ছাত্রলীগের নিয়োগ বাণিজ্য
শুধু ভর্তি বাণিজ্য, পদ বাণিজ্য করে সন্তুষ্ট নয় ছাত্রলীগ। দেশের কোটি কোটি বেকার ছিল তাদের ব্যবসার টার্গেট। এদেশে চাকরী পাওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। চাকুরী পাওয়ার জন্য তাই সবাই ক্ষমতাসীনদের কাছে দ্বারস্ত হয়। সকল সরকারি চাকুরীর জন্যই এদেশে ক্ষমতাসীনদের ঘুষ দিতে হয়।
এই কাজে আওয়ামী এমপি, মন্ত্রী ও নেতারা বেশি জড়িত থাকলেও পিছিয়ে ছিল না ছাত্রলীগ। এই ক্ষেত্রেও পুরো নিয়োগ বাণিজ্যের চিত্র থেকে গেছে আড়ালে। যেসব ঘটনায় টাকা নেয়া হয়েছে কিন্তু চাকুরী দেয়া হয়নি এমন কিছু ঘটনা ও টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সমস্যা হয়েছে এমন কিছু ঘটনা মিডিয়ায় এসেছে।
যারা টাকার বিনিময়ে চাকুরী পেয়েছেন তারা নিজেদের ধন্য মনে করেছেন তাই তারা এই বিষয়ে চুপ থেকেছেন। গত দশ বছরে পিয়ন, ক্লিনারের চাকুরী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পর্যন্ত সকল চাকুরীতে মোটা অংকের ঘুষ প্রদান করা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। অল্প বেতনের চাকুরীর জন্যও অনেক মোটা অংকের ঘুষ বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে ।
ঘুষ দিয়ে চাকুরী নেয়ার ফলে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতির বেশ প্রসার হয়েছে। প্রত্যেকেই তাদের ঘুষ দেয়া টাকা উদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়েছেন দুর্নীতির মাধ্যমে।
আজই ২৮ নভেম্বর কালের কন্ঠে প্রকাশিত একটি খবরের শিরোনাম, ‘ছাত্রলীগ নেতার আপত্তিতে স্থগিত পবিপ্রবিতে নিয়োগ’। ছাত্রলীগ দাবী করেছে তাদের দেয়া তালিকা থেকেই নিয়োগ দিতে হবে।
২১ জানুয়ারী ১৩ সালে বাকৃবি ছাত্রলীগের নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে জনকন্ঠে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বেপরোয়া হয়ে ওঠার নেপথ্যে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে টেন্ডারবাজি ও শতাধিক পদে কর্মচারী নিয়োগ বাণিজ্য। ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তারসহ পূর্ব শত্রুতার জের ও নিয়োগ বাণিজ্যে প্রশাসন এবং ছাত্রলীগের ভাগ বাটোয়ারা নিয়েই মূলত শনিবারের সংঘর্ষে নিহত হয় আট বছরের শিশু রাব্বি। চলতি সপ্তাহে এ নিয়োগ চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল।
এই নিয়োগকে সামনে রেখে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব লাভে স্বপ্নে বিভোর ও ক্ষমতালোভী মিডলেভেলের একটি পক্ষ আজাদ-ইমন নেতৃত্বের বিভেদকে প্রকাশ্যরূপ দিতে পুরো ঘটনাকে উস্কে দেয়। আর এরকম পরিস্থিতিকে ক্যাম্পাসে নিজেদের শক্তির জানান দিতে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়ার এক পর্যায়ে গুলিবিনিময়ে লিপ্ত হয় ছাত্রলীগের দু’গ্রুপ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মাঠে গরু চড়াতে এসে দুগ্রুপের সশস্র মহড়ার বলি হয়ে লাশ হয় স্থানীয় বয়রা গ্রামের অটো রিকশা চালক দুলালের শিশুপুত্র রাব্বি। অসহায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের কাছে আত্মসমর্পণ করলেও এসব নিয়ে এখন ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী।
তৎকালীন বাকৃবি ভিসি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রফেসর ড. রফিকুল হক জনকণ্ঠকে জানান, এটি ছাত্রলীগের নৈতিক অবক্ষয় ছাড়া আর কিছুই নয়। ছাত্রনেতাদের লেজুড়বৃত্তির কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অফিসার ও কর্মকর্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের জিম্মি কর্তৃপক্ষ অনেক সময় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে না।
২০১২ সালের অক্টোবরে শিক্ষকদের সহায়তায় সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট নেতা কর্মীদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ফ্রন্ট নেতাকর্মীরা বর্ধিত ফী প্রত্যাহারের দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়ে মিছিলসহ প্রশাসনিক ভবনের দিকে আসার পথে পুলিশের উপস্থিতিতে এই হামলা চালিয়েছিল ছাত্রলীগ। নানা প্রতিবাদ ও আন্দোলনসহ এ নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হলেও বহাল তবিয়তে থাকে ছাত্রলীগ। এছাড়া বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ও ফাও খাওয়া নিয়ে রাতারাতি বেপরোয়া হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ।
