পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণ দিবে না বিশ্বব্যাংক। পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্ব ব্যাংক যে ১২০ কোটি ডলার ঋণ দিতে চেয়েছিল দুর্নীতির কারণে তাদের ঋণ দিবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের সদর দফতর ওয়াশিংটন থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে সংস্থাটি বলছে, এই সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার সহযোগিতা না করায় তারা এ পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংক সরকারকে ৩টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও দিয়েছিল। যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একে ‘বিনা মেঘে বজ্রপাত’ বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, এ ঘটনা খুবই দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক এবং রহস্যজনক।
গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক সংস্থাটি পদ্মা সেতু প্রকল্পে তাদের অর্থায়ন বাতিলের ঘোষণা দেয়। গত বছরের এপ্রিলে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী ২৯০ কোটি ডলারের এই প্রকল্পে তাদের ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল। ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু নির্মাণে এডিবি ৬১ কোটি এবং জাপান ১৪ কোটি ডলার ঋণ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে সবচেয়ে বেশি ১২০ কোটি ডলার দেয়ার কথা ছিল বিশ্ব ব্যাংকের।
চুক্তি বাতিলের পক্ষে বিশ্ব ব্যাংক যুক্তি দেখিয়েছে, এই প্রকল্পে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ মিলেছে। দুর্নীতির বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারকে জানানো হয়েছে জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের যথাযথ সাড়া না মেলায় প্রকল্পে অর্থায়ন বাতিল করা হয়েছে এবং এই সিদ্ধান্ত অনতিবিলম্বে কার্যকর হবে।
বিশ্বব্যাংকের বিবৃতিতে যা আছে:
গত ২৯ জুন ওয়াশিংটন থেকে পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংক বিবৃতি প্রদান করে। এতে বলা হয়, ‘‘পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ব্যাপারে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা, এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তা এবং বেসরকারি পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিমূলক ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত দুর্নীতির বিশ্বাসযোগ তথ্য-প্রমাণ বিশ্ব ব্যাংকের কাছে রয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং বাংলাদেশ দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানের কাছে দু’টি তদন্তের তথ্য প্রমাণ প্রদান করেছে। আমরা বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে বিষয়টির পূর্ণ তদন্ত করতে এবং যথাযথ বিবেচিত হলে দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার আহবান জানিয়েছিলাম। আমরা এ পদক্ষেপ নিয়েছিলাম, কারণ আমরা আশা করেছিলাম যে সরকার বিষয়টিতে যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করবে।
কানাডায় যেখানে এসএনসি লাভালিনের সদর দফতর অবস্থিত সেখানে বিশ্ব ব্যাংকের রেফারেলের ভিত্তিতে ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসেস কয়েকটি সার্চ ওয়ারেন্ট তামিল করে এবং এক বছরব্যাপী তদন্ত চালিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু’জন সাবেক এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দাখিল করেছে। তদন্ত ও বিচার কাজ অব্যাহত রয়েছে। আদালতে পেশকৃত তথ্য এই ঘটনার গুরুত্ব তুলে ধরেছে।
তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তথা এ অঞ্চলের উন্নয়নের ক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর ভূমিকা বিবেচনা করে আমরা প্রকল্পের বাস্তবায়নের জন্য বিকল্প উপায় তথা টার্ন-কি পন্থায় প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছিলাম এই বিবেচনায় যে সরকার আমাদের দ্বারা উন্মোচিত উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিবে। সুশাসন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে এসব হুমকির ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণে জোর না দেয়া বিশ্বব্যাংকের জন্য দায়িত্বহীনতার পরিচয় হবে।
বিকল্প টার্ন-কি পন্থায় অগ্রসর হওয়ার জন্য আমরা নিন্মোক্ত পদক্ষেপসমূহ প্রস্তাব করেছিলাম: (১) যে সব সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের ছুটি প্রদান, (২) এই অভিযোগ তদন্তের জন্য দুদকের অধীনে একটি বিশেষ তদন্ত দল নিয়োগ, এবং (৩) আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত বিশ্ব ব্যাংংকের নিয়োগকৃত একটি প্যানেলের কাছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সকল তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারে সরকারের সম্মতি প্রদান যাতে এই প্যানেল তদন্তের অগ্রগতি, ব্যাপকতা ও সুষ্ঠুতার ব্যাপারে উন্নয়ন সহযোগীদের নির্দেশনা দিতে পারে। আমরা সরকার ও দুদকের সাথে ব্যাপক ও গভীরভাবে কাজ করেছি এটি নিশ্চিত করতে যে অনুরোধকৃত সকল পদক্ষেপে সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের নিজস্ব আইন ও বিধি-বিধানের আওতায় থাকে।
আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে প্রথমবার দরপত্র আহবান করা হলে বিশ্ব ব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরা প্যানেলের মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রকল্প অর্থায়নের ব্যাপারে অগ্রসর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিবে যদি পূর্ণ ও সুষ্ঠু তদন্ত চলছে এবং যথাযথ অগ্রগতি হচ্ছে তা প্রতীয়মান হয়।
বাড়তি প্রয়াস হিসেবে, আমরা বিশ্ব ব্যাংকের অবস্থান ব্যাখ্যা করা এবং সরকারের জবাব জানার জন্য ঢাকায় একটি উচ্চ পর্যায়ের দল পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু সরকারে প্রতিক্রিয়া বা জবাব সন্তোষজনক ছিলো না।
বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির ঘটনায় চোখ বুজে থাকতে পারে না, তা উচিত নয় এবং থাকবেও না। আমাদের শেয়ারহোল্ডার ও আইডিএ দাতা দেশগুলোর প্রতি আমাদের নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং সুষ্ঠু আর্থিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দায়িত্ব রয়েছে। এটি নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব যে আইডিএ সম্পদ কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং কেবল তখনই একটি প্রকল্পে আমরা অর্থায়ন করবো যখন আমরা যথেষ্ঠ নিশ্চয়তা পাবো যে প্রকল্পটি পরিষ্কার ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হবে। বাংলাদেশ সরকার থেকে পর্যাপ্ত বা ইতিবাচক সাড়া না মেলায় বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের সহায়তায় ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যা অবিলম্বে কার্যকর হবে।’’
দুর্নীতির অভিযোগ যেভাবে:
পদ্মা প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন স্থগিত করে। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই দুর্নীতির অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর তদারকির জন্য প্রাকযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত অন্যতম প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গত বছর ঘুষ সাধার অভিযোগ উঠলে তা নিয়ে তদন্ত শুরু হয় কানাডায়। এর পরই বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিতের ঘোষণা আসে। তারই ধারাবাহিকতায় এখন অর্থায়ন না করার ঘোষণা দিলো বিশ্বব্যাংক।
গত বছরের ২৮ এপ্রিল পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি অনুষ্ঠানে আসা বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনগোজি ওকোনজো ইউয়েলা বলেছিলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ যেন স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্তভাবে হয়।’’
সৈয়দ আবুল হোসেনের দায়িত্ব বদল :
পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগের আঙুল সৈয়দ আবুল হোসেনের দিকে থাকলেও তিনি বরাবরই বলে আসছেন, কোনো দুর্নীতি হয়নি। তবে দুর্নীতির অভিযোগের মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
কানাডায় বিচার :
রয়্যাল কানাডীয় পুলিশ ইতোমধ্যে সে দেশে এসএনসি-লাভালিন কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে কোম্পানির আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ এবং পরিচালক মোহাম্মদ ইসমাইলকে গ্রেফতার করে। বিদেশি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেয়া বা সাধার অভিযোগে ‘করাপশন অব ফরেন অফিশিয়াল’ আইনের আওতায় তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলাও হয়েছে। আগামী বছর তাদের মামলার প্রাথমিক শুনানি শুরু হবে।
দুর্নীতি তদন্তে কানাডা পুলিশ ঢাকায় :
দুর্নীতি তদন্তে কানাডা পুলিশের একটি দল গত সপ্তাহে ঢাকায় তদন্ত চালানোর পরপরই বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়ন বাতিলের সিদ্ধান্ত এল।
মালয়েশিয়ার সাথে চুক্তির চেষ্টা :
ঝুলে যাওয়া পদ্মা প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ এরই মধ্যে মালয়শিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। গত ১০ এপ্রিল কুয়ালালামপুরে মালয়শিয়ার সঙ্গে পদ্মা সেতুতে অর্থায়নের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। গত ২৮ মে অর্থায়নের বিষয়ে ধারণা-প্রস্তাব দেয় তারা। সর্বশেষ গত ২৮ জুন চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে খসড়া প্রস্তাব দেয় মালয়শিয়া। মালয়েশিয়ার প্রস্তাব পেয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘‘খসড়া প্রস্তাবটি যাচাই-বাছাই করার পর প্রথমে আমরা নিজেদের মধ্যে প্রস্তাবের বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করব, তারপর মালয়শিয়ার সঙ্গে আলোচনা করব।’’
দুদকের তদন্ত :
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে দুদক তদন্ত কাজ শুরু করে। এ ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কাজ দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। একটি হলো পদ্মাসেতুর কাজে ঠিকাদার নিয়োগ ও অপরটি পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া সংক্রান্ত।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দুর্নীতির ঘটনা অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয় দুদকের উপ-পরিচালক মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীকে। এ ছাড়া সেতু প্রকল্পের জন্য পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া বিষয়ে অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয় সহকারী পরিচালক মির্জা জাহিদুল ইসলামকে।
দুর্নীতি দমন কমিশন এক দফা তদন্তের পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে জানিয়েছিল, মূল সেতু নির্মাণে প্রাক-যোগ্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচনে কোনোরকম দুর্নীতি হয়নি। তবে পরামর্শক নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে।
দায়িত্ব পাওয়ার পর উপ-পরিচালক শিবলী বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পাশাপাশি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। মূলত তদন্তে যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালে সৈয়দ আবুল হোসেন কীভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে দুর্নীতির চেষ্টা করেছেন সে বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়। এরই মধ্যে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও জবানবন্দি নেয়া হয়েছে। সার্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ শেষে গত সপ্তাহে দুদকের সংশ্লিষ্ট শাখায় প্রতিবেদনটি পেশ করা হয়েছে।
অপরদিকে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি হয়েছে কিনা সে বিষয়ে অভিযোগের অনুসন্ধান অব্যাহত রয়েছে। সে অনুযায়ী পরামর্শক নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করছে দুদক। পদ্মাসেতুর দুর্নীতির বিষয়ে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ছাড়াও বেশ কয়েকজনকে দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করে। পরামর্শক নিয়োগ বিষয়ে দুদক আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে বলে জানা গেছে।