ছাত্রলীগের ধর্ষণ/ নারী নির্যাতন/ ব্যাভিচারের এক দশক
২০০৯ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও সিনোপসিস অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, এ সময়ে ছাত্রলীগের হাতে ছাত্রীরা-নারীরা ধর্ষিত, নির্যাতিত, শ্লীলতা হারিয়েছেন ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন অন্তত ৩১৫ জন। এমনকি শিক্ষিকা থেকে শুরু করে স্কুলের ইউনিফর্ম পরিহতি ছাত্রী ও শিশুরাও রেহাই পায়নি তাদের হাত থেকে।
২০১৫ সালের ২৬ জুলাই থেকে জানুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, বহিষ্কৃতদের মধ্যে ১১৩ জন ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও বখাটেপনার অভিযোগে অভিযুক্ত।
গত ৪ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শতাধিক নারী ও ছাত্রী উত্ত্যক্ত, লাঞ্ছনা ও ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১০ সালে বৈশাখী অনুষ্ঠান ও থার্টিফাস্ট নাইটের অনুষ্ঠানে অন্তত ২০ নারী ও ছাত্রী লাঞ্ছিত হন ছাত্রলীগের হাতে। জাহাঙ্গীরনগরে ঘটেছে ছাত্রী উত্ত্যক্তের ঘটনা। বরিশাল বিএম কলেজের এক ছাত্রীর নগ্ন দৃশ্য এক ছাত্রলীগ কর্মী মোবাইলে ধারণ করায় ওই ছাত্রী আত্মহত্যা করে। ২০১০ সালের ২৬ এপ্রিল দিনে-দুপুরে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে এক ছাত্রীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে ছাত্রলীগ কর্মীরা। ২০১০ সালের ২ অক্টোবর বরিশালের মুলাদীতে ছাত্রলীগ কর্মীরা ধর্ষণ করেছে দুই বোনকে।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাতই মার্চ উপলক্ষে আজ আওয়ামী লীগের জনসভায় আসা নেতা-কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছে ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের কয়েকজন ছাত্রী। এসময় তাদের যৌন হয়রানি ও শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। পরে কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাদের উদ্ধার করতে সামর্থ হয়। একইভাবে নিগ্রহের শিকার হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীও।
আওয়ামী নেতা-কর্মীদের হাতে যৌন হয়রানির শিকার ভিকারুন্নেসা নুন স্কুল এন্ড কলেজের ছাত্রী অদিতি বৈরাগী তার ফেসবুকে লিখেছেন- “শান্তিনগর মোড়ে এক ঘন্টা দাড়ায়ে থেকেও কোনো বাস পাইলাম না। হেটে গেলাম বাংলামটর। বাংলামটর যাইতেই মিছিলের হাতে পড়লাম। প্রায় ১৫-২০ জন আমাকে ঘিরে দাড়াইলো। ব্যস! যা হওয়ার থাকে তাই। কলেজ ড্রেস পড়া একটা মেয়েকে হ্যারাস করতেসে এটা কেউ কেউ ভিডিও করার চেষ্টা করতেসে। কেউ ছবি তোলার চেষ্টা করতেসে। আমার কলেজ ড্রেসের বোতাম ছিড়ে গেসে । ওড়নার জায়গাটা খুলে ঝুলতেসে। ওরা আমাকে থাপড়াইসে। আমার শরীরে হাত দিসে। আমার দুইটা হাত এতগুলা হাত থেকে নিজের শরীরটাকে বাচাইতে পারে নাই। একটা পুলিশ অফিসার এই মলেস্টিং চক্রে ঢুকে আমাকে বের করে এন্ড একটা বাস থামায়ে বাসে তুলে দেয়। বাকিটা পথ সেইফ্লি আসছি। প্রচন্ড শরীর ব্যথা ছাড়া আর কোনো কাটাছেড়া নাই। মেন্টালি ভয়াবহ বিপর্যস্ত বাট শারীরিক ভাবে ভালো আছি। আমি এই শুয়োরদের দেশে থাকব না। জয় বাংলা বলে যারা মেয়ে মলেস্ট করে তাদের দেশে আমি থাকব না। থাকব না। থাকব না…”
২০১৬ সালের ৩ অক্টোবর সিলেটের এমসি কলেজ কেন্দ্রে স্নাতক পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে হামলার শিকার হন সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের স্নাতক (পাস কোর্স) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক বদরুল আলমের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে তার মাথার খুলি ভেদে করে মস্তিষ্কও জখম হয়। এই ঘটনায় বদরুলকে বহিষ্কার ও আদালত তাকে যাবজ্জীবন দিয়েছে। (প্রথম আলো, যুগান্তর, ইত্তেফাক, ইনকিলাব, নয়া দিগন্ত)
২০১৬ সালের ১৩ নভেম্বর, চুয়াডাঙ্গায় ধর্ষণচেষ্টার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ে গণপিটুনির শিকার হয়েছে সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ শাখার সাধারণ সম্পাদক তারিক হাসান তারেক। শুক্রবার গভীর রাতে কলেজ চত্বরে এ ঘটনা ঘটে। জানা গেছে, মদ্যপ অবস্থায় শুক্রবার রাতে কলেজ চত্বরে বসবাসরত এক পরিচারিকার ঘরে ঢুকে অবৈধ অস্ত্র দেখিয়ে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় ছাত্রলীগ নেতা তারেক। এ সময় ওই পরিচারিকার ছেলে বিষয়টি বুঝতে পেরে তারেককে হাতেনাতে ধরে ফেলে। তার চিৎকারে আশেপাশের লোকজন জড়ো হয়ে তারেককে গণপিটুনি দেয় এবং তার চুল কেটে দিয়ে অণ্ডকোষ ইট দিয়ে ছেঁচে দেয়। তবে ছাত্রলীগের আরও কিছু নেতা গিয়ে তারেককে উদ্ধার করে দ্রুত ওই এলাকা ত্যাগ করে। এ ঘটনায় ওই রাতেই থানায় মামলা দায়ের করেন নির্যাতিতা। মামলার বিবরণে এ তথ্যের সত্যতা মিলেছে। (বাংলা ট্রিবিউন)