প্রথম আলোসহ প্রায় সব মিডিয়ার ২০১২ সালে ইবিতে ছাত্রলীগের ভর্তি বাণিজ্য নিয়ে রিপোর্ট করেছে। ২০১২ সালে ইবিতে ৯২ কর্মকর্তা ও কমচারী পদে নিয়োগ শুরু হয়। এসব পদে নিজেদের লোক নিয়োগের জন্য ছাত্রলীগ সুপারিশ করলেও তা রক্ষা না করায় ভাংচুর চালিয়েছে ছাত্রলীগ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন ও টিএসসিসিতে এ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। তার আগের রাতে ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডরমেটরির সামনে রাখা শিক্ষকদের বহনকারী বাস ও অ্যাম্বুলেন্সেও আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
প্রথম আলো থেকে জানা যায়, মোট ৯২ জনের নিয়োগ হওয়ার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসাইন ও সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান নিজেদের পছন্দের কমপক্ষে ২০০ প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে উপাচার্য এম আলাউদ্দিনকে চাপ দিচ্ছেন। এ জন্য উপাচার্যের সঙ্গে গতকাল দুই দফায় দীর্ঘক্ষণ বৈঠকও করেন তাঁরা।
নিয়োগ-বাণিজ্যের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক আবুজর গিফারি গাফফার প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রায় ৭০০ আবেদনকারীর কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা নিয়েছেন। পছন্দমতো প্রার্থীদের চাকরি দিতে তাঁরা প্রশাসনকে চাপ দিচ্ছেন। এ ছাড়া ছাত্রলীগের সাবেক নেতারাও তাঁদের স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনকে চাকরি দেওয়ার জন্য উপাচার্যকে চাপ দিচ্ছেন।
১১ জুলাই ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত ‘ছাত্রলীগ নেতাকে চাকরি দিতে ইবির নিয়োগ বোর্ড স্থগিত’! শীর্ষক প্রতিবেদনে জানা যায়, ইবি’র ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ড চতুর্থবারের মত স্থগিত হয়েছে। সাবেক এক ছাত্রলীগ নেতাকে চাকরির সুযোগ করে দিতেই প্রশাসন এবার শিক্ষক নিয়োগ নির্বাচনী বোর্ড স্থগিত করেছে বলেঅভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই ছাত্রলীগ নেতা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আনিচুর রহমান আনিচ। বর্তমানে তিনি কুষ্টিয়া সদর থানা ছাত্রলীগের আহবায়ক।
১৭ সালের ২৭ এপ্রিল প্রথম আলোর প্রতিবেদনে জানা যায়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিশেষ কর্মকর্তার’ পদ তৈরি করে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ছাত্রলীগের ১২ জন নেতাকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।’ এবং এদের বিশেষ যোগ্যতা ‘এরা ছাত্রলীগ করে’। এর আগেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শত শত নিয়োগ হয়েছে শুধু ‘ছাত্রলীগ করে’ এই যোগ্যতায়।
এর আগে ২০১২ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রলীগের ৩১ জন নেতা-কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন। এর মধ্যে ২২ জন নিয়োগ পেয়েছেন সাবেক উপাচার্য মেসবাহউদ্দিন আহমেদের সময়ে ২০১২ সালে।
জানতে চাইলে উপাচার্য মীজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের চাকরি দিতে আমি বাধ্য। নিয়োগপ্রাপ্ত ওই ১২ জন কঠোর পরিশ্রমী নেতা-কর্মী ছিলেন। এর মধ্যে দুজন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার বাসিন্দা। এটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় পরিচয়।’ তাহলে সাধারণ প্রার্থীদের কী হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্র বা চাকরিপ্রার্থী বলতে কিছু নেই। এখানে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই চাকরি পাবেন। এটাই তাঁদের বিশেষ যোগ্যতা।’
২০১২ থেকে ২০১৫ সালের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে তিনবার। এর মধ্যে গ্রেড-১-এর জন্য একবার ও গ্রেড-২-এর জন্য দুবার। বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক নথিপত্রে দেখা যায়, ২০১২ সালে সেকশন অফিসার গ্রেড-২ পদে নয়জনের জন্য বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ছাত্রলীগের সাবেক ২২ নেতা-কর্মীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তৎকালীন উপাচার্য মেসবাহউদ্দিন আহমেদ।
২০১৩ সালের মার্চে উপাচার্য নিযুক্ত হন মীজানুর রহমান। এর ছয় মাসের মাথায় সেকশন অফিসার গ্রেড-২ পদে চারজন ও স্টোর অফিসার পদে একজনকে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। আবেদন করেছিলেন ছাত্রলীগের ৫০ নেতা-কর্মীসহ ৪৭০ জন। কিন্তু ছাত্রলীগের নয়জনসহ ১১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অন্য দুজন ছিলেন উপাচার্যের ‘পছন্দের কোটার’।