রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত রোববারের হামলার সময় যে ছয়জনকে অস্ত্র হাতে দেখা গেছে, তাঁদের পাঁচজনই ছাত্রলীগের নেতা। বাকি একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে গতকাল পর্যন্ত অস্ত্রধারী কাউকে গ্রেপ্তার করেনি পুলিশ।
যে পাঁচজনের পরিচয় জানা গেছে তাঁরা হলেন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক নাসিম আহাম্মেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুজ্জামান ও ফয়সাল আহাম্মেদ, পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মুস্তাকিম বিল্লাহ এবং বিগত কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সুদীপ্ত সালাম।
গত রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম প্রথম আলোকে জানান, নাসিম আহাম্মেদ ও শামসুজ্জামানকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
নাসিম আহাম্মেদ ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান হত্যা মামলার আসামি। তাঁকে ২০১২ সালের ২ অক্টোবরও ক্যাম্পাসে অস্ত্র হাতে দেখা গেছে। পরদিন পত্রিকায় সে ছবি ছাপা হয়েছে।
সুদীপ্ত সালামও এর আগে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা না করে পুলিশ অসামাজিক কাজের অভিযোগে মামলা করেছিল। ওই মামলায় তিনি জামিনে আছেন।
ছাত্রলীগের পাঁচজনের মধ্যে দুজনের ছবি গতকাল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
বর্ধিত ফি ও সন্ধ্যাকালীন মাস্টার্স কোর্স বন্ধের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সময় এঁরা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেন। তবে ছাত্রলীগ দাবি করেছে, তাঁদের ওপর শিবিরের নেতা-কর্মীরা হামলা করেছেন, এ জন্য তাঁরা প্রতিরোধ করেছেন।
আর পুলিশ বলেছে, তদন্তে সাক্ষ্য-প্রমাণসহ পরিচয় পাওয়া গেলে অস্ত্রধারীরা মামলার আসামি হিসেবে চলে আসবেন।
নাসিম আহাম্মেদ: প্রত্যক্ষদর্শীরা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, গত রোববার আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার সময় কালো জ্যাকেট পরে পিস্তল হাতে যাঁকে গুলি ছুড়তে দেখা গেছে, তিনি ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম সম্পাদক নাসিম আহাম্মেদ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র। ছাত্রলীগের আগের কমিটিতে তিনি উপপাঠাগার সম্পাদক ছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, দুই বছরেও প্রথম বর্ষ থেকে দ্বিতীয় বর্ষে উঠতে না পারায় গত বছর ৫ ফেব্রুয়ারি নেতা-কর্মীদের নিয়ে গিয়ে নাসিম আহাম্মেদ তাঁর বিভাগের পাঁচটি কক্ষের কাচের দরজা এবং সাতটি জানালার কাচ ভাঙচুর করেন। ভেঙে ফেলা হয় কক্ষগুলোর সামনে থাকা প্রায় ১২টি ফুলের টব। সাংবাদিকেরা ছবি তুলতে গেলে নাসিম আহাম্মেদ অস্ত্র বের করে তাঁদের হুমকি দেন এবং ধারণ করা ছবি মুছে ফেলতে বাধ্য করেন।
তবে ওই সময় নাসিম সাংবাদিকদের অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সাংবাদিকেরাই তাঁর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছেন। তার পরও সাংবাদিকদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন তিনি।
নাসিম আহাম্মেদ ছাত্রলীগ কর্মী আবদুল্লাহ আল হাসান ওরফে সোহেল রানা হত্যা মামলার আসামি। ওই মামলায় তিনি জামিনে আছেন।
২০১২ সালের ২ অক্টোবর শিবির-ছাত্রলীগ সংঘর্ষের সময়ও নাসিমকে পুলিশের সামনে পিস্তলে গুলি ভরতে দেখা গেছে। এ ছবি পরদিন বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
গত বছর ৩১ জানুয়ারি নাসিম নিজ সংগঠনের এক কর্মীকে অস্ত্র দেখাতে গিয়ে গুলি বের হয়ে নিজেই আহত হয়েছিলেন।
গত রোববার ছাত্রলীগের মিছিল থেকে নাসিম আহাম্মেদকে পিস্তল হাতে গুলি করতে করতে দৌড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের দিকে যেতে দেখা গেছে।
