২০১১ সালের ১ নভেম্বর সন্ত্রাসীরা শহরের জেলা আওয়ামী লীগের অস্থায়ী কার্যালয়ে প্রবেশ করে প্রকাশ্যে গুলি করে তাঁকে হত্যা করে। ব্যাপক জনপ্রিয় লোকমান হোসেনকে দ্বিতীয়বারের মতো পৌর মেয়র নির্বাচিত হওয়ার মাত্র আট মাসের মাথায় নির্মমভাবে খুন হতে হয়। সেদিনের ঘটনা মনে করে আজও আঁতকে ওঠেন নরসিংদীবাসী।
লোকমান হোসেনের দুই শিশুসন্তান সালফি ও নাজার এখন সময়ও কাটে বাবার ছবি দেখে। বাবার প্রতীক্ষায় প্রহরের পর প্রহর কেটে যায়, কিন্তু বাবা আর ফিরে আসে না। লোকমানের স্ত্রী তামান্না নুসরাত বুবলীর চোখের পানিও এখন শুকিয়ে গেছে। স্বামীর স্মৃতি বয়ে হত্যার বিচারের আশায় আছেন। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তিই তার একমাত্র চাওয়া।
নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার পলাশতলী ইউনিয়নের মেঝেরকান্দি গ্রামের শাহ্ নেওয়াজ ভূঁইয়ার ছেলে লোকমান হোসেন ছিলেন তরুণ রাজনীতিবিদ।কলেজ জীবন থেকেই জড়িয়ে পড়েন রাজনীতিতে। ২০০৪ সালে নরসিংদী জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন প্রথম পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন । ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ডের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে তোলেন।
২০১১ সালের ১৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বিপুল ভোটের ব্যবধানে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়র নির্বাচিত হন । আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সাবেক পৌর চেয়ারম্যান আবদুল মতিন সরকারকে ১৯,৯০০ ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন।
লোকমান মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর নরসিংদী পৌরসভাকে নতুন করে সাজিয়েছিলেন। শহরের সড়ক, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, ঈদগাহ, শহীদ মিনার, বাস টার্মিনাল, মোড়ে মোড়ে ভাস্কর্য স্থাপনসহ সব কিছুতেই তার স্পর্শে আলাদা রূপ ফিরে পেয়েছিল।
শহরের আধুনিক সাজ এবং ট্যাক্স আদায়ে ভাল পারফরম্যান্সে জাতীয়ভাবে ২০০৬ সালে নরসিংদী পৌরসভা শ্রেষ্ঠ স্থান দখল করে । ২০০৮ সালে এডিবির বিবেচনায় বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ মেয়রের পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ঢাকা বিভাগীয় মেয়র সমিতির সভাপতিও ছিলেন। দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার মাত্র আট মাসের মাথায় তিনি ঘাতকের নির্মমতার শিকার হন। হত্যাকান্ডের দুই দিন পর লোকমান হোসেনের ছোট ভাই বর্তমান পৌর মেয়র কামরুজ্জামান কামরুল বাদী হয়ে সাবেক মন্ত্রী রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ভাই সালাউদ্দিন আহমেদ বাচ্চুকে প্রধান আসামি করে ১৪ জনের বিরুদ্ধে নরসিংদী সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার দুই মাসের মধ্যে বিদেশে অবস্থানরত মামলার অন্যতম আসামি মোবারক হোসেন মোবা ছাড়া সব আসামি একে একে আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিনে বের হয়ে যান।
মেয়র লোকমানের স্ত্রী ও অবুঝ দুই সন্তান
আট মাস তদন্ত শেষে এজাহারভুক্ত ১৪ জন আসামির মধ্যে প্রধান আসামিসহ ১১ জনকে বাদ দিয়ে এজাহারবহির্ভূত ১২ জনকে যুক্ত করে নরসিংদী চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির ওসি মামুনুর রশিদ মন্ডল। স্বাভাবিকভাবেই এ অভিযোগপত্রে সন্তুষ্ট হতে পারেননি লোকমান পরিবার। বাদীপক্ষ থেকে অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নারাজি আবেদন জানানো হলে বিজ্ঞ আদালত উক্ত নারাজি আবেদন খারিজ করে দেন। পরে বাদী জেলা জজ আদালতে রিভিউ পিটিশন দাখিল করলে তাও খারিজ করে দেওয়া হয়।
আবেদন খাজির হওয়ার পর উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হন মামলার বাদী । বর্তমানে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় নিম্ন আদালতে থমকে আছে চাঞ্চল্যকর লোকমান হত্যা মামলার বিচারকাজ।
তবে পুলিশি তদন্তে এ হত্যা মামলার এজাহারবহির্ভূত আসামি কিলার শরিফ বলে খ্যাত শরিফুল ইসলাম শরিফ ও তার অপর তিন সহযোগীকে অস্ত্র মামলায় ১০ বছরের কারাদন্ড প্রদান করেন আদালত।
মামলার বাদী কামরুজ্জামান বলেন, ‘বর্তমানে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশে রয়েছে মামলাটি। যতক্ষণ পর্যন্ত লোকমান হত্যার যথাযথ বিচার না হবে ততক্ষণ আইনি লড়াই চালিয়ে যাব। এ জন্য নরসিংদীবাসী আমার পাশে রয়েছেন।’
লোকমানের স্ত্রী তামান্না নুসরাত বুবলী বলেন, ‘মেয়র লোকমান হত্যার বিচার না হলে মানুষ রাজনীতির প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলবে। আমার মতো আজ প্রতিটি নরসিংদীবাসীর চাওয়া লোকমান হত্যার সঠিক বিচার।’
নরসিংদী জজকোর্টের পাবলিক প্রসিকিউটর মো. ফজলুর রহমান জানান, পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে বাদীপক্ষ থেকে উচ্চ আদালতে নারাজি আবেদন জানানো হয়েছে। বাদীপক্ষের সহযোগিতা ও বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনা পেলে দ্রুত এই হত্যা মামলার বিচারকাজ সম্পন্ন করা যাবে।