্যাট’ অস্ত্রের মতো মারণাস্ত্র। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো হয় এ অত্যাধুনিক অস্ত্রের গুলি।
২২ নভেম্বর ২০১৪ তারিখে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের দু’গ্রুপের সশস্ত্র ক্যাডারদের শ’ শ’ রাউন্ড গুলিবিনিময়কালে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক ছাত্রলীগ কর্মী নিহত হয়েছেন। পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরসহ কমপক্ষে ১০ জন গুলিবিদ্ধ হওয়া ছাড়াও অন্তত ৩০ জন আহত হয়েছেন।
২০১৬ সালের ২৫ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জ সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ছাত্রাবাসের কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সভাপতির রুম থেকে বিপুল পরিমাণ দেশি -বিদেশি অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২টি বিদেশি পিস্তল, ১টি কাঠের বাট যুক্ত পাইপ গান, ১টি থ্রি নট থ্রি রাইফেলের ড্যাম, ১টি এয়ার গান, ৩টি ম্যাগাজিন, ৮৯ রাউন্ড পিস্তলের গুলি,৩টি রাউন্ড থ্রি নট থ্রি রাইফেলের গুলি, ৪ রাউন্ড শর্টগানের কার্তুজ, পাইপগন তৈরি বিভিন্ন অংশ, ২টি চাইনিজ কুড়াল, ৫টি বড় রামদা, ৩টি রামদা, ২টি ছোট চাকু এবং ৩৩ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার করা হয়।
২৯ নভেম্বর ১৬ সালে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশিত ছবিতে দেখা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) শাখা ছাত্রলীগের দুই কর্মীর বিদেশি পিস্তল নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠার একটি ছবি নিয়ে চাঞ্চল্য তৈরী হয়েছে। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের ছাত্রলীগকর্মী মো. ফিরোজ মাহমুদ আড্ডাচ্ছলে আরেক ছাত্রলীগ কর্মী শুভজিৎ অন্তু কুণ্ডুর কপালে একটি বিদেশি নাইন এম এম পিস্তল ঠেকিয়ে ধরেছেন। অন্য আরেকটি ছবিতে অন্তু পিস্তল নিয়ে বসে আছেন। অভিযুক্ত দু’জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের ছাত্র। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভিযুক্ত দু’জনই হল ছাত্রলীগ কর্মী আফফান হোসেন আপনের অনুসারী।
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নের একটি ভোটকেন্দ্র দখলের চেষ্টাকালে মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনিকে অস্ত্রসহ আটক করেছে বডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। ৭ মে ২০১৬ তারিখে দুপুর ১২টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। চাড়িয়া বোর্ড সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র দখলের চেষ্টাকালে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদককে নুরুল আজিম রনিকে আটক করা হয়েছে। রনির কাছ থেকে একটি নাইনএমএম পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। নুরুল আজিম রনিকে এর আগেও অস্ত্র হাতে চট্টগ্রাম কলেজে কয়েকবার তাণ্ডব ও হামলা চালাতে দেখা যায়।
২০১৬ সালের ২৪ জুলাই ছাত্রলীগকর্মী লিন্টু শেখের বাড়ি থেকে পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করেছে পুলিশ।তার বাড়ি থেকে একটি ৭.৬২ পিস্তল ও তিন রাউন্ড পিস্তলের তাজা গুলি উদ্ধার করা হয়।৩১ অক্টোবর ১৬ তারিখে গুলিস্তানের ফুটপাথে সম্প্রতি হকার উচ্ছেদের সময় সংঘর্ষের মধ্যে দুই ছাত্রলীগ নেতাকে দেখা যায় আগ্নেয়াস্ত্র হাতে শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে গুলি করছে। অস্ত্রধারী দুজন হলো সাব্বির এবং আশিক। সাব্বির ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আশিক ছিলেন ওয়ারী থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক।
১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮তারিখে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি বাতিলের দাবিতে আজ বুধবার দুপুরে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিয়েছে একাংশের নেতাকর্মীরা। তাদের বিক্ষোভ মিছিল থেকে ককটেল বিস্ফোরণ, সড়ক অবরোধ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রাম কলেজ ও মহসিন কলেজে গত দুবছর বহুবার নরুল আজিম রনির নেতৃত্বে অস্ত্রের মহড়া দিতে দেখা যায়।