সন্ত্রাসী কার্যক্রম

২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর থেকে এমন কোন সন্ত্রাসী কাজ নাই যা ছাত্রলীগ করে নাই। মানুষের অধিকার হরণ থেকে শুরু করে শিশুদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়া, স্কুল পর্যায়ে ছাত্রলীগের কমিটির নামে সংঘর্ষ, সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে হামলা, লুটপাট সবই হয়েছে সরকারের সরাসরি মদদপুষ্ট ছাত্রলীগ দ্বারা। এমন কি আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনার অনুরোধেও ঢেঁকি গিলে নি তারা। পরে অবশ্য এ নিয়ে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন হাইকমান্ড। শুধু তাই নয়, ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য ২০০৯ সালের ৩ এপ্রিল সংগঠনের দায়িত্ব থেকেও সরে দাঁড়ান ক্ষুব্ধ প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তাতে কি?? ছোট-বড়, সরকারি-বেসরকারি, মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা, সামরিক-বেসামরিক কোন ধরনের লোকই তাদের হাত থেকে ছাড়া পায় নি। এহেন কাজে বিভিন্ন সময়ে হামলা, ভাংচুর, হুমকি, ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটেছে যাতে শুধু পাঁচ বছরের সমীকরণে আহতের সংখ্যা প্রায় দেড়শ, ভাংচুরের ঘটনাও ঘটেছে একশটির বেশি, আর বহিষ্কার খেলার শিকার হয়েছেন প্রায় আড়াইশ জন।

খুন, চাঁদাবাজি,টেন্ডার,অন্তঃকোন্দল,শিক্ষক লাঞ্চনা,শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, সাংবাদিকের উপর আক্রমণ এসবের মধ্য দিয়েই পার করে যাচ্ছে ছাত্রলীগ তাদের শেষ ১০ টি বছর। এসব কিছুর বাহিরেও আরো বেশকিছু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ছাত্রলীগ ছিলো সোচ্চার যার চরম ভুক্তভোগী সাধারণ জনগণ,ব্যবসায়ী, শিক্ষার্থী,সেনাবাহিনী,মুক্তিযোদ্ধা, এমন কি শিশু। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্যে আছে শহীদ মিনার ভাংচুর,রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানে আক্রমন, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ভাংচুর, গাড়ী ভাংচুর সহ আরো অনেক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। আমাদের গবেষণায় বের হয়ে আসে, শুধুমাত্র গত ৫ বছরেই উপরে এসব ঘটনায় আহত হয়েছে অন্তত ১২৬ জন; সংঘর্ষ, বিক্ষোভ,মিছিল,হরতালের সংখ্যা ১৪ টি। এছাড়াও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে ১১৮ টি। এসব কারণে মামলা,গ্রেফতার, কারাদন্ড কিংবা বহিষ্কার হয়েছেন ২৩৮ ছাত্রলীগ নেতাকর্মী।

যদিও শিক্ষা-শান্তি-প্রগতি ছাত্রলীগের প্রধান মূলতন্ত্র । কিন্তু এটি শুধুমাত্র কগজে কলমে সত্য। বাস্তবে পরিস্থিতি ভিন্ন। নিজ স্বার্থের জন্য প্রগতির চর্চাতেও বাধা হতে দেখা গেছে তাদের।। ১০ মে ২০১৭ তারিখের বিকেলে চাষাঢ়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে উন্মেষ সাংস্কৃতিক সংসদের উদ্যোগে রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে চেয়ার বসানো ও শব্দযন্ত্র লাগানোর কাজ চলছিল। বিকেল সোয়া চারটার দিকে মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান ওরফে রিয়াদের নেতৃত্বে সংগঠনের শতাধিক নেতা-কর্মী লাঠিসোঁটা নিয়ে মিছিল বের করেন। এ সময় তাঁরা চাষাঢ়া বিজয় স্তম্ভের সামনে মাইকে নিহত ত্বকীর বাবা ও সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বিকে শহীদ মিনারে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেন এবং তাঁর কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। একপর্যায়ে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শহীদ মিনারে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালান। এ সময় তাঁরা প্লাস্টিকের চেয়ার ও শব্দযন্ত্র ভাঙচুর করেন এবং এগুলোয় আগুন ধরিয়ে দেন। সেখানে উপস্থিত জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সুমাইয়া সেতু, সহসভাপতি ফারজানা আক্তার ও উন্মেষ সাংস্কৃতিক সংসদের সাধারণ স¤পাদক শুভ বণিককে লাঠি দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে আহত করা হয়। তাঁরা কোনো রকমে শহীদ মিনার থেকে বেরিয়ে রক্ষা পান। এরপর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা ও রিকশায় মাইক নিয়ে শহীদ মিনার দখল করে রাখেন। এ কারণে উন্মেষ সাংস্কৃতিক সংসদ রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান করতে পারেনি।

