সংবাদ মাধ্যমের শুরু থেকেই পুরো পৃথিবীতে সাংবাদিকতাকে একটা নিরাপদ মাধ্যম হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। বলা হয়, রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদপত্র হল সমাজের দর্পণ। আর সাংবাদিকরা দেশ ও জাতির বিবেক। গত এক যুগে গণমাধ্যম এখন আর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা, অনলাইন পত্রিকা ও অনলাইন রেডিও, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, ব্লগসহ লেখার নানা মাধ্যম বিস্তৃত হয়েছে। বেড়েছে যেমন তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যম তেমনি বেড়েছে কর্মী সংখ্যা। আর ততোধিক বেড়েছে এই পেশার সাথে যুক্তদের ঝুঁকির মাত্রা।
আধুনিক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার সাথে পাল্লা দিয়ে গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালনে কার্পণ্য করছে না বটে! কিন্তু ঝুঁকি মোকাবেলা দিন দিন কঠিন হয়ে পড়ছে। ফলে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে এই মাধ্যমের কর্মীরা। তাদের জীবন বিপন্ন করে পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা টিকিয়ে রাখাই এখন দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে আমাদের দেশে, রাজনৈতিক-সামাজিক, দুর্নীতি-অনিয়ম প্রকাশ হলেই হলো। আক্রোশের শিকার হতে হচ্ছে গণমাধ্যম কর্মীদের। তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ছে সরাসরি প্রতিপক্ষ বিবেচনায়। যা একটি সভ্য সমাজে কারো কাম্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে সরকার ও সরকারি বাহিনীও অনেকটা গা ছাড়া ভাব তো দেখাই। আসকের রিপোর্টে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারাই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যে কারণে সাংবাদিক হত্যা ও নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধুমাত্র শারীরিক নির্যাতন করেই থেমে থাকছে না। এই গনমাধ্যমের টুঁটি চেপে ধরার জন্য করা হচ্ছে নতুন নতুন আইন। যেসব আইনে আছে ব্যাপক ফাঁকফোঁকর। যেগুলোর যথাযথ ব্যাখ্যা অতিব জরুরী। কিন্তু যখন যে সরকারই আসে, সেই মিষ্টি মিষ্টি কথার বুলি শুনিয়ে আইনের অনেক ফাঁকফোঁকর রেখেই সাংবাদিকদের মতামত না নিয়েই এসব আইন পাশ করিয়ে নেয়। পরবর্তীতে এসব আইনই সংবাদকর্মীদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায়।
বলা হয়ে থাকে, বাম ঘরোনার মহাজোট সরকার সংবাদিকতার অনূকুলের সরকার। আর অন্যদিকে ডানপন্থী বিশদলীয় সরকার মত প্রকাশে স্বাধীনতার বিরোধী। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে ভিন্ন কথা। ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ তারিখে প্রথম আলোর এক রিপোর্টে বলা হয়, ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সাংবাদিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে ১৪ টি। আর আহত হয়েছেন ৫৬১ জন সাংবাদিক। কিন্তু মহাজোটের ১ম শাসন আমলেই সাংবাদিক মৃত্যুর ঘটনা ২০ ছাড়িয়ে ২১ গিয়ে ঠেকেছে। আর ২য় মেয়াদের ৫ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩৩ এ । এ তথ্যটি পাওয়া যায় পরিবর্তন পত্রিকার ২৯ আগস্ট ২০১৮র একটি রিপোর্ট থেকে।
আর যদি সাংবাদিক নির্যাতন তথা শুধু আক্রমণ বা আহতের হিসাব দেই তাহলে ২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আসকের রিপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সে সংখ্যাটা সাতশরও অধিক ৭০৫ জন। আর এসব আহত, হত্যা, নির্যাতন মিলিয়ে মোট হয়রানির শিকার ১২২৬ জন। এর মধ্যে আওয়ামীলীগ নির্যাতন করেছে ৩৮৩ জন সাংবাদিককে। পুলিশ ১৩০ জনকে, বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্তৃক নির্যাতিত হয়েছেন ২৪০ জন আর ৩০ জন আহত হয়েছেন বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর কাছ থেকে।
এই যখন অবস্থা তখন ২৭ শে আগস্ট ২০১৮ তারিখের প্রথম আলোর এক রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই বলে বিভিন্ন পক্ষ থেকে অভিযোগ হাসানুল হক ইনুর কাছে তোলা হলে সেগুলো খারিজ করে দেন এই তথ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে তিন হাজারের বেশি খবরের কাগজ প্রকাশিত হয় এবং ৪১টি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই বলে মনে করেন তিনি।
