“আওয়ামী লীগের দুর্নীতির শাসনকাল”
শাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের জন্য গত ১০ বছর ছিল বিনষ্ট সম্ভাবনার এক হতাশাব্যঞ্জক দশক। জনগণের জন্য দশকটি ছিল উদ্বেগজনক, আর সরকারের জন্য আত্মঘাতী। দুর্নীতির অভিযোগকে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে অস্বীকার করার প্রবণতা দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের সম্ভাবনাকে পদদলিত করেছে। দুর্নীতির বোঝা জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। দুর্নীতি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। নীতি ও শাসনকাঠামোতে দুর্নীতি-সহায়ক শক্তির প্রভাব ক্রমাগত বেড়েছে। বছরের শেষে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি ও মন্ত্রীদের প্রশ্নবিদ্ধ সম্পদ আহরণের নগ্ন চিত্র প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষমতায় থাকার ফলে পর্বতসম মুনাফা এবং সম্পদ আহরণের এই সুযোগ যে বাস্তবে রাজনৈতিক অঙ্গনের ক্ষমতার লড়াইয়ের মূল প্রণোদনা, তা দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়েছে। সর্বোপরি রাষ্ট্রক্ষমতা একধরনের চৌর্যোন্মাদনার করাভূত হতে চলেছে।
১) সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচার বেড়ে ১০ বছরে পাচার সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা:
১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এই অর্থ এবারের বাজেটের চেয়েও ১ লাখ কোটি টাকা বেশি। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর (এলডিসি) মধ্যে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই।
এর বাইরে গত দুই অর্থবছরে সুইস ব্যাংকসমূহে বাংলাদেশি নাগরিকদের ব্যাংক হিসাবের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। এই অর্থও পাচার করা। আবার মালয়েশিয়ায় ‘মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে গত ১৩ বছরে ৩ হাজার ৬১ জন বাংলাদেশি অর্থ পাঠিয়েছেন।
২) শেভরন থেকে জয় ও তৌফিক এলাহীর দুর্নীতি:
জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরীসহ জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তা ও প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে ৩৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঘুষ গ্রহণের গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। মার্কিন তেল কোম্পানি শেভরনকে বিনা টেন্ডারে ৩৭০ কোটি টাকায় একটি কম্প্রেসার স্টেশন বসানোর কাজ দেয়ার বিনিময়ে এ উৎকোচ গ্রহণ করা হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে তথ্য দেয়া হয়েছে
৩) কুইক রেন্টালের মাধ্যমে দুর্নীতির পুকুরচুরি:
২০০৯ সালে আওয়ামী সরকার দেশের চলমান বিদ্যুত্ সঙ্কট মেটানোর লক্ষ্যে স্থায়ী সাশ্রয়ী পদক্ষেপ না নিয়ে এগিয়ে যায় ব্যায়বহুল কুইক রেন্টাল সিস্টেম স্থাপনে। ফলে একটি সূত্র মতে বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি, বাংলাদেশ বিদ্যুত্ উন্নয়ন বোর্ড) ক্ষতি ২৫,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আওয়ামী সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রাইভেট কুইক রেন্টাল কম্পানি থেকে বেশি দামে বিদ্যুত্ কিনে তা কম দামে বিক্রি করায় প্রতি বছর বিপিডিবি-র ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
কুইক রেন্টাল সিসটেমে যারা জড়িত তাদের মধ্যে নাম এসেছে মন্ত্রী (এবং প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়) কর্ণেল ফারুক খান ও আজিজ গ্রুপ, গার্মেন্টস রফতানিকারক মোহাম্মদী গ্রুপ, ফার্নিচার বিক্রেতা অটবি গ্রুপ, সালমান রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ ইত্যাদি।
৪) শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারী :
শেয়ার বাজার থেকে প্রায় ২৬,০০০ হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। ২০১০-এর শেষ দিকে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারিতে একটি হিসেবে দেশের ৩৩ লক্ষ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি প্রতিটি বিনিয়োগকারীর পেছনে পাঁচজন আত্মীয়-বন্ধু সেকেন্ডারি বিনিয়োগকারী থাকে তাহলে দেশে মোট ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা হবে এক কোটি ৬৫ লক্ষ। অর্থাত্ দেশের এক দশমাংশ জনসংখ্যার কিছু বেশি। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে যান।