ছাত্রলীগের আরেকটি মূলমন্ত্র হচ্ছে , শান্তি। কিন্তু বিগত দশ বছরে শান্তি থেকে অশান্তির কাজে তারা ছিলো অগ্রগামী। কি শিক্ষাঙ্গন, কি রাজনীতির ময়দান সব জায়গায়ই তাদের সন্ত্রাস পরিলক্ষিত হয়েছে। তাদের এই সন্ত্রাসের হাত থেকে রেহাই পায় নি গর্ভের শিশু। ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই বিকেলে মাগুরা শহরের দোয়ারপাড় কারিগরপাড়ায় ছাত্রলীগের দুপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে একপক্ষের নেতৃত্ব দেন ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল ভূঁইয়া। অপরপক্ষে নেতৃত্ব দেন পৌর ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মেহেদী হাসান আজিবর ও সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী মুহম্মদ আলী আকবর। সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে অন্তঃসত্ত্বা নাজমা খাতুন পেটে গুলিবিদ্ধ হন। গুলিতে আহত হয় গর্ভের শিশু। ওই সংঘর্ষে নাজমার চাচাশ্বশুর মমিন ভূঁইয়া গুলি ও বোমায় আহত হন। দুদিন পরে তিনি মাগুরা সদর হাসপাতালে মারা যান। এ তো গেল গর্ভের শিশুর কথা। ছাত্রলীগের হাত থেকে সেনা বাহিনীর মেজরও রক্ষা পায় নি। ৬ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে বিকেলে নগরের মুন্সিপাড়া ১১৯ নম্বর বাসা থেকে গাড়ি নিয়ে বের হন মেজর আবদুল আজিজ। এ সময় ছাত্রলীগের একদল কর্মী মোটরসাইকেল মহড়া দিয়ে ওই এলাকা দিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় তারা তাঁর গাড়ি সড়কের পাশে নিয়ে রাখার নির্দেশ দেয়। এ নিয়ে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে মেজর আবদুল আজিজের হাতে ছুরিকাঘাত করে এবং তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করে পালায় তারা। পরে গাড়িচালকের সহায়তায় আবদুল আজিজ সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে গতকাল সকালে মামলা করেন।

এসবের মূল কারণ ছোট ছোট ছেলেদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে ছাত্রলীগ। এ বিষয়ে ২৫ ফেব্র“য়ারি ২০১৮ তারিখে প্রথম আলোতে একটা রিপোর্ট হয়। সেখানে বলা হয়, ১৬ জানুয়ারি ২০১৮ তে চট্টগ্রামের জামালখান এলাকার ফুটপাতে দিনদুপুরে কয়েকজন কিশোর প্রকাশ্যে খুন করে তাদেরই পরিচিত এক সহপাঠীকে। ঐ ঘটনায় তাদের অস্ত্র দেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই নেতা। চট্টগ্রাম নগর পুলিশের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা প্রথম আলো কে বলেন, রাজনৈতিক বড় ভাইদের সান্নিধ্যে থাকায় স্কুলপড়ুয়া কিশোরদের একটি অংশের মধ্যে বেপরোয়া ভাব সৃষ্টি হয়েছে। ছোটখাটো বিরোধেও অস্ত্র দেখিয়ে বীরত্ব জাহির করতে চায়।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়া কিশোরেরা বিকেল থেকে রাত আটটা পর্যন্ত নগরের গোল পাহাড় মোড়, জিইসি মোড়, ষোলোশহর ২ নম্বর গেট, বহদ্দারহাট, জামাল খান, গণি বেকারি, চকবাজার, সিআরবি মোড়, আগ্রাবাদসহ আরও কয়েকটি স্থানে আড্ডা দেয়। গত এক মাসে এসব আড্ডাস্থল থেকে ৬০ কিশোরকে ধরে মুচলেকা নিয়ে অভিভাবকদের জিম্মায় দিয়েছে পুলিশ। এলাকায় আড্ডা দিতে দিতে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে তাদের সখ্য গড়ে ওঠে। এলাকার নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে বড় ভাইয়েরাও কিশোরদের বিভিন্ন দলকে কাছে টানেন। মিছিল সমাবেশেও কিছু কিশোরকে এখন অংশ নিতে দেখা যায়।