অথচ ২০১৩ সালে, দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, চ্যানেল ওয়ান, সিএসবি, ইসলামিক টিভির পর একসঙ্গে ৩৫টি অনলাইন পোর্টাল বন্ধ করে দেয়। যার ফলে হাজার হাজার সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়েন। এছাড়াও ইটিভির সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস সালাম প্রায় ১১ মাস ধরে কারাগারে আছেন। ৪ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখের রাতে যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত একটি সভায় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৫০ মিনিটের একটি বক্তব্য ইটিভিতে সরাসরি সম্প্রচারের এক দিন পর ৬ জানুয়ারি ভোরে আবদুস সালামকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ। পরে তাঁকে পর্নোগ্রাফি আইনে দায়ের করা ক্যান্টনমেন্ট থানার একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তারপর ২৫ নভেম্বর ২০১৫ এ অর্থ ঋণ আদালতের ১২ ধারা মোতাবেক প্রতিষ্ঠানটির দখল নেয় আওয়ামী বিজনেজ মেগনেট এস আলম ও তার গ্রুপ। এরপর নতুন মালিকানায় চ্যানেলটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিযুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী এবং আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুস সোবহান (গোলাপ)। তখন থেকেই এই চ্যানেলের সৎ ও যোগ্য সাংবাদিকরা বিতাড়িত। একুশের চোখ অনুষ্ঠানের এক সাংবাদিক ইলিয়াস সড়ক আন্দোলনের সময় এক ভিডিও বার্তায় তুলে ধরেন ইনুরা কিভাবে অযাচিত হস্তক্ষেপ করছে গণমাধ্যমের উপর। তাও নির্লজ্জভাবে বলা হচ্ছে গনমাধ্যম স্বাধীন।
এ মহাজোটের আমলে সবচেয়ে বেশি আলোচিত খবর ছিলো সাগর-রুনি হত্যাকান্ড। বিবিসি বাংলার ১০ ফেব্রুয়ারী ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মামলার তদন্তকারী সংস্থা র্যাব দাবি করছে, তাদের তদন্তে কিছু বিষয়ে অগ্রগতি হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আদালতের কাছে ৪৬ বার সময় নেয়ার পরও র্যাব তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনি এই সাংবাদিক দম্পতিকে ঢাকায় পশ্চিম রাজাবাজার এলাকায় তাদের বাসায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ২০১২সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি। ঘটনার সময় ঐ বাসায় থাকা তাদের একমাত্র শিশু সন্তান মাহি সরওয়ার মেঘ বেঁচে যায়। হত্যাকাণ্ডের পর পাঁচ বছরে তদন্তে অগ্রগতি নেই।এমন পরিস্থিতিতে সান্ত্বনা পাওয়ার পথও খুঁজে পাচ্ছে না সাংবাদিক দম্পতির বিপর্যস্ত পরিবার দু’টো।
এছাড়া ঢাকার মগবাজারে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আওয়ামী সরকারের প্রথম শিকার হন এনটিভির ভিডিও এডিটর আতিকুল ইসলাম আতিক। ২১ শে ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে রাজধানীর রামপুরা থেকে প্রবীণ আলোকচিত্র সাংবাদিক আফতাব আহমেদের হাত- পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই বাসায় তিনি একাই থাকতেন। ২০০৬ সালে একুশে পদক পাওয়া আফতাব দীর্ঘদিন ইত্তেফাকের জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রী হিসাবে কাজ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর। আফতাব আহমেদের জন্ম ১৯৩৫ সালে, তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়ায়। আলোকচিত্র সাংবাদিক হিসাবে তিনি ইত্তেফাকে যোগ দেন ১৯৬২ সালে। পশ্চিম রামপুরার ৬৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে চারতলা ওই বাড়ির তৃতীয় তলায় থাকতেন আফতাব। এখন পর্যন্ত শেষ হত্যার শিকার সাংবাদিক সুবর্ণা নদী। ২৮ আগস্ট ২০১৮ তারিখে রাত ১০টার দিকে তিনি বাড়ির ফটকে পৌঁছালে মোটরসাইকেলে করে তিন থেকে চারজনের একদল দুর্বৃত্ত সেখানে তাঁকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে পালিয়ে যায়। সাংবাদিক সুবর্ণা নদী বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আনন্দ টিভির পাবনা জেলা প্রতিনিধি পদে কর্মরত ছিলেন। শহরের রাধানগর মহল্লায় ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। গুরুতর আহত অবস্থায় প্রতিবেশী ও স্বজনেরা তাঁকে উদ্ধার করে পাবনা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
এছাড়া নির্যাতন তো আছেই। প্রথম আলোর ০২ জানুয়ারি ২০১৪ তারিখের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, লালমনিরহাটের এক সাংবাদিক সায়েম সাবু ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ২৩টি মামলা করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণেই পরিবারটির বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক-এ ২০১০ সালের ৩ জুন ‘গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর নৈরাজ্য!’ শিরোনামে একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে প্রতিমন্ত্রী, তাঁর ছেলে ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরা হয়েছিল। প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওই মাসেই সায়েম, তাঁর তিন ভাই, বোন ও বোন জামাইসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের মামলা হয়।