এই কেলেঙ্কারিতে যারা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম লোটাস কামাল ও দরবেশ খ্যাত বেক্সিমকো গ্রুপের সালমান এফ রহমান।
৫) ডেসটিনি ও বিভিন্ন এমএল কোম্পানির দুর্নীতি:
৪,০০০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি। দীর্ঘকাল জুড়ে বিভিন্ন দিক থেকে মালটি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কম্পানি ডেসটিনি গ্রুপের বিরুদ্ধে আওয়ামী সরকারকে বারবার সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তারা। সম্ভাব্য কারণ ছিল, এই গ্রুপের প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও কট্টর আওয়ামীপন্থী রূপে পরিচিত সাবেক সেনা প্রধান লে: জে: হারুন-অর-রশিদ।
দুদকের তদন্ত অনুযায়ী, কয়েকটি এমএলএম প্রতিষ্ঠান জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে ৪,৯৬৩ কোটি টাকার কিছু বেশি এবং এর মধ্যে ব্যক্তিগত একাউন্টে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল প্রায় ৪,৬০১ কোটি টাকা। (প্রথম আলো ৯.৯.২০১২)।
৬) হলমার্ক দুর্নীতির কেলেঙ্কারী :
৪,৫০০ কোটি টাকা।
আগস্ট ২০১২-তে বিভিন্ন পত্রিকায় হলমার্ক গ্রুপের জালিয়াতির খবর প্রকাশিত হতে থাকে। জানা যায় সরকারি ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের শেরাটন হোটেল ব্রাঞ্চে (বর্তমানে শেখ হাসিনার দেয়া নাম রূপসী বাংলা হোটেল) বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কুশ্রী অর্থনৈতিক কেলেংকারির পরিমাণ ৩,৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ বা প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে হলমার্ক একাই নিয়েছে প্রায় ২,৬৬৮ কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটিই ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। (প্রথম আলো ৫.৯.২০১২)।
লায়েকুজ্জামান ও জাবেদ রহিম বিজনের দুটি রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার নামটি অপ্রকাশিত থাকে। পরবর্তী সময়ে এই নামটিও প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন চোখের ডাক্তার সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং তিনি স্বীকার করেন শেরাটনের সোনালী ব্যাংক ব্রাঞ্চে তার যাতায়াত ছিল।
৭) বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি:
৮,৫০০ হাজার কোটি টাকা। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর আমলে ব্যাংক থেকে লোন জালিয়াতির মাধ্যমে বের কর হয় ৪,৫০০কোটি টাকা। ২০১৪-২০১৮ সালে আরো ৪,০০০ কোটি টাকা লোন জালিয়াতির মাধ্যমে বের করা হয়। এ প্রসঙ্গে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন এ মাজিদ বলেন, এসব টাকা ফিরিয়ে আনার প্রথম পদক্ষেপ ব্যর্টত হয়েছে।
৮) অগ্রনী ব্যাংক দুর্নীতি:
অগ্রণী ব্যাংকে ৯০০ কোটি টাকার ঋণে অনিয়ম। রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ১৯ শাখা থেকে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণে অনিয়মের তথ্য মিলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পরিচালিত অডিটে বেরিয়ে আসা ওই অনিয়মের বিরুদ্ধে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, অগ্রণী ব্যাংকের রমনা কর্পোরেট শাখার ৩ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে নিয়ে গেছে প্রায় ৫২ কোটি টাকা। এগুলো হল- আহমেদ স্পিনিং মিলসের অনুকূলে ৩০ কোটি টাকা, রবি ফ্যাশনের অনুকূলে প্রায় ৬ কোটি এবং মেসার্স হেলেনা এন্টারপ্রাইজের অনুকূলে ১৬ কোটি টাকা। একইভাবে আমিন কোর্ট কর্পোরেট শাখার ৪ গ্রাহক প্রতিষ্ঠান ঋণের নামে নিয়েছে প্রায় সাড়ে ৫৪ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো হল- মেসার্স প্যান্ডোরা ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ৬ কোটি টাকা, মেসার্স বেস্ট ট্রেড লিংকের অনুকূলে সাড়ে ২৪ কোটি, মেসার্স রেদোয়ান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের অনুকূলে ১৪ কোটি, ইউনি অ্যালায়েন্স জুট ইন্ডাস্ট্রিজের অনুকূলে ১০ কোটি টাকা। এসব ঋণের পুরোটাই আদায় অনিশ্চিত হয়ে মন্দ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে।
