বলা হয়, যেখানেই দল আছে সেখানেই কোন্দল আছে। বাংলাদেশে হাতেগোনা একটি কি দুটি দল ছাড়া বাকি সব বড় দলই অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত। আর ছাত্রলীগের জন্য তো এটি আরো পুরোনো ব্যাপার। ১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে ‘সেভেন মার্ডারস’ এর মাধ্যমে ছাত্রলীগের ইতিহাসে কোন্দল বা অভ্যন্তরীণ বিরোধ চূড়ান্ত রুপ ধারণ করে। যা আজ অবধি বিদ্যমান। শুধু বিদ্যমান বললে ভুল হবে। শুধুমাত্র এ বছরেই অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার পঁচিশেরও অধিক নেতাকর্মী । আর আহতের সংখ্যা অর্ধ সহস্রের ছুঁইছুঁই।
১৯৭৪ সালে তৎকালীন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান ডাকসু নির্বাচন কেন্দ্রিক বিরোধের জেরে ৪ এপ্রিল মুহসীন হলের সাত জন নেতাকর্মীকে রাতের অন্ধকারে একটি কক্ষে আবদ্ধ করে গুলি করে হত্যা করে। সেই থেকেই শুরু ছাত্রলীগের কোন্দলের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যর পর কিছুদিনের জন্য ছাত্রলীগ আত্মগোপনে থাকলেও পরবর্তীতে মেজর জিয়ার নতুন সংবিধানে সকল দল নির্বাচনের সুযোগ পায়। সে থেকেই ছাত্রলীগের দৌরাত্ব্যে অতিষ্ঠ বাংলাদেশের মানুষ। ব্যক্তিগত শত্রুতা, টেন্ডার, আধিপত্য বিস্তার এসবকে কেন্দ্র করে সব সময় নিজেদের মধ্যে একটা টানাপোড়ানে থাকে ছাত্রলীগ। প্রায়শই এই টানাপোড়ান সহিংসতায় রুপ নেয়। শুধুমাত্র গত দশ বছরের পরিসংখ্যানটা দেখলেই বুঝতে পারব এর ব্যপকতা কতটা মারাত্মক।
২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গত দশ বছরে প্রথম আলো ও যুগান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ওই বছর থেকে গত ১৮ ই নভেম্বর পর্যন্ত ছাত্রলীগের সঙ্গে প্রতিপক্ষ বা নিজেদের মধ্যে প্রায় ৬৫০ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১০৭ জন নিহত হন শুধুমাত্র নিজেদের কোন্দলে। যার মধ্যে ২০০৯ সালে ৪ জন, ২০১০ সালে ১২, ২০১১ সালে ৫, ২০১২ সালে ৮, ২০১৩ সালে ৩, ২০১৪ সালে ৮, ২০১৫ সালে ৭ জন, ২০১৬ সালে ১৭ জন, ২০১৭ সালে ৯ জন আর ২০১৮ সালেই ২৮ জন মারা গেছেন। আরও সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে, ২০১৮ সালের জানুয়ারীতে ৫, ফেব্র“য়ারীতে ১, মার্চে ২, এপ্রিলে ৩, মে’তে ১, জুনে ৩, জুলাইয়ে ২, আগস্টে ৪, সেপ্টেম্বরে ২, অক্টোবরে ৫ জন মারা যান অন্তঃকোন্দলে । এছাড়া আহতের সংখ্যা অসংখ্য। শুধুমাত্র গত পাঁচ বছরেই অন্তঃকোন্দলে আহতের সংখ্যা ১১০০ র অধিক। আর ১০ বছরে কত হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।
৩১ মার্চ, ২০০৯ তারিখেই প্রথম অন্তঃকোন্দলের শিকার হোন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র কলেজে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ ওরফে রাজীব। নিজেদের মধ্যে সংঘাত করতে গিয়েই তাকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করে নিজের দলেরই ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। এ সময় আহত হন আরো ৫০ জন ।
অন্তঃকোন্দলসহ এই দশ বছরে শুধুমাত্র ছাত্রলীগের হাতে খুন হয়েছে ১৮০ জনেরও অধিক মানুষ। যার মধ্যে আছে সাধারণ শিক্ষার্থী, শিশু, সাংবাদিক, পথচারি। ২০১০ সালের আলোচিত অন্তঃকোন্দলের ঘটনা , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবায়ের হত্যা। ৮ জানুয়ারি, ২০১০ সালের রবিবার। জুবায়ের আহমেদ ক্যাম্পাসে এসেছিলেন ফাইনাল সেমিস্টারের শেষ পরীক্ষা দিতে । কিন্তু পূর্ব শত্রুতার জের ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের ভিসি গ্রুপ হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগ ক্যাডার আশিকুল ইসলাম, খান মো রইস, রাশেদুলসহ ১২-১৩ জন জুবায়েরকে নির্মাণাধীন ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রের পেছনে নিয়ে রড দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে ফেলে আসে। সেখানে অতিরিক্ত রক্তরক্ষণে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্লিপ্ত ।
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ২১ তারিখে তেজগাঁও পলিটেকনিকে ফাও খেতে গিয়ে সংঘর্ষ বাধিয়ে রাইসুলকে ও ২১ জানুয়ারি, ২০১২ তারিখে পাবনায় দলীয় কোন্দলের জের ধরে ছাত্রলীগ কর্মী শান্তকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করা হয়। ছাত্রলীগের সম্মেলনে নেতৃত্ব ও সমর্থনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জের ধরে এদিনে ঈশ্বরদীতে এ ছাত্রলীগ কর্মীকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ।
