১৭৮৭ সালের আগ পর্যন্ত তিস্তা নদীই ছিল উত্তরবঙ্গের প্রধান নদী। এই নদীর উচ্ছলতায় উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি ছিল শীতল, শান্ত ও মায়াময়। আবহাওয়া ছিল সহনীয় মাত্রায়। কিন্তু পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুঁয়েমি, ঢিলেমি ও হটকারিতার ফলে তিস্তা এখন মরুভূমি। রুক্ষ হয়ে উঠেছে পরিবেশ ও প্রকৃতি। তলদেশে অজস্র পাথর, নুরি, বালু আর পলি পড়ে তিস্তার বুকজুড়ে শুষ্ক মওসুমে বালু আর বালু। অন্য দিকে বর্ষাকালে মূল গতিপথ বদলিয়ে তিস্তা প্রচ-ভাবে আঁছড়ে পড়ে দুই তীরে। ফলে নির্দয় ভাঙনে ফি বছর তিস্তা তীরের ২০ হাজার মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদি জমি হারিয়ে পথের ভিখারি হন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নদীর প্রবাহ পথে বিশাল চর ও উভয় তীরে ভাঙনের তা-বে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে এর প্রস্থ কোনো কোনো স্থানে পাঁচ কিলোমিটারেরও বেশি। অন্য দিকে বর্ষাকালে এই নদীর গভীরতা হয় ৫ থেকে ৫০ মিটার। আর শুষ্ক মওসুমে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১ মিটারে। সরেজমিন তিস্তা নদীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, শুষ্ক মওসুমে তিস্তায় কোনো পানি থাকে না। ফলে দুই পাড় ও পার্শ¦বর্তী এলাকার প্রায় অর্ধকোটি মানুষ রুক্ষ প্রকৃতির কবলে পড়ে দিশেহারা।
পরিবেশবাদিরা বলেছে, তিস্তায় পানি না থাকার কারণে এই অঞ্চলের ধরলা, ঘাঘট, যমুনেশ্বরী, আখিরা, দুধকুমর, বুড়ি তিস্তাসহ প্রায় ৩৩টি ছোট বড় নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ায় রংপুর অঞ্চলে ভূগর্ভের পানির স্তর নেমে গেছে মাত্রাতিরিক্তভাবে। স্বাধীনতার পর থেকে এই অঞ্চলে পানির স্তর নিচে নামতে নামতে তা এখন ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। ফলে টিউবওয়েল, গভীর, অগভীর নলকূপে পানি উঠছে না। অন্য দিকে এই অঞ্চলে চিরচেনা প্রায় অর্ধশতাধিক প্রজাতির মৎস্য সম্পদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ৫৫ প্রকার পাখপাখালিসহ গাছপালার প্রজাতি ধ্বংস হয়েছে। ভ্যাপসা গরমের সাথে তীব্র তাপদাহ আর মাত্রাতিরিক্ত ঠা-ার কারণে জীববৈচিত্র্য নষ্টের পাশাপাশি মানুষের জীবনযাপনে এক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া হয়ে গেছে ওলটপালট। ফলে তিস্তা নদী ও নদী অববাহিকা এলাকায় ধান, পাট, ভুট্টা, আখ, শাকসবজি চাষ করেও কৃষকেরা খরা-বন্যার তা-বে বিপর্যস্থ হচ্ছেন প্রতিনিয়তই।
অন্যদিকে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়ায় দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা সেচপ্রকল্প স্থবির হয়ে পড়েছে। সূত্রে প্রকাশ, তিস্তা সেচপ্রকল্প এলাকায় সেচ দেয়া এবং নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে তিস্তায় পানির স¦াভাবিক প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ২০ হাজার কিউসেক। শুধু সেচপ্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য চার হাজার কিউসেক পানি প্রবাহ থাকা প্রয়োজন। কিন্তু ডিসেম্বরের পর থেকে তিস্তায় পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যায়। এই সময়ে ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তায় পানির প্রবাহের মাত্রা গত বছরগুলোতে ছিল গড়ে ৭০০ কিউসেকের কিছু ওপরে। ফলে সেচপ্রকল্প এলাকায় সাত লাখ হেক্টর জমিতে প্রতি বছরই পানির তীব্র সঙ্কট বিরাজ করে।