২০১৭ সালের ১১ জানুয়ারি ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার ১০নং হবিরবাড়ি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সভাপতি আলমগীর কবির ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে এক স্কুলছাত্রীকে জোর করে তুলে নিয়ে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। ওই ছাত্রী ময়মনসিংহের মুসলিম গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়াশোনা করে। অভিযুক্তরা ওই শিক্ষার্থীকে মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে ধর্ষণ করে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে রেখে যায়। পরে ওই কলেজছাত্রীর এক বান্ধবী তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে। ঘটনার প্রায় চার মাস পর ধর্ষিতার পিতা বাদী হয়ে গত ১৫ মে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানায় ধর্ষণ মামলা করেন।
২০১৭ সালের ১০ মার্চ ভোলা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রিয়াজ মাহমুদের বিরুদ্ধে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায়। ঘটনার পর গত ২৭ আগস্ট ভোলা সদর থানায় মামলা হয়। ওই ছাত্রী নিজেই বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করে। অভিযুক্ত রিয়াজ মাহমুদকে গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে গত ৩১ আগস্ট শহরের আবদুর রব স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে মানববন্ধন করেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ওই সময়ে নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী ও তার পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানানো হয়।
২০১৭ সালের ১০ আগস্ট বরগুনা পাথরঘাটা কলেজের পাশের পুকুর থেকে অজ্ঞাত এক তরুণীর গলিত লাশ উদ্ধার হয়। পরে ওই তরুণীকে গণধর্ষণের পর হত্যার অভিযোগে বরগুনার পাথরঘাটা কলেজ ছাত্রলীগ নেতাসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। বরগুনার পুলিশ সুপার বিজয় বসাক এ কথা জানান। গ্রেপ্তাররা হলো- পাথরঘাটা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রুহি আনাল দানিয়াল (২২), সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন (২১), সাংগঠনিক সম্পাদক মাহিদুল ইসলাম রায়হান (১৯), উপজেলা ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক মো. মাহমুদ (১৮) ও কলেজের নৈশপ্রহরী জাহাঙ্গীর হোসেন (৪৪)।
২০১৭ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গাজীপুর সিটি করপোরেশনের এরশাদনগর এলাকায় ওয়ার্ড পর্যায়ের ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে তৃতীয় শ্রেণির এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে উঠে। পরে তাকে আটক করে পুলিশ। অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা পারভেজ মাসুদ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ৪৯নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।
২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে এক ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে তার দলের স্কুল কমিটির এক নেত্রীকে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ উঠে। অভিযুক্ত ওই ছাত্রলীগ নেতার নাম রিয়াদ হোসেন। সে সিরাজগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি।
৮ নভেম্বর বুধবার রাতে কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে রাজবাড়ী জেলার রামকান্তপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সুমন মিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
২৮ ডিসেম্বর শরীয়তপুরে ছয় নারীকে ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ ও সেসব দৃশ্য গোপনে ভিডিও করে ছড়িয়ে দেয়ার ঘটনায় গ্রেফতার হয় শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আরিফ হোসেন হাওলাদার। উপজেলা ছাত্রলীগ নেতাকর্মী, পুলিশ ও কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আরিফ হোসেন গোসলখানায় গোপন ক্যামেরা রেখে স্থানীয় এক নারীর অশ্লীল ভিডিও ধারণ করে। ওই ভিডিও দেখিয়ে পরে তাকে ধর্ষণ করে। এছাড়া আরিফের কলেজপড়ুয়া চাচাত বোন এবং এক মালয়েশিয়া প্রবাসীর স্ত্রীও তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেন।
২৩ জানুয়ারি ২০১৮, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইনের নেতৃত্বে সংগঠনের ২০-২৫ জনের একটি দল উপাচার্যের কার্যালয়ের সামনে যান। তারা উপাচার্যকে কক্ষে পাঠিয়ে আন্দোলনকারীদের করিডর থেকে সরিয়ে দেন। এরই মধ্যে ছাত্রলীগের কয়েক’শ কর্মী এসে জড়ো হন। এরপর তারা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। এসময় ছাত্রলীগের কর্মীরা তাদের শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে এবং গায়ের পোশাক ছিঁড়ে ফেলে।
জয়বাংলা শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে এভাবে নারী নিগ্রহের ঘটনা সত্যিই দেশবাসীকে ভাবিয়ে তুলেছে। ভাবতে শেখাচ্ছে ‘জয়বাংলা’ কি ধর্ষকদের শ্লোগান? ধর্ষণ আর নারী নিগ্রহের ঘটনা কি এই শ্লোগানধারীদের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়াবে?