শামসুজ্জামান: নাসিমের পাশেই ছাই রঙের জ্যাকেট পরে অস্ত্র উঁচিয়ে যাঁকে গুলি করতে দেখা গেছে, তিনি ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুজ্জামান ওরফে ইমন। তিনি ইতিহাস বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। এর আগে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ আমির আলী হল শাখার সভাপতি ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে আবাসিক হলে ছাত্র হয়রানির অভিযোগ রয়েছে।
ফয়সাল আহাম্মেদ: অস্ত্রধারীদের মধ্যে আরেকজন ছিলেন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ফয়সাল আহাম্মেদ ওরফে রুনু। পত্রিকায় তাঁর ছবি ছাপা হয়নি। তবে টেলিভিশন ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে তাঁকে অস্ত্র হাতে দেখা গেছে। ফয়সাল কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
মুস্তাকিম বিল্লাহ: রোববার মিছিলে অস্ত্র হাতে ছিলেন ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মুস্তাকিম বিল্লাহও। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। এর আগে তিনি নবাব আবদুল লতিফ হলের ছাত্রলীগের কর্মী ছিলেন।
সুদীপ্ত সালাম: টেলিভিশনের ভিডিও ফুটেজে আরও একজনকে দেখা গেছে অস্ত্র হাতে। তিনি ছাত্রলীগের আগের কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সুদীপ্ত সালাম বলে নিশ্চিত করেছে ক্যাম্পাসের একাধিক সূত্র। সুদীপ্ত সালাম এমবিএ করছেন।
গত বছরের ২১ এপ্রিল সন্ধ্যায় রাজশাহী নগরের সাধুর মোড় এলাকার একটি ছাত্রাবাস থেকে সুদীপ্তকে পিস্তল ও বান্ধবীসহ আটক করে এলাকাবাসী পুলিশে সোপর্দ করেন। পুলিশ তখন শুধু অসামাজিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা দেয়।
জানতে চাইলে বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, পিস্তলটি সালামের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়নি। পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এ জন্য তাঁর নামে অস্ত্র আইনে মামলা দেওয়া হয়নি।
পুলিশ পেটানোর অভিযোগও আছে সুদীপ্তের বিরুদ্ধে। ২০১১ সালের ৩০ ডিসেম্বর শাহ মখদুম হলে এক পুলিশ সদস্যকে মারধর করেন তিনি। তবে এ ঘটনায় তখন কোনো মামলা হয়নি।
অশনাক্ত একজন: অস্ত্রধারী ছয়জনের ছবি প্রথম আলোর হাতে এলেও এঁদের একজনকে গতকাল পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা যায়নি। গত রোববার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ভবনের পশ্চিম পাশের আমবাগান এলাকায় অস্ত্র হাতে এই যুবককে দেখা যায়।
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, ছাত্রলীগের মধ্যে যদি কেউ অস্ত্রবাজি করে থাকেন, তাঁদের চিহ্নিত করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন বলে জানান তিনি। তবে ছাত্রলীগের সভাপতি এ-ও বলেন, তাঁরাও আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন। বর্ধিত ফি প্রত্যাহারের খবর পেয়ে ছাত্রলীগ আনন্দ মিছিল নিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন পর্যন্ত চলে গিয়েছিল। কিন্তু শিবিরের হামলার কারণে তারা ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। তিনি দাবি করেন, শিবিরের নেতা-কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনে ভাঙচুর করেছেন। ছাত্রলীগের ওপর ককটেল হামলা চালিয়েছেন। নিজের শরীরেও স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন দাবি করে তিনি বলেন, তাঁদের দুজন সহসভাপতির চোখ-মুখ ঝলসে গেছে। এ অবস্থায় ছাত্রলীগ প্রতিরোধ করেছে মাত্র।
অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহম্মদ মিজান উদ্দিন বলেন, তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা কাজ করছে। একটু সময় লাগবে। সব ধরনের দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের উপকমিশনার প্রলয় চিসিম প্রথম আলোকে বলেন, গত রোববারের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দুটি ও পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা করেছে। যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছেন, ভাঙচুর করেছেন ও অস্ত্রবাজি করেছেন, তদন্তে সাক্ষ্য-প্রমাণে পরিচয় পাওয়া গেলে মামলার আসামি হিসেবে তাঁরা চলে আসবেন।