এ কারণে গত ৪০ বছরে এই অঞ্চলের হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে, যা এই অঞ্চলের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। তিস্তার উৎপত্তি ভারতের সিকিমে। গজলডোবা ছাড়াও এই নদীর উজানে অর্থাৎ ভারতের অংশে তিনটি বাঁধ দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুটি ভারতের সিকিমে, অপরটি সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের মাঝামাঝি স্থানে। এরপর বাংলাদেশ সীমান্তে তিস্তা ব্যারাজ।
ভারতের উত্তর সিকিমের সো লামো হ্র্রদ থেকে শুরু হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ৫৪টি নদীর অন্যতম এই তিস্তা। ৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও খরস্রোতা তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়েছে।
বাংলাদেশে এর দৈর্ঘ্য ১২৪ কিলোমিটার। ফলে এটি শুধু স¦াধীন একটি নদীমাত্র নয়, তিস্তা বাংলাদেশেরও নদী এবং তা ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রবাহেরও অন্যতম উৎস। তিস্তার প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া মানেই ভাটিতে বাংলাদেশের তিস্তার অপমৃত্যু এবং সেই সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র তথা যমুনার প্রবাহ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। এই নদীর অস্তিত্বের সঙ্গে বিস্তীর্ণ এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ নির্ভরশীল। বর্তমানে তিস্তার অবস্থা দাঁড়িয়েছে একটি মরা খালের মতো। তিস্তা চুক্তির বিষয়টি কখনোই খোলাসা করে বলেনি ভারত।
খসড়া চুক্তি অনুযায়ী শিলিগুড়ি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে ভারতের গজলডোবা পয়েন্টে তিস্তায় প্রবাহিত পানির পরিমাণ হিসাব করে দু’দেশের মধ্যে পানিবণ্টন হবে। ৪৬০ কিউসেক হারে পানির সঞ্চয় রেখে বাকি পানির ৫২ শতাংশ নেবে ভারত, ৪৮ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ। কিন্তু পরদিনই ভারতের লোকসভার সদস্যের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তিস্তার পানির ৭৫ শতাংশ ভারত নেবে এবং ২৫ শতাংশ বাংলাদেশ পাবে।
বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণ শেষ হওয়ার অনেক আগেই ভারত গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার শুরু করে। ব্যারাজের মূল কাজ যেহেতু পানি সরানো তাই বাংলাদেশ তিস্তা ব্যারাজের জায়গায় যতটুকু প্রবাহ আশা করেছিল, ভারতের পানি প্রত্যাহারের কারণে তা অনেক কমে যায়। প্রমাণ হলো ভারত তাদের স¦ার্থ থেকে একচুলও নড়তে রাজি নয়।
প্রসঙ্গত বর্তমান ভারতবান্ধব সরকারের আমলে আর তিস্তা চুক্তির আশা করা যায় না। এটা বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা। সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন জনগণ আশা করেছিল, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ব্যাপক উন্নয়ন হবে। এই সুসম্পর্কের মাধ্যমে আমরা উভয় দেশ লাভবান হবো। তবে বাস্তবে জনগণের আশা আর সরকারের অর্জনের মধ্যে ব্যবধান খুব বেশি। আর এই ব্যবধান দেশের জন্য অনেক ক্ষতিকর হয়েছে। সরকার ভারতকে একপাক্ষিক প্রতিদান দিয়েছে। অথচ কূটনীতির নিয়ম হচ্ছে, কোনো কিছুর বিনিময়ে কোনো কিছু দেয়া। সরকার জাতীয় স¦ার্থকে উপেক্ষা করে ভারতকে শুধু দিয়েই গেছে। ভারত চাচ্ছে বাংলাদেশ থেকে একপাক্ষিকভাবে নিতে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে দক্ষ হওয়া উচিত ছিল। তবে গত পাঁচ বছরে সরকার সেই দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। এবারও পারবে না তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সরকারের অতিরিক্ত ভারতপ্রীতি, ভারত নির্ভরতা, ভারত আস্থা তথা নতজানু পররাষ্ট্রনীতিই এর পেছনে মূল কারণ। এক্ষেত্রে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি ও সক্রিয়তা তৈরির কোনো বিকল্প নেই।