৯) জনতা ব্যাংক ঋণ কেলেঙ্কারি:
৬ বছরে শুধু ক্রিসেন্ট গ্রুপকেই ব্যাংকটি ঋণ প্রদান ও ঋণ সুবিধা প্রদান করে ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। বিসমিল্লিাহ গ্রুপকে প্রদান করে ১২,০০০কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, আবুল বারাকাত জনতা ব্যাংকটি ধ্বংস করে দিয়েছে।
১০) দেউলিয়া ফারমার্স ব্যাংক:
২০১২ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন পাওয়া নয়টি ব্যাংকের একটি ফারমার্স ব্যাংক। সংকটে পড়া ফারমার্স ব্যাংক ২০১৭ সালে ৫৩ কোটি নিট লোকসান করেছে। বছর শেষে ব্যাংকটির আমানত কমে হয়েছে ৪ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা। অথচ ব্যাংকটির ঋণ ৫ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। গত ২৭ নভেম্বর ব্যাংকটির পরিচালক সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এই ব্যাংকের অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িত আওয়ামী ঘরানার লেখক ও ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন ও ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারী নাজমুল আলম সিদ্দিকী। এখন ব্যাংকটির আমানত তুলতে গিয়ে বেশির ভাগকেই খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে।
১১) এনবিআর কমার্শিয়ালে দুর্নীতি:
২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ৭০১ কোটি টাকার ঋণে অনিয়ম খুঁজে পায়। ফলে প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ফরাছত আলীকে সরিয়ে দায়িত্ব আসেন তমাল এস এম পারভেজ।
১২) বাংলাদেশ বাংক রিজার্ভ ও ভল্টের স্বর্ণ চুরি:
সাড়ে ৮শ কোটি টাকার ডিজিটাল চুরির রেশ কাটতে না কাটতেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ভল্টে জমা রাখা স্বর্ণের গরমিল’ নিয়ে দেশব্যাপি তোলপাড়। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ৪০ দিন গোপন রেখে গভর্নর ড. আতিউর রহমান দিল্লী যান। [1]
অনুসন্ধানকালে ভল্টে রক্ষিত ৯৬৩ কেজি সোনা পরীক্ষা করে বেশির ভাগের ক্ষেত্রেই চরম কারসাজি ধরা পড়ে। ভল্টে যেসব অলংকার ও বার রয়েছে জমা দেওয়ার সময় এগুলোতে ৮০ শতাংশই বিশুদ্ধ স্বর্ণ ছিলো। কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায় ওই সব অলংকার ও বার এখন মাত্র ৪০ শতাংশ বিশুদ্ধ স্বর্ণ দিয়ে তৈরি রয়েছে। এমনকি ৮০ ভাগ বিশুদ্ধ স্বর্ণে তৈরি ৩ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের একটি চাকতি ও আংটি পুরোপুরিই মিশ্র বা সংকর ধাতু হয়ে গেছে। জমা রাখা ২২ ক্যারেটের স্বর্ণ এখন ১৮ ক্যারেট হয়ে গেছে।
১৩) খেলাপি ঋণ ও অবলোপন:
মোট খেলাপি ঋণ ৬২ হাজার কোটি টাকা ও অবলোপন ৭,২০০ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ছয় মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১২ হাজার ১৪৮কোটি টাকা। আর এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১০ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। এর বাইরে আরও ৫০ হাজার কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ ঋণ অবলোপন করেছে ব্যাংকগুলো। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে।
১৪) বহদ্দারহাট ফ্লাইওভার ধ্বস:
২৬ নভেম্বর ২০১২-তে চট্টগ্রামে বহদ্দার পুকুর পাড়ে নির্মীয়মান ফ্লাইওভারের গার্ডার ধ্বসে ১৫ জন নিহত হয়। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু-র মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাকটো পারিসা লিমিটেড এবং মীর আক্তার কনসট্রাকশন দুটি ফার্ম যুগ্মভাবে এই ফ্লাইওভার নির্মাণের কার্যাদেশ পেয়েছিল। নির্মান কাজে ব্যাপক দুর্নীতি ও নিম্ন মানের নির্মান সামগ্রী ব্যবহারের কারণে দুইবার ধ্বসে পড়ে ফ্লাইওভারটি।
১৫) পদ্মাসেতুর দুর্নীতি:
