ছাত্রলীগের নতুন নেতা বানানোর প্রক্রিয়া এখনও চূড়ান্ত হয়নি। নির্বাচন না সমঝোতার মাধ্যমে হবে নতুন নেতা- তা কেউ নিশ্চিত করতে পারছে না। এ অবস্থায় আগের মতো এবারও ছাত্রলীগের সম্মেলন থেকে শুধু সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা হতে পারে। পরে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করবেন। এ প্রক্রিয়ায় পদ বিক্রি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা আশংকা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, সম্মেলনের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা না হলে অতীতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
মেয়াদ উত্তীর্ণের দু’বছর পর আজ শনিবার শুরু হচ্ছে দুই দিনব্যাপী ছাত্রলীগের ২৮তম জাতীয় সম্মেলন। এবারের সম্মেলনে ছাত্রলীগের নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে বয়স নিয়েও বিভ্রান্তি আছে, আছে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে একজোট হয়েছেন সাবেক ও বর্তমান অনেক নেতা। অঞ্চলভিত্তিক রাজনীতি প্রাধান্য পাচ্ছে। এছাড়া মাদ্রাসা থেকে আসা কাউকে নতুন নেতৃত্বে বিবেচনা করা হচ্ছে না। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের সময় কার ভূমিকা কি ছিল তা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে। এসবের বাইরে নতুন নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে দাবি করেন ছাত্রলীগ নেতারা।
ছাত্রলীগের সভাপতি এইচএম বদিউজ্জামান সোহাগ বলেন, ‘ছাত্রলীগের কাউন্সিল উপলক্ষে নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে। স্বচ্ছতার মাধ্যমেই নতুন নেতা নির্বাচিত হবেন। আমরা কোনো সিন্ডিকেটে বিশ্বাস করি না। এ ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের অভিভাবক বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’ঙ
সংশ্লিষ্টদের মতে, ছাত্রলীগে পদ নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সাধারণত সম্মেলনে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণার পর তাদের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। তারা সাবেক নেতাদের মত ও পরামর্শ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করেন। কিন্তু ছাত্রলীগের সর্বশেষ দুই কমিটির বিরুদ্ধেই পদ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার সুযোগ পাওয়ায় সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ উঠে বলে মনে করেন সাবেক ছাত্র নেতারা।
বর্তমান কমিটি ২০১১ সালে দায়িত্ব নেয়ার পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল ২০১। কয়েক দফায় পূর্ণাঙ্গ কমিটি করায় সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল চার শতাধিক বলে অভিযোগ করেন ছাত্রলীগ নেতারা। পদ বাণিজ্যের মাধ্যমেই কমিটির কলেবর দ্বিগুণ করা হয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের সময় অনেককে গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে বলে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু বাস্তবে ওই নেতাকে সংশ্লিষ্ট পদ দেয়া হয়নি। ২০১ সদস্যের কমিটিতে তার নাম নেই। ফলে সংগঠনের ওয়েবসাইটেও তাদের নাম ওঠেনি। অথচ ওই নেতার কাছে, সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত পদ প্রাপ্তির বিষয়ে চিঠি আছে। সেই চিঠি ভাঙিয়ে তদবির, চাঁদাবাজি এবং টেন্ডারবাজি করছে বলে তৃণমূল থেকে অভিযোগ উঠেছে। পদ বাণিজ্যের বিষয়টি আরও ওপেন সিক্রেট জেলা ও বিভিন্ন ইউনিট কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে। এ ক্ষেত্রে বড় অংকের টাকার খেলা হয়ে থাকে। ছাত্রলীগের সর্বশেষ পাবনা জেলা ও মিরপুর বাঙলা কলেজের কমিটি গঠন নিয়ে এমন বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠেয় দুই দিনব্যাপী ছাত্রলীগের এই সম্মেলন চলবে আগামীকাল রোববার পর্যন্ত। প্রথম দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এবং পরদিন কাউন্সিল অধিবেশন। সম্মেলনের শেষ দিনে বা