শুধু তাই নয়। সব সময় বিরোধী মতকে জংগী আখ্যা দিয়া আসলেও দৈনিক যুগান্তরের ০৮ এপ্রিল ২০১৮ তারিখের একটি রিপোর্টে দেখা যায়,ককটেল বানাতে গিয়ে চট্টগ্রামের এক ছাত্রলীগ নেতার হাত ঝলসে গেছে। ঘটনার পরপরই তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন। আহত সীমান্ত মহাজন (১৮) চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ড ছাত্রলীগের (একাংশ) উপ অর্থ সম্পাদক সীমান্ত ওই এলাকার উজ্জ্বল মহাজনের ছেলে ও ফতেয়াবাদ কলেজের মানবিক বিভাগের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। এ সবই হচ্ছে ছাত্রলীগের চরিত্র।

বাংলাদেশের আইনের প্রতিও তাদের শ্রদ্ধাশীল থাকতে দেখা যায় নি। বিভিন্ন আপরাধে আটক নেতাকর্মীদের ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন সময়ে অবৈধ মিছিল, সমাবেশ, হরতাল পালন করতে দেখা যায়। এতে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ তারিখে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে ছাত্রলীগের ছয় নেতা-কর্মীকে আটকের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে সড়ক অবরোধ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের একাংশ। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সড়কের দুই দিকে আটকা পড়ে অসংখ্য যানবাহন। প্রায় এক ঘণ্টা এই অবস্থা চলে। পুলিশ সূত্র জানায়, ১৯ ফেব্রুয়ারী সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বাঘাইছড়ি পৌর সদরের হাজীপাড়া এলাকায় দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ওসি মো. আবুল কালাম চৌধুরীর নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশ সেখানে যাওয়ার পর দুই পক্ষ সরে যায়। এরপর দুপুর ১২টার দিকে থানায় ফেরার পথে পরাজিত চেয়ারম্যান প্রার্থী আজিজুর রহমানের বাড়ির সামনে পুলিশের গাড়ি গতিরোধ করা হয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে আজিজুর রহমান ও তাঁর সমর্থকদের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে লোকজন পুলিশের ওপর চড়াও হয়। তখন ঘটনাস্থলে হাজির হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) একটি দল। পরে ছাত্রলীগের ঐ ছয় নেতা-কর্মীসহ সাতজনকে আটক করা হয়। কিন্তু এতে সরকারের কোন মাথা ব্যাথা নেই। এ ধরনের অন্যায় আবরোধে প্রশাসনের নিরবতা কখনই কাম্য না। আর অন্যদিকে ভিন্নমতের আন্দোলন হলে সরকারকে খুব সরব থাকতে দেখা যায়।

পুরো দশটা বছর ছাত্রলীগ শিক্ষাঙ্গনে ব্যাপক সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালায়। খুব কম প্রতিষ্ঠানই ছিলো যা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের শিকার হয় নি। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের হাতে নিহত হয়েছে অন্তত ৪৮ জন। আর আহত আহত হয়ছে দেড় হাজারেরও বেশি। আর আহতের সংখ্যাও হাজারের উপর। এ থেকে সহজেই অনুমেয় যে, ছাত্রলীগের পক্ষে শিক্ষা শান্তি নিশ্চিত করা কতটুকু সম্ভব। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যদিও ছাত্রলীগ আওয়ামীলীগের সহযোগী সংগঠন। কিন্তু খোদ আওয়ামীলীগের নেতারাই ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ট। তাই তাদের হাতে দেশ ও জাতি কতটা নিরাপদ তা চিন্তার অবকাশ রাখে।

সন্ত্রাসী কার্যক্রম

সন্ত্রাসী কার্যক্রম

সন্ত্রাসী কার্যক্রম

সন্ত্রাসী কার্যক্রম

সন্ত্রাসী কার্যক্রম

সন্ত্রাসী কার্যক্রম