টেন্ডার-চাঁদাবাজি-দখল

টেন্ডারবাজী, চাঁদাবাজি ও দখলের এক দশক

গত এক দশক ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ছাত্রলীগ পরিণত হয় এক টেন্ডার, চাঁদাবাজ ও জবর দখলকারী একটি সংগঠন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও সিনোপসিসে দেখা যায়, শিক্ষা, শান্তি ও প্রগতির পরিবর্তে টেন্ডার, চাঁদাবাজি ও জবর দখলই হয়ে উঠেছে ছাত্রলীগের মূলমন্ত্র। বিগত দশ বছরে ছাত্রলীগের অন্তকোন্দলে খুন হওয়া ১০৭ জনের মধ্যে বেশির ভাগই অর্থের কারণে। এর পেছনের কারণ চাঁদাবাজি না হয় টেন্ডারবাজি। দশ বছরে ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতৃবৃন্দও সীমাহীন দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িয়ে পড়েছে। ছাত্রলীগ খুন, টেন্ডার, চাঁদাবাজি ও ধর্ষণের রক্ষাকবচ হিসেবে “জয় বাংলা” স্লোগানকে ব্যবহার করে আসছে।

গত দশবছরে দেশের প্রায় সব বড় শিাপ্রতিষ্ঠানে ও শহরে চাঁদাবাজি টেন্ডারবাজিতে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। চাঁদা না দেয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান ও দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজধানীর শিক্ষাভবন, গণপূর্ত ভবন, খাদ্য ভবন থেকে হাজার হাজার কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নেয় ছাত্রলীগ। নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি নিয়ে বেশ কয়েকবার সংঘর্ষও হয়েছে।

চাঁদা দিতে দেরি বা অপরাগতা প্রকাশ করায় ঢাবি, জাবি, রামেক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিাপ্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন জেলা শহরের বড় বাজেটের উন্নয়ন কাজ বন্ধ রাখা হয়। ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্যে ৭০-৮০টি কলেজের উন্নয়ন অনিশ্চিত হয়ে যায়। ৬৫৫ কোটি ১২ লাখ টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাগিয়ে নেয় ছাত্রলীগ।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, শিক্ষাবিদ ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা মনে করছেন, সম্পদ উপার্জনে অধিক মনোযোগী হওয়াই ছাত্রলীগের বেপরোয়া ও নিয়ন্ত্রণহীন হওয়ার মূল কারণ। অর্থবিত্ত অর্জনের লক্ষ্য থেকেই বিভিন্ন সময় তারা বিভিন্নভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অন্যদিকে অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা না নেয়া এবং ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে আইনানুযায়ী শাস্তি না হওয়ায় তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড কমছে না।

পত্রপত্রিকায় চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি নিয়ে ছাত্রলীগের সংঘর্ষ ও সাধারণ মানুষকে আক্রমণের যে কয়টি ঘটনা রিপোর্ট হয়েছে সে আলোকে ২০১৮ সালে ৭টি, ২০১৭ সালে ৩২টি, ২০১৬ সালে ১৯টি, ২০১৫ সালে ২৬টি, ২০১৪ সালে ২২টি, ২০১৩ সালে ৩১ টি।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ নামের সঙ্গে ‘টেন্ডারবাজ’ তকমা লেগে যায়। চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিতে সংগঠনের অনেক নেতা ও কর্মীর যুক্ত থাকার খবরও বরাবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে। ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতৃত্ব একাধিকবার এ ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। ‘জোর যার মুল্লুক তার’ স্টাইলে নিজেদের কাজ করেছে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ‘গুণধর’ নেতা ও কর্মীরা। তাদের নিরস্ত করা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি।

দলের শীর্ষ নেতৃত্বের খবরদারি যারা হেলাভরে অগ্রাহ্য করে তাদের প্রতিহত করার শক্তিও বোধ হয় কারো থাকে না। ফলে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা এই চক্রটি সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। টাকার বিনিময়ে ভাড়া খাটে। একসময়ের উজ্জ্বল ছাত্ররাজনীতি কলঙ্কিত হয়। যেমনটি ঘটেছে ১২ মার্চ ২০১৫ সালে বিদ্যুৎ ভবনে। ৭৩ লাখ টাকার একটি টেন্ডার জমা দেওয়া নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়েছে। গোলাগুলিতে আহত একজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিয়েছে পুলিশ।

আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার সরকার গঠনের পরও ক্ষমতাসীনদের সহযোগী সংগঠনগুলোর সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করা যায়নি। মুছে ফেলা যায়নি তাদের ‘টেন্ডারবাজ’ পরিচয়। বরং ‘কয়লা ধুলে ময়লা যায় না’ কথাটির সত্যতা যেন আবারও একবার প্রমাণিত হয়ে গেল ছাত্রলীগ নামধারী কিছু সন্ত্রাসীর কর্মকাণ্ডে। প্রকাশিত খবরে বলা হচ্ছে, একটি ৪২ লাখ ও একটি ৩১ লাখ টাকার কাজের জন্য নবাব আবদুল গনি রোডে অবস্থিত বিদ্যুৎ ভবনে দুটি কম্পানির পক্ষ থেকে দরপত্র জমা দেওয়া হয়। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের এক ছাত্রলীগ নেতার নেতৃত্বে এক পক্ষ এবং পরে অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দরপত্র জমা দিতে গেলে আগের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হয়। এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। শুরু হয় গোলাগুলি। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, ছাত্রলীগের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সরকারের জনপ্রিয়তা প্রশ্নবিদ্ধ করতে বড় ভূমিকা রাখছে। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল বা সহযোগী সংগঠনগুলো এসব দিকে দৃষ্টি দেওয়ার সময় পাচ্ছে বলে মনে হয় না। বিদ্যুৎ অফিসে ঘটে যাওয়া ঘটনা প্রমাণ করে, ছাত্রলীগ এখনো বেপরোয়া চরিত্রেই রয়ে গেছে। টেন্ডারবাজি থেকে মুক্ত হতে পারেনি সংগঠনটি।

শুধু টেন্ডারবাজি নয়, ছাত্রলীগ নামধারীদের চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডেও দেশের মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। দেশে একজন ব্যবসায়ী বাকি নেই যিনি বাংলাদেশে ব্যবসা করেন অথচ ছাত্রলীগকে চাঁদা দেন না। যত ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হোন না কেন, চা কিংবা বাদাম বিক্রেতারাও এর বাইরে নন।

বাড়ি ঘর নির্মান থেকে শুরু করে সকল কন্সট্রাকশন কাজে চাঁদা দেয়া বাধ্যতামূলক। গত দশ বছরে দেশে এমন কোন চাঁদা না দিয়ে কোন অবকাঠামোর কাজ হয় নি। মানুষকে শোষন করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্রলীগ নেতারাও আজ কোটিপতি।

টেন্ডার-চাঁদাবাজি-দখল

টেন্ডার-চাঁদাবাজি-দখল

টেন্ডার-চাঁদাবাজি-দখল

টেন্ডার-চাঁদাবাজি-দখল

টেন্ডার-চাঁদাবাজি-দখল

টেন্ডার-চাঁদাবাজি-দখল