পরবর্তী দু-এক দিনের মধ্যেই নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করা হবে। সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর চমক হিসেবে এবারই প্রথমবারের মতো সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন প্রযুক্তিবিদ সজীব ওয়াজেদ জয়। পরদিন অনুষ্ঠিত হবে কাউন্সিল অধিবেশন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ছাত্রলীগের সাবেক নেতারা বলেন, প্রতিটি সম্মেলনের আগে নেতৃত্ব প্রত্যাশীরা নিজ নিজ প্যানেল ঘোষণা করেন। ২০১১ সালের সম্মেলনে দুটি প্যানেল ছিল। কিন্তু এবার সম্মেলনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলেও শুক্রবার রাত পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়নি নেতৃত্ব প্রত্যাশী কোনো প্যানেল। মূলত কোন প্রক্রিয়ায় নতুন নেতৃত্ব আসবে তা নিয়ে দ্বিধার কারণেই প্যানেল ঘোষণা করছেন না সংশ্লিষ্টরা। এ বিষয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ সংশ্লিষ্টরা অন্ধকারে। কেউ বলতে পারছেন না নির্বাচন নাকি সমাঝোতায় নতুন কমিটি হবে। গঠনতন্ত্রে কাউন্সিলরদের ভোটে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রীতি অনুযায়ী ছাত্রলীগের প্রতিটি সম্মেলনে প্রথমে সমাঝোতার মাধ্যমে শীর্ষ দুই নেতা চূড়ান্তের চেষ্টা করা হয়। সমাঝোতা ব্যর্থ হলে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার মত নেয়া হয়। তিনি সমাঝোতা বা নির্বাচন যে কোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন।
তবে এবার নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আনতে মরিয়া আলোচিত সিন্ডিকেট। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অভিযোগ, একটি প্রহসনের নির্বাচন করার জন্য পছন্দের ব্যক্তিদের কাউন্সিলর বানিয়ে পছন্দের প্রার্থীদের জেতানোর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছে এ সিন্ডিকেট। রংপুর জেলা থেকে পাঠানো কাউন্সিলর তালিকা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ মাত্র ৪ জন কাউন্সিলর হিসেবে আছেন। বড় বড় পদধারী নেতাদের বাদ দিয়ে কমিটির বাইরের ২১ জনকে কাউন্সিলর মনোনীত করে তালিকা পাঠানো হয়েছে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া কাউন্সিলর তালিকা তৈরির বিষয়টি বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এ কারণে সিন্ডিকেট বিরোধীরা চাচ্ছেন, এবার নির্বাচন নয়, সমাঝোতার মাধ্যমে অথবা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা নতুন নেতাদের নাম ঘোষণা করুন।
নেতৃত্ব প্রত্যাশীরা বলেন, এবার বয়স নিয়েও ধূম্রজাল তৈরি করা হয়েছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নেতৃত্ব প্রত্যাশীদের বয়সসীমা সাতাশ হলেও ছাত্রলীগের আলোচিত সিন্ডিকেট মৌখিকভাবে তা বাড়িয়ে ২৯ বছর করেছে। সেই বয়স সীমাতেই (২৯ বছর) গত দুই কমিটির নেতৃত্ব আসে। কিন্তু এবার নেতৃত্ব প্রত্যাশী অনেকের অভিযোগ যথাসময়ে সম্মেলন হলে তারা শীর্ষ দুই পদে প্রতিযোগিতার সুযোগ পেতেন। কিন্তু দুই বছর পর সম্মেলন হওয়ায় তাদের বয়স পার হয়ে গেছে। বিশেষ করে অন্যতম যুগ্ম সম্পাদক শামসুল কবীর রাহাত ও তার অনুসারীদের অভিযোগ, তার বয়স (রাহাতের) ২৯ বছর পূর্ণ হয়েছে জুনে। তাকে বাদ দিতে ইচ্ছে করেই জুলাইয়ে সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে।
বরাবরের মতো এবারের সম্মেলন নিয়েও চলছে নানা মেরুকরণ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অন্যান্যবারের মতো এবার আওয়ামী লীগের কাউকে ছাত্রলীগের দায়িত্ব দেননি। সম্মেলনে সিন্ডিকেটের বাইরে থেকে নেতৃত্ব বের করে আনতে একাট্টা পুরো ছাত্রলীগ। সিন্ডিকেটভুক্তরা ছাড়া সবাই মনে করেন ছাত্রলীগকে সঠিক পথে আনতে নতুন নেতৃত্ব হতে হবে সিন্ডিকেটমুক্ত। এ লক্ষ্যে তারা তৎপরতাও চালিয়ে যাচ্ছেন। এ তৎপরতায় যুক্ত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিম, ছাত্রলীগের সাবেক দুই সভাপতি বাহাদুর ব্যাপারী ও মাহমুদ হাসান রিপন এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু প্রমুখ।