১১ জানুয়ারি ২০১৩-তে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দেয় আওয়ামী সরকারের দুর্নীতির কারণে তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না। ইতিপূর্বে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যখন এই অভিযোগটি আনে, তখন বহু গড়িমসির পরে যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন। কিন্তু ক্ষতিপূরণ স্বরূপ তাকে ‘দেশপ্রেমিক’ রূপে আখ্যায়িত করেন প্রধানমন্ত্রী। আবুল হোসেন ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার ছবিসহ তিনটি বড় বিলবোর্ড স্থাপন করেন ফার্মগেট থেকে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় পর্যন্ত, যেখানে শেখ হাসিনার স্তুতি বড় অক্ষরে দেখানো হয়েছে। পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে আওয়ামী সরকারের অন্যান্য কারা জড়িত ছিলেন সে বিষয়ে গুঞ্জন শোনা গেলেও এই দুর্নীতির কোন তদন্ত বা বিচার কিছুই হয়নি।
১৬) ছাত্রলীগ থেকে পুলিশে গোপন নিয়োগ:
কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে শুধু দলীয় বিবেচনায় আওয়ামী লীগের অনুগতদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিরোধী মতের লোকজনকে দমন-পীড়নে এসব পুলিশ সদস্যদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে সরকার। প্রায় বিশ হাজার পুলিশ সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে এই বিবেচনায়। শুধু তাই নয় প্রতিটি কনস্টেবল চাকুরীর জন্য দুই লক্ষ টাকা করে ঘুষ নেয়া হয়েছে।
১৭) ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২,৬০০ ও ৩,০০০ কোটি টাকার দুর্নীতি:
নরসিংদীর ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ২ হাজার ৬শ’ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।আর এনিয়ে অনুসন্ধানেও নেমেছে সংস্থাটি। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদক কার্যালয়ে সম্প্রতি এ অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই দুদকের এক উপ-পরিচালককে এ অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, ঘোড়াশাল ৬ নম্বর ইউনিটে রি-পাওয়ারিং বা পুনরায় ক্ষমতায়নের নামে প্রায় দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করা হয়েছে।
সে ক্ষেত্রে ১০০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র নির্মাণে সর্বোচ্চ ৪০০ কোটি টাকা খরচ হওয়ার কথা। সেখানে ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি ব্যয় হওয়াটা এক কথায় লুটপাটের আয়োজন বলে ওই সূত্র জানায়।
১৮) মোংলা, বুড়িমারী বন্দরে দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত:
টিআইবি’র রিপোর্ট অনুসারে ‘মোংলা বন্দর ও কাস্টম হাউজ এবং বুড়িমারী স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশন: আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়ায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, মোংলা বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তারা ২০১৬-১৭ অর্থবছরে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ১৫ কোটি ৬৯ লাখ টাকা হাতিয়েছেন। আমদানি পণ্যের শুল্কায়নে মোংলা কাস্টম হাউজে প্রায় প্রতিটি ধাপে নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায় করা হয়। এই সময়ের মধ্যেই মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের দুর্নীতির পরিমাণ ছিল ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা। গবেষণায় পাওয়া তথ্যমতে, বুড়িমারী বন্দরের মাধ্যমে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাপে বিল অব এন্ট্রি প্রতি গড়ে ন্যূনতম ২০৫০ টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে বা ঘুষ হিসেবে দিতে হয়। একইভাবে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাপে বিল অব এক্সপোর্ট প্রতি গড়ে ন্যূনতম ১৭০০ টাকা নিয়ম বহির্ভূতভাবে দিতে হয়।
১৯) দুর্নীতির তুলনা:
টিআইবি’র সূত্রে জানা যায়,
=১৯৯১-১৯৯৬ শাসনামলে আনুমানিক দুর্নীতির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকা।
=১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে আনুমানিক দুর্নীতির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকা।
=২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত আনুমানিক দুর্নীতির পরিমাণ বেশ বেড়ে দাঁড়ায় ৪২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকায়।
২০০৯-২০১৩ শাসনামলে আগের সব সংখ্যাকে ডিঙিয়ে দেশে আনুমানিক দুর্নীতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫২ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা!