এরপর গত আড়াই বছরে সায়েমের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টাকা ছিনতাই, ধানের চারা উপড়ে ফেলা, সার ও বীজ ছিনতাই, গাড়িতে আগুন, হামলা-ভাঙচুর, জমি দখলসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২৩টি মামলা করা হয়। মামলায় লড়তে লড়তে পরিবারটি পর্যুদস্ত।
২৪ শে নভেম্বর ২০১৬ তারিখে ‘আমার দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান জামিনে মুক্তি পান৷ রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং ধর্মীয় অস্থিরতা সৃষ্টিতে উস্কানির নামে বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগে তিন বছরেরও বেশি সময় তিনি কারাবন্দি ছিলেন৷ ৬৩ বছর বয়সি মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে গাড়ি ভাংচুর থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রীর পুত্রকে হত্যার পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন মিথ্যা অভিযোগ করা হয় ৷ ২০১৩ সালের এপ্রিলে বিরোধীদলের নেতাকর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরুর সময় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়৷ রহমানের আইনজীবী জয়নাল আবেদিন মেসবাহ বলেন, ‘‘তাঁর বিরুদ্ধে করা ৭৮টি মামলার শেষেরটিতে জামিন পাওয়ায় আজ তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়েছে৷”
সর্বশেষ ২২ জুলাই ২০১৮ তে তার ওপর হামলাও করে ছাত্রলীগ। প্রধানমন্ত্রীর ভাগনি টিউলিপ সিদ্দিক সম্পর্কে মানহানিকর বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলায় জামিন পেতে কুষ্টিয়া আদালতে গিয়েছিলেন তিনি। জামিন মঞ্জুর করার কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁর ওপর হামলা চালানো হয়। ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা আগে থেকে আদালত চত্বরে অবস্থান নেন। জামিন মঞ্জুরের পর তাঁরা মাহমুদুর রহমানকে আদালতের একটি কক্ষে অবরুদ্ধ করে ফেলেন। একপর্যায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি নিজের গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করেন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা তাঁকে লক্ষ করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন। এতে একটি ইটের টুকরা লেগে রক্তাক্ত হন মাহমুদুর রহমান। এছাড়া যায়াযায়দিনের সাবেক সম্পাদক ৮১ বছর বয়সি ব্রিটিশ নাগরিক, খালেদা জিয়ার ‘স্পিচরাইটার’ শফিক রেহমানও পাঁচমাস কারাভোগ করেন এই সরকারের আমলে।
এবার আসি সরকারপন্থী সাংবাদিক ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের উপর নির্যাতনের চিত্র নিয়ে। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের টক শোতে এক-এগারোর সময় সংবাদ প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণমাধ্যমের বিচ্যুতির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মাহফুজ আনাম তাঁর পত্রিকায়ও এমন ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছিল বলে স্বীকার করেন। পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে এবং তাঁর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি-বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় নিজের ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাসে ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তুলে বিচার চান। এক দিন পর ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে কয়েকজন সাংসদ ডেইলি স্টার বন্ধ করা এবং মাহফুজ আনামের পদত্যাগ ও বিচার দাবি করেন। এর পরদিন থেকেই মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দেওয়া শুরু হয়। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় ৭৭টি মামলা হয়। মামলাগুলোর বাদী ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, এর অঙ্গ-সহযোগী ও সমমনা সংগঠনের নেতা এবং সরকারি কৌঁসুলিরা। এসব মামলায় কেবল মানহানি, কেবল রাষ্ট্রদ্রোহ আবার কোথাও কোথাও মানহানির পাশাপাশি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগও আনা হয়েছে।
