সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) ভিসি ড. আমিনুল ইসলামের অপসারণের দাবিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ আন্দোলনরত একাংশের শিক্ষকদের পেটালো ছাত্রলীগ। গতকাল রোববার সকাল ৮টায় ভিসি ভবনের সামনে এ হামলার শিকার হন ড. জাফর ইকবালের স্ত্রী ড. ইয়াসমিনসহ অন্তত ১০ শিক্ষক।
শাবি সূত্রে জানা যায়, রোববার সকাল ৯টা থেকে ভিসি ভবনের সামনে শিক্ষকদের পূর্ব নির্ধারিত অবস্থান কর্মসূচি ছিল। ভিসির অপসারণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ’র ব্যানারে আন্দোলন করে আসছিল কিছুসংখ্যক শিক্ষক। সকাল ৬টা থেকেই ভিসি ভবনের সামনে অবস্থান নেয় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সকাল ৭টার দিকে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা ভিসি ভবনের সামনে উপস্থিত হলে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা নিজেদেরকে সাধারণ শিক্ষার্থী দাবি করে শিক্ষকদের ভিসির কার্যালয়ের সামনে থেকে চলে যেতে বলে। চলে না গেলে কিছুক্ষণের মধ্যে ভয়াবহ অবস্থার রূপ ধারণ করবে বলে হুঁশিয়ার করে দেয় তারা। এ সময় ছাত্রলীগ সহ সভাপতি আবু সাঈদ আকন্দ, সহ সভাপতি অঞ্জন রায় ও যুগ্ম সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম সবুজসহ বেশকিছু সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। সকাল আটটায় ভিসি আমিনুল ইসলাম ভূইয়া তার কার্যালয়ে আসলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা ভিসিকে তার কার্যালয়ে প্রবেশে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেন। শিক্ষকদের বাধাকে ভ-ুল করে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ভিসি ড. আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়াকে নিয়ে তার কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। ভিসি প্রবেশের পরপরই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর চড়াও হন। এক পর্যায়ে তারা আন্দোলনকারী শিক্ষকদের ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে মারধর ও লাঞ্ছিত করেন। এতে লাঞ্ছিত হন ড. জাফর ইকবালের স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হক, অধ্যাপক মো. ইউনুছ, দীপনে দেবনাথ, সৈয়দ সামসুল আলম, মো. ফারুক উদ্দিন, মোস্তফা কামাল মাসুদ, মোহাম্মদ ওমর ফারুকসহ অন্তত ১০ জন শিক্ষক। এ সময় একজন শিক্ষককে লাথিও মারে ছাত্রলীগের ছেলেরা।
এদিকে, আন্দোলনরত শিক্ষকদের উপর গতকাল রোববার সকালে হামলার ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি বলেন, জয় বাংলা স্লোগানকে অপমান করছে ছাত্রলীগ। জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। আর আজ জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ছাত্রলীগ শিক্ষকদের উপর হামলা করলো। ড. জাফর ইকবাল বলেন, আজকে যারা আমাদের শিক্ষকদের উপর হামলা করলো তারা যদি আমার ছাত্র হয় তাহলে আমার গলায় দড়ি দিয়ে মরা উচিত। আমি তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছি। যারা একটু একটু করে বিশ্ববিদ্যালয়কে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে তাদেরকেই পেটানোর দৃশ্য আমাকে দেখতে হলো। আজ যা ঘটলো আমি আমার জীবনে এমনটা কখনো কল্পানাও করতে পারি না।
শিক্ষকদের আন্দোলন সম্পর্কে তিনি বলেন, “তারা যে কারণে আন্দোলন করছে, আমি তা ১০০ ভাগ সমর্থন করি। এ ভিসি যোগদানের দু’মাস পর আমি তার সঙ্গে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছি। কারণ আমি দেখেছি, উনি মিথ্যা কথা বলেন। যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলে, তার সঙ্গে কাজ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
হামলার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “আজ আমার জীবনে একটা নতুন অভিজ্ঞতা হলো। আজ যা দেখলাম, আমার জীবনে এ ধরনের ঘটনা দেখবো তা আমি কখনও কল্পনা করিনি।”
“কীভাবে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আমার শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করতে পারলো, আর আমাকে সেটা এখানে বসে বসে দেখতে হলো!”
এই শিক্ষক অভিযোগ করেন, ভিসিই ছাত্রলীগকে শিক্ষকদের ওপর ‘লেলিয়ে’ দিয়েছেন।
“তিনি যদি মনে করেন, এভাবে আন্দোলন থামানো সম্ভব, তবে সেটা ভুল করছেন। শিক্ষকরা আন্দোলন করছেন কোনো পদের জন্যে নয়, শাবিকে বাঁচানোর জন্যে।”
কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ, অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ এনে ভিসির পদত্যাগ দাবিতে গত ১২ এপ্রিল থেকে আন্দোলনে রয়েছে সরকার সমর্থক শিক্ষকদের একাংশের জোট ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষক পরিষদ’।
তাদের এ আন্দোলনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি ‘অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র’ আখ্যায়িত করে ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্ত চিন্তার চর্চায় ঐক্যবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’ ব্যানারে ভিসির পক্ষে রয়েছেন সরকার-সমর্থক শিক্ষকদের আরেকটি অংশ।
অচলাবস্থা কাটাতে দুই পক্ষের সঙ্গেই বৈঠক করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। নিয়োগ, নতুন ব্যবস্থা চালু বা কাউকে নতুন কোনো পদে দায়িত্ব দিতে নিষেধ করে ভিসির ক্ষমতা কার্যত খর্বও করা হয়েছে। তারপরও ভিসি পদ না ছাড়ায় শিক্ষকরাও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।
ঘটনার সময় জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন দুই পক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হন তিনি।
জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হলেও তিনি এ বিষয়ে ‘কমেন্টস’ করতে রাজি হননি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জীবন চক্রবর্তী পার্থ জানিয়েছেন শিক্ষকদের আন্দোলনে বাধা দেয়া ছাত্রলীগের কোনো সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত ছিল না। ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে শিক্ষার্থীরা এতে অংশ নিয়েছে।