২০) খাত ভিত্তিক দুর্নীতি:
টিআইবি বলছে, জাতীয়ভাবে মোট ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত অর্থের পরিমাণ ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এই অর্থের পরিমাণ ২০১৪-১৫ অর্থ বছরের বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপির) শূন্য দশমিক ছয় শতাংশ।
এক বছরেই ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত অর্থের পরিমাণ ৮ হাজার ৮২১ কোটি ৮০ লাখ টাকা হলে আওয়ামী দশ বছরে নাগরিক সেবা পেতে কি পরিমাণ ঘুষ দিতে হয়েছে তা অনুমেয়।
আর দেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত সেবা খাত হলো পাসপোর্ট। এ খাতে ৭৭ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়।
সংস্থাটি বলছে, দুর্নীতিগ্রস্ত সেবাখাতের মধ্যে
১।আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা ৭২.৫%
২।পাসপোর্ট ৬৭.৩%
৩। বিআরটিএ৬৫.৪%
৪। বিচারিক সেবায় ৬০.৫%
৫। ভূমি প্রশাসন ৪৪,৯%
৬।শিক্ষা: সরকারী ও এমপিওভূক্ত ৪২.৯%
৭। স্বাস্থ্য ৪২.৫%
৮। কৃষি ৪১.৬%
সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল বলেন, ‘ঘুষ প্রাত্যহিক জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। প্রত্যেকেই কোনো না কোনো ভাবে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।’ দুর্নীতির এই দুষ্টচক্র থেকে বের হয়ে আসতে তিনি সরকার ও সংশ্লিষ্টদের কাছে অনুরোধ জানান।
২১) ঘুষ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত সেবা মেলে না
সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ-২০১৫’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশের ৬৭ দশমিক ৮ খানা দুর্নীতির শিকার হয়েছে। ৫৮ দশমিক ১ শতাংশ খানাকে ঘুষ দিতে হয়েছে, যা খানা প্রতি বাৎসরিক গড় পরিমাণ ৪ হাজার ৫৩৮ টাকা।
২০১৫ সালে সেবা খাতে দুর্নীতি ও হয়রানির হার ২০১২ সালের তুলনায় প্রায় অপরিবর্তিত (৬৭.৮ শতাংশ বনাম ৬৭.৩ শতাংশ) থাকলেও সেবাগ্রহণকারী খানাগুলোকে ২০১২ সালের তুলনায় প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বেশি দিতে হয়েছে।
সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নিম্ন আয়ের জনগণের ওপর ঘুষ তথা দুর্নীতির বোঝা বেশি। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৭১ শতাংশ খানা ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত অর্থ প্রদানের মূল কারণ হিসেবে বলেন, ঘুষ না দিলে কাঙিক্ষত সেবা পাওয়া যায় না।
২২) দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশ:
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ভুটান। দেশটির স্কোর ৬৭ এবং ঊর্ধ্বক্রম অনুযায়ী অবস্থান ২৬। এর পরের অবস্থানে রয়েছে ভারত, যার স্কোর ৪০ এবং অবস্থান ৮১। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এরপরে শ্রীলংকা ৩৮ স্কোর পেয়ে ৯১তম অবস্থানে রয়েছে । ৩৩ স্কোর পেয়ে ১১২ তম অবস্থানে এরপর রয়েছে মালদ্বীপ এবং ৩২ স্কোর পেয়ে ১১৭ তম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান। অন্যদিকে ৩১ স্কোর পেয়ে ১২২তম অবস্থানে রয়েছে নেপাল।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থান
২৩) ক্ষমতাশালীদের ফুলে-ফেঁপে উঠা:
প্রথম ১০% ধনীর হাতে ৩৮% আয়, আর শেষ ১০ শতাংশ মানুষ ভোগ করে মাত্র ১শতাংশ আয়।
২৪) সড়কে দুর্নীতির মহোৎসব:
সস্তা শ্রমের পরও ব্যয়ে ছাড়িয়ে গেছে ইউরোপকেও। ১১ বছরে নির্মাণ ব্যায় বেড়েছে ২৫ গুণ। অথচ মানের দিক থেকে এশিয়ার দ্বিতীয় বাজে সড়ক বাংলাদেশর।
২৫) দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি:
২০০৬ সালে বনাম ২০১৮ সাল
১। চাল ১৭টাকা-৩৫টাকা
২।ডাল ৬৫টাকা-১৩০টাকা
৩।ডিম ১৭ টাকা হালি-৩২টাকা হালি
৪। গরুর মাংস ১৪০ টাকা-৪৫০টাকা
৫।ইলিশ ২০০ টাকা-৮০০-১২০০টাকা কেজি
একই অস্বীকৃতির প্রবণতার কারণে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হয়নি সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংকসহ সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকে অনিয়মের ক্ষেত্রে বা শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের জন্য দায়ী প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে। ডেমু ট্রেন ক্রয়ের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন চিহ্নিত অনিয়মের ক্ষেত্রেও সরকার কোনো দৃঢ়তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে, যেমন নির্বিকার থেকেছে প্রতিরক্ষা খাতে বিশাল আকারের ক্রয়ে স্বচ্ছতার চাহিদার ক্ষেত্রে। সবকিছু ছাপিয়ে জনপ্রতিনিধি এবং অন্যভাবে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সম্পদ আহরণের যে দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে বছরটি শেষ হয়েছে এবং তাকে যেভাবে পরিপোষণের প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তার ফলে রাষ্ট্রকাঠামো চৌর্যোন্মাদনার করাভূত হওয়ার সম্ভাবনায় শঙ্কিত হতে হয়।