এতক্ষণ তো গেলো ছাত্রলীগ ও আওয়ামীলীগের নির্যাতনের গল্প। বাংলা ট্রিবিউনের ১৩ই মার্চ এক নিউজে ফুটে উঠে পুলিশের সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র। নিউজে বলা হয়, দুপুরে দক্ষিণ চকবাজারের পুরাতন বিউটি হলের সামনে ডিবি পুলিশ একটি বাসায় মাদকের অভিযান চালালে বেসরকারি টেলিভশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজের ক্যামেরাপারসন সুমন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। অভিযানের বিষয়ে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বাকবিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ৮ পুলিশ সদস্য মিলে সুমনের ওপর চড়াও হয়। এসময় তারা সুমনকে বেধড়ক মারধর করে অজ্ঞান করে ফেলে। পরবর্তীতে ডিবি কার্যালয়ে গিয়ে জ্ঞান ফিরলে পুনরায় তাকে মধ্যযুগীয় কায়দায় মারধর করা হয়। এ ঘটনাটি সেসময় মিডিয়াকে বেশ নাড়া দেয়।
সর্বশেষ কোটা ও সড়ক আন্দোলনে সাংবাদিকরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দুমুখী নির্যাতনের শিকার হন সাংবাদিকরা। এতে অন্তত ২০ জন সাংবাদিক নির্যাতনের শিকার হন। এ সময় সরকারের সবচেয়ে বড় শিকার “দৃক গ্যালারীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইন্সটিটিউট” এর চেয়ারম্যান আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেন, ডিবির একটি টীম শহীদুল আলমকে চলমান ছাত্র বিক্ষোভের বিষয়ে তার কিছু ফেসবুক পোস্ট নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে । তারপর মামলা হয় তথ্য-প্রযুক্তি আইনে। সাত দিনের রিমান্ডও মঞ্জুর হয়। । প্রায় সাড়ে তিন মাস কারাভোগের পর গত ২০ নভেম্বর ২০১৮ এ কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। এ গেল হত্যা নির্যাতনের কথা। এবার দেখি, আইনের জটিলতা।
ধারা ৫৭ :
সরাসরি নির্যাতনে জড়িত থেকেও সরকার ক্ষান্ত হয় নি। আশ্রয় নিয়েছে আইনের। মামলার দোহাই দিয়ে মুখ চেপে ধরা হচ্ছে। এমন একটি আইন হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি আইন।
আইসিটি আইনটি প্রথমে প্রণয়ন করা হয় ২০০৬ সালে। পরে ২০১৩ সালে সংশোধন করে শাস্তি বাড়িয়ে সেটিকে আরও কঠোর করা হয়। সাইবার নিরাপত্তা, ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং এ-সংক্রান্ত অপরাধের শাস্তির বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। প্রথমে ‘সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০১৫’ নাম দেওয়া হলেও পরে সেটি ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন, ২০১৮ ’ নাম দেওয়া হয়। এটি মন্ত্রিসভায় উত্থাপন হলে তা নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয় ২৯ জানুয়ারী ২০১৮ তে। কি ছিলো ৫৭ ধারায়??
তথ্য ও প্রযুক্তি আইন ২০০৬ ( সংশোধিত ২০১৩) এর ধারা- ৫৭,
১/ কোন ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা ইহলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ৷
২/ কোন ব্যক্তি উপ-ধারা (১) এর অধীন অপরাধ করিলে তিনি অনধিক চৌদ্দ বৎসর এবং অন্যূন সাত বৎসর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন৷
এটি এমন একটি ধারা যার মধ্যে অনেকগুলো শব্দ আছে যার পূর্ণ ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে। নয়তো ধারাটি অপব্যবহারের সুযোগ থাকে। যার শাস্তি ১৪ বছর পর্যন্তও হতে পারে। এবং এর অপব্যবহার হচ্ছেও তা সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের দেওয়া তথ্য দেখলেই বুঝা যায়। সাইবার সিকিউরিটি ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটরের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত সারাদেশে তথ্য-প্রযুক্তি আইনে ৭৪০টি মামলা দায়ের হয়েছে, যার মধ্যে ৬০ শতাংশ মামলা করা হয় ৫৭ ধারায়৷ এমন কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ নজরুল ও আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের নামেও আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা হয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮ :
এ আইনের অপকারিতা বুঝতে পেরে পুরো ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকরা এ আইন বাতিলের জন্য সরব ছিলো। আন্দোলনের ফল হিসেবে ৫৭ ধারাসহ বিতর্কিত ৫৪, ৫৫, ৫৬ ও ৬৬ ধারা পুরোপুরি বিলুপ্ত করা হয় ২৯ জানুয়ারী ২০১৮ তে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম প্রেস ব্রিফিং এ জানিয়েছেন যে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৪, ৫৫, ৫৬, ৫৭ ও ৬৬ ধারা বাতিল করে তার পরিবর্তে এসব ধারার অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী শাস্তির বিধান রাখা হবে।
