তিন কোটি টাকার জমি কিনছেন ছাত্রলীগের ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সভাপতি তাজউদ্দীন আহমেদ ওরফে রানা। ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পারে শম্ভুগঞ্জের চর ঈশ্বরদিয়া মৌজায় ৮০ শতক জমি এক কোটি টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রি বায়না করে নিয়েছেন তিনি। অবশ্য তাজউদ্দীন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছেন, তাঁর নামে বায়না করা হলেও জমির মালিক তিনি নন।
‘রেজিস্ট্রি বায়নাসূত্রে এই জমির মালিক তাজউদ্দীন আহমেদ রানা’— এমন সাইনবোর্ড দেখে রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট লোকজনের প্রশ্ন, জেলা কমিটির একজন ছাত্রনেতা এমন বিত্তশালী হয়ে উঠলেন কীভাবে? নেপথ্যের ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল, ছাত্রলীগে পদ-পদবি বেচাকেনার অভিযোগ এখন স্থানীয়ভাবে আলোচিত। এর সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন স্থানীয় সাবেক ছাত্রলীগের নেতারা।
তবে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি পদ-পদবি কেনাবেচার রাজনীতি নিয়ে প্রথম আলোর প্রশ্নে একটু ক্ষুব্ধ হয়েই জানতে চান, ‘আমার মতো ছাত্রনেতারা এ রকম ঘৃণ্য কাজ করতে যাবে কেন? আমাদের টাকা-পয়সার এমন কী প্রয়োজন রয়েছে?’
চর ঈশ্বরদিয়া মৌজায় ৮০ শতাংশ জমি বায়না করার এক কোটি টাকা কোথায় পেলেন—জানতে চাইলে প্রথমে তিনি ভড়কে যান। পরক্ষণেই দাবি করেন, ওই জমির মালিক তিনি নন। জমিতে দেওয়া সাইনবোর্ডে তাঁর নাম কেন—জানতে চাইলে প্রথমে তিনি বলেন, এটি তাঁর বোনের জমি। কিছুক্ষণ পর বলেন, এটা তাঁর আপন বোনের নয়; খালাতো বোনের জামাইয়ের জমি।
সর্বশেষ ২২ আগস্ট রাতে তাজউদ্দীন টেলিফোন কনফারেন্সের মাধ্যমে জনৈক মোর্শেদকে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। মোর্শেদ নিজেকে তাজউদ্দীনের খালাতো বোনের স্বামী পরিচয় দিয়ে বলেন, তাঁরা চার ভায়রা তিন কোটি টাকার এ জমিটি কেনার জন্য এক কোটি টাকা দিয়ে শ্যালক তাজউদ্দীনের নামে বায়না করেছেন। শ্যালকের নামে বায়না করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, জমির নিরাপত্তার কথা ভেবে তাঁর নাম ব্যবহার করছেন।
আওয়ামী লীগের ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন সরকারের কাছে ছাত্রলীগের নেতার বিরুদ্ধে পদ-পদবি বেচাকেনার অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিও আপনাদের মতো এ অভিযোগ শুনেছি। পরে আমার নিজের এলাকা ত্রিশালে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, যে ছেলেটিকে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয়েছে সেই মাহমুদুল হাসান ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্যও ছিলেন না। সাধারণ সম্পাদক ইমরানের নামে খুনের মামলা। ত্রিশালে “দুলু ডাকাত” বলে পরিচিত ইমরানের বাবার নামেও মামলা আছে। এ ধরনের লোকেরা কীভাবে কমিটিতে আসে সেটাই প্রশ্ন।’
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক, গত কমিটির সভাপতি শরীফ হাসান ও সাংগঠনিক সম্পাদক মোহিতউর রহমানের কাছে টাকার বিনিময়ে পদ-পদবি বেচাকেনার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তাঁরাও এ অভিযোগ শুনেছেন বলে জানান। আনোয়ারুল হক বলেন, ‘যা রটে তা কিছু বটে। তাই আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগটি খতিয়ে দেখা উচিত।’ সাবেক সভাপতি ও সাংগঠনিক সম্পাদকও অভিযোগের সত্যাসত্য যাচাইয়ের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের উদ্যোগী হওয়া উচিত বলে মত দেন।
ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তাজউদ্দীন আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক এ বি এম আখতারুজ্জামান ওরফে রবিন পরস্পরবিরোধী দুটি বলয়ে বিভক্ত। মূলত ছাত্রলীগের এর আগের জেলা কমিটির সভাপতি শরীফ হাসান ওরফে অনু এবং সাংগঠনিক সম্পাদক ও ময়মনসিংহ সদরের সাংসদ মতিউর রহমানের বড় ছেলে মোহিতউর রহমান ওরফে শান্তকে ঘিরে বলয় দুটি তৈরি হয়েছে। জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রথম আলোর কাছে অকপটে সংগঠনের ভেতর এ দুটি বলয়ের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়েছেন। কিন্তু পদ-পদবি বেচাকেনার অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন।