আওয়ামী লীগ এবং ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতারা সংগঠনের নেতৃত্বে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। যাতে কেউ অনুপ্রবেশ করতে না পারে সে লক্ষ্যে মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের কাউকে নতুন নেতৃত্বে বিবেচনা করা হচ্ছে না। এমনকি যাদের বিরুদ্ধে শিবির-ছাত্রদলসহ বিতর্কিত সংগঠন এবং বিতর্কিত কাজ করার অভিযোগ আছে তাদের সম্পর্কেও খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।
এদিকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মাহমুদ হাসান রিপন ও বর্তমান সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ এবং সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলমকে কিছু নতুন নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেতৃত্ব বেছে নিতে এবং গত দুই কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের এলাকা এড়িয়ে অন্যান্য এলাকা থেকে নতুন নেতৃত্ব আনার পরামর্শও দেন। সেক্ষেত্রে বৃহত্তর ফরিদপুর, রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলের নেতৃত্ব প্রত্যাশীদের অগ্রাধিকার থাকছে। তবে এটাকেও সিন্ডিকেটের নতুন প্রপাগান্ডা বলে মনে করছেন সিন্ডিকেট বিরোধীরা।
ছাত্রলীগের সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগও অঞ্চলের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘নেত্রী এ ধরনের কোনো কথা বলেননি। নেত্রী বলেছেন, যারা মেধাবী, যোগ্য এবং দলের জন্য পরিশ্রম ও ত্যাগ করেছেন তাদের নেতা বানাতে’।
এদিকে সম্মেলন ঘিরে ছাত্রলীগের প্রস্তুতিও চূড়ান্ত। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ও ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি জয়দেব নন্দী যুগান্তরকে জানান, তার নেতৃত্বে গত সাত দিন নেতাকর্মীরা অমানুষিক পরিশ্রম করে প্রস্তুতির সব কাজ শেষ করেছেন। মঞ্চ প্রস্তুত। কাউন্সিলর তালিকা সম্পন্ন হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ, সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট, শোক প্রস্তাবসহ সব ধরনের প্রকাশনা হাতে এসে পৌঁছেছে। প্রায় সাত হাজার ডেলিগেটকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে ছাত্রদলের নেতাদেরও।
নন্দীর দেয়া তথ্য মতে, দেশে ১০১টি ইউনিটে কাউন্সিলরের সংখ্যা ২৫২৫। তবে বিদেশের ১১টি ইউনিট থেকে ২৫ জন করে নাও আসতে পারেন। যে ক’জন আসবেন তাদের কাউন্সিলর হিসেবে গণ্য করা হবে।
ছাত্রলীগের শীর্ষ পদে আসতে এবার মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন ২৪১ জন। এর মধ্যে সভাপতি পদে ৭৮ এবং সাধারণ সম্পাদক পদে ১৬৩ জন ফরম কিনেছেন। তবে, ইতিমধ্যে সভাপতি পদে ১৭টি এবং সাধারণ সম্পাদক পদে ২১টি মনোনয়ন ফরম বাতিল করেছে নির্বাচন কমিশন।
ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনেও আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ! : আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে ছাত্রলীগকে ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হিসেবে মর্যাদা দেয়া হয়েছে। অবশ্য এর আগেই আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদটি ছেড়ে দেন। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনার হাতেই নতুন নেতৃত্বের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। বৃহস্পতিবার রাতে ছাত্রলীগের তিন নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখাও করেন। সংগঠনটির সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ, শুক্রবার যুগান্তরসহ একাধিক গণমাধ্যমকে বলেন, ছাত্রলীগের অভিভাবক শেখ হাসিনা। এ সংগঠনের বিষয়ে তার মতামতই চূড়ান্ত। ছাত্রলীগ নেতাদের এ ধরনের বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনে। তারা বলছেন, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন হওয়ার পরও ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের হাত থেকে বের হতে পারেনি।