এ থেকেই বোঝা যায় পূর্বের আইন বাদ যাচ্ছে না ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ এ। বরং পুনর্বিন্যাসিত হচ্ছে। নতুন আইনের ১৭ থেকে ৩৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিষয় উল্লেখ রয়েছে। যার মধ্যে পূর্বের আইনেরই প্রতিস্থাপন হয়েছে। নতুন আইনের ১৯ ধারার সাথে মূলত পূর্বের আইনের ৫৭ ধারার মিল আছে। কিন্তু শাস্তির পরিমান কিছুটা কম। এইটুকুই পরিবর্তন । এ আইনটির ৩২ ধারা নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এ ধারায় ডিজিটাল অপরাধের বদলে গুপ্তচরবৃত্তির সাজার বিধান রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়, কোনো সরকারি, আধাসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে ঢুকে কেউ কোনো কিছু রেকর্ড করলে, তা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে। এর জন্য ১৪ বছরের জেল এবং ২০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।
অনুমোদনের পর আইনটির ব্যাপারে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিবিসি বাংলাকে বলেন, আইসিটি অ্যাক্টের অপরিচ্ছন্ন যে ৫৭ ধারা ছিল, সেটিকে বিলুপ্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে ৫৭ ধারার যে অপরাধ, সেগুলো বিস্তারিতভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়েছে। আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হলেও নতুন আইনে আগের মতো হয়রানির আশঙ্কা থাকবে কি-না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অযথা হয়রানি যাতে না হয় সে জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। অপপ্রয়োগের সুযোগ ৯৭ ভাগ বন্ধ হবে।
এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল সমকালকে বলেন, এর আগে ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ নিয়ে সাংবাদিকরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। তখনও বলা হয়েছিল, এ আইন পেশাগত কাজে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেছে, অতি তুচ্ছ কারণে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে একের পর এক ৫৭ ধারার অপপ্রয়োগ করা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও ৫৭ ধারার আদলে কিছু বিধান রাখা হয়েছে, যা মত প্রকাশের এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বড় বাধা হতে পারে। এ আইনটি শুধু মন্ত্রিসভা অনুমোদন করেছে। সরকারের কাছে অনুরোধ থাকবে, আইনটি চূড়ান্তভাবে পাসের আগে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দসহ মানবাধিকার কর্মীদের বক্তব্য নেওয়া এবং আইনের অপপ্রয়োগ রোধে পূর্ব নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থাসহ আইনটি পাস করা।
এসব থেকেই বুঝা যাচ্ছে ৫৭ ধারার অশুভ ছায়া থেকে জাতি এখনো মুক্ত হতে পারে নি। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি হিসেবে দাবীদার মহাজোট সরকারও খুব একটা সুবিধাকর নয় তা উপরোক্ত আলোচনা থেকেই স্পষ্ট। বরং তাদের সময়েই গণমাধ্যম তার স্বকীয়তা হারিয়েছে সবচেয়ে বেশি। সব ধরনের মহাজোট বিরোধী খবরকেই তারা রাষ্ট্র বিরোধী খবর বলে চাপিয়ে দিচ্ছে। এই অজুহাতে বন্ধ হচ্ছে গণমাধ্যম। এমন কি হত্যাও করা হচ্ছে সাগর-রুনির মতো সংবাদকর্মীদের। আর মামলা- আপহরণ তো আছেই।
বিশ্ব দরবারও যে বাংলাদেশের গণমাধ্যম নিয়ে চিন্তিত তা ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্স -২০১৮ সূচক দেখলেই বোঝা যায়। এ সূচকে পৃথিবীর ১৮০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের ১৪৬ তম। অথচ ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন এই একই প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন অনুযায়ীই বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১তম। ৯ বছরে ২৫ ধাপ অবনতি ঘটে এ বছর ১৪৬তম হয়েছে । সবচেয়ে বড় বিপর্যয়টি ঘটে ২০১৩ সালে। এ বছর ১৫ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান হয় ১৪৪ তম। যেখানে ২০১২ সালে ছিলো ১২৯ তম। কারন এ বছরেই বন্ধ করে দেয়া হয় দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামিক টিভির পর একসঙ্গে ৩৫টি অনলাইন পোর্টাল। তাও নূন্যতম টনক নড়ে নি হাসানুল হক ইনুদের। বরং নির্লজ্জ বলে বেড়াচ্ছেন, গণমাধ্যম পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার নীচে।