২৯ নভেম্বর, ২০১৩ ইং রাত ১২টার দিকে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের সভাপতি ফুয়াদ হাসান পল্লব এবং সাধারণ সম্পাদক সাকিব আল হাসান সুইম গ্র“পের মধ্যে গোলাগুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে রকিব আল ফারুক (২৬) নামে এক সুইম সমর্থক নিহত হন। তিনি ঢাকা কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মাস্টার্সের ছাত্র ছিলেন।
২০১৪ সালের ৩১ আগস্ট ঢাকায় সমাবেশ শেষ করে ফেরার পথে ট্রেন থেকে ফেলে দিয়ে হত্যা করা হয় চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলা ছাত্রলীগের নেতা তৌকির ইসলামকে। আসনে বসা নিয়ে বিবাদের সূত্র ধরে সাতকানিয়া ছাত্রলীগের কয়েকজন কর্মী তাঁকে ট্রেন থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়। তাঁকে টঙ্গীর নিমতলী থেকে উদ্ধারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে নেওয়ার পর মারা যায় তৌকির। এ ঘটনায় কোনো মামলা পর্যন্ত হয়নি।
এদিকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০৭ সালে শিক্ষা কার্যক্রম অনুযায়ী অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ আছে, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি ও ধূমপানমুক্ত ক্যাম্পাস। কিন্তু ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি শুরু হয়। গত ৩১ শে জুলাই,২০১৬ তারিখে রাজনীতিমুক্ত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন ছাত্রলীগের নেতা খালিদ। মধ্যরাতের এই সংঘর্ষে আহত হয়েছেন অন্তত ১০ জন।
২০১৭ সালের একটি আলোচিত ঘটনা হচ্ছে, ২৭ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহে এলাকার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে শাওন (২৩) নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে কুপিয়ে হাত কেটে আলাদা করে এবং গলাকেটে হত্যা করে অপরপক্ষ। জানা যায়, নিহত শাওন জামালপুর সদর উপজেলার ৭নং ঘোঢ়াধাপ ইউনিয়নের কেজাইকান্দা গ্রামের বাসিন্দা। শাওন শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক উশান গ্রুপের সক্রিয় ছাত্রলীগ কর্মী।
২০১৮ সালের অন্তঃকোন্দলে মৃতের সংখ্যা অন্য যেকোন সময়ের পরিসংখ্যানকে হার মানিয়েছে। মানুষের জীবনের মূল্য যে ছাত্রলীগের স্বার্থের কাছে কতটা মূল্যহীন তা ২০১৮ সালের খতিয়ান না দেখলে বুঝার উপায় নেই। শুধুমাত্র এ বছরেই ছাত্রলীগের হাতে মৃতের সংখ্যা ৩১ জন । তার অধিকাংশই অন্তঃকোন্দলের শিকার। রিপোর্টে দেখা যায়, এ বছরের অন্তঃকোন্দলের প্রথম শিকার হয় নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির দেউটি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মো.শাকিল (২২)। ৯ জানুয়ারিতে আভ্যন্তরীন কোন্দলের জের ধরে একই এলাকার ছাত্রলীগের অন্য গ্র“পের নেতা লিটন তাকে গুলি করে হত্যা করে।
আর সর্বশেষ শিকার বাউফলের ছাত্রলীগ নেতা মামুন গাজী। জানা যায়, ২৭ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে তার ভাগ্নিকে উত্যক্ত করার প্রতিবাদের জের ধরে সেলিম মুন্সীর ছেলে মিরাজ ও জহিরসহ ৮-১০ জনের সংঘবদ্ধ একটি দল ঘটনার দিন মামুন গাজীকে একটি মটরসাইকেল থেকে নামিয়ে টেনেহেচরে কনকদিয়া ইউনিয়নের বীরপাশা সার্বজনীন পুজা দুর্গা মন্দিরের সামনে নিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে বাউফল হাসপাতালে নিয়ে আসার পথে সে মারা যায়। মটরসাইকেল চালক জহিরুল ইসলাম জানান, তার গাড়িতে করেই মামুন গাজী ও তার দুই চাচাতো ভাই বরগুনার তালতলি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় যাচ্ছিলেন।
এছাড়াও ২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারির খুনটি বিশেষভাবে আলোচিত। এতে চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের নোংরা রাজনীতির বলি হয় কলেজিয়েট স্কুলের ১০ শ্রেণীর ছাত্র আদনান ইসফার। স্কুলে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে তাকে হত্যা করে চন্দনপুরা এলাকার ছাত্রলীগ নেতা সাব্বিরের অনুসারী মাঈন।
মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর শুধুমাত্র ছাত্রলীগের নিজেদের কোন্দলেই বলি হয়েছেন অন্তত ১০৭ জন। নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের কাছে নিজেদের ভাই নিরাপদ না হলে এ জাতি, দেশ কিভাবে নিরাপদ হবে?? বাংলাদেশের মানুষ কি এর পুনরাবৃত্তি দেখতে চায়?? অবশ্যই না।