ভালুকায় ছাত্রলীগের সভাপতি জামায়াত নেতার ছেলে সাধারণ সম্পাদক রাজাকারের নাতি: ছাত্রলীগের অপূর্ণাঙ্গ জেলা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সময় ভালুকার শিল্পসমৃদ্ধ ইউনিয়ন হবিরবাড়ি থেকেই আটজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ নিয়ে সন্দেহের মুখে পড়েন জেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। পাশাপাশি ভালুকায় ছাত্রলীগের উপজেলা কমিটিতে জামায়াত নেতার ছেলে মমিনুজ্জামান ওরফে মামুনকে সভাপতি ও রাজাকারের নাতি মাহমুদুল হাসান ওরফে শাতিলকে সাধারণ সম্পাদক করার বিনিময়ে টাকা-পয়সা লেনদেনের অভিযোগও পাওয়া যায়।
রাজৈ ইউনিয়ন শাখা আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, মমিনুজ্জামানের বাবা আবদুল আলিম জামায়াতে ইসলামীর একজন নেতা। আর মাহমুদুল হাসানের ব্যাপারে বলা হচ্ছে, তাঁর দাদা আবদুল মজিদ পাঠান ও নানা বারেক চৌধুরী রাজাকার ছিলেন। তাঁর বাবা কামরুল হাসান পাঠান একসময় বিএনপি ও পরে জাতীয় পার্টি করতেন।
মমিনুজ্জামান দাবি করেন, তাঁর বাবাকে জামায়াতে ইসলামীর নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করার ঘটনাটি ষড়যন্ত্রমূলক। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপের দুই দিন পর ২৪ আগস্ট বিকেলে মমিনুজ্জামান দলবল নিয়ে রাজৈ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হকের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে একজন ত্যাগী ছাত্রলীগের কর্মী বলে প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার দাবি জানান। এলাকায় ‘হক স্যার’ নামে পরিচিত প্রবীণ শিক্ষক আবদুল হক প্রথম আলোকে জানান, তিনি অপারগতা প্রকাশ করলে মমিনুজ্জামান ও সঙ্গীরা আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে সাদা কাগজে তাঁর স্বাক্ষর আদায়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে বাড়িতে ভাঙচুর করেন। এ ঘটনায় ২৫ আগস্ট ভালুকা থানায় মমিনুজ্জামানসহ অজ্ঞাত ১৫ জনের নামে মামলা হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান অবশ্য কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাঁর বাবার সঙ্গে কথা বলার অনুরোধ করেন। তাঁর বাবা কামরুল হাসান পাঠান বলেন, ‘মাহমুদুলের দাদা নন, নানা রাজাকার ছিলেন। তবে তালিকাবদ্ধ রাজাকার ছিলেন না। দাদা আবদুল মজিদ পাঠান ছিলেন আওয়ামী লীগের অনুসারী। তবে তিনি একসময় ভালুকায় জিয়াউর রহমানের জাগো দলের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং সুযোগ পাওয়ামাত্র ওই পার্টি ছেড়ে দিয়েছিলেন।’ কামরুল হাসান নিজেকে ভালুকা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, তাঁর রাজনীতির শুরু ছাত্র ইউনিয়ন দিয়ে। একসময় বন্ধুবান্ধবের টানে কিছুদিন জাতীয় পার্টি করলেও কখনো বিএনপি করেননি। ১৯৯৬ সাল থেকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আছেন।
ভালুকা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাংসদ এম আমান উল্লাহ উপজেলা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে অত্যন্ত বিতর্কিত ও ভয়াবহ সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘আমার অভিযোগের কারণে ওদের দুজনের নেতৃত্বে গড়া ভালুকা ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল করা হয়েছে।’ তবে ছাত্রলীগের ওই দুই নেতা জানান, তাঁরা কমিটি বাতিলের কোনো চিঠি পাননি।
ত্রিশালের সাধারণ সম্পাদক খুনের মামলার আসামি: ত্রিশালে আওয়ামী লীগের সাবেক সাংসদ রুহুল আমিন মাদানীর ছেলে হাসান মাহমুদকে সভাপতি ও ইমরান হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। হাসান মাহমুদ এর আগে ছাত্রলীগের সদস্যও ছিলেন না। আর ইমরানের নামে খুনের মামলা ছিল এবং তাঁর বাবা এলাকায় ‘দুলু ডাকাত’ নামে পরিচিত।
হাসান মাহমুদ ১৯৯৬ সাল থেকে ত্রিশালে ছাত্রলীগের হাল ধরে রাখার দাবি করে বলেন, তার পরও রাজনৈতিকভাবে তাঁর বাবার প্রতিপক্ষ হিসেবে পরিচিত জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ত্রিশালের বাসিন্দা আবদুল মতিন সরকারের কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্য হতে পারেননি। ছাত্রলীগের সদস্য না হলেও হাসান মাহমুদকে উপজেলা কমিটির সভাপতি করেছে জেলা ছাত্রলীগ।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইমরান হাসানের প্রশ্ন, ছাত্ররাজনীতি করতে এলে কারোর পিতৃপরিচয় নিয়ে কেন টানাটানি করা হবে? তিনি তাঁর নামে একটি হত্যা মামলা ছিল স্বীকার করে বলেন, পুলিশি তদন্তে প্রমাণ হয়েছে যে ওই মামলাটি ছিল মিথ্যা।
হাসান মাহমুদ নিজেকে জেলা ছাত্রলীগের এক পক্ষের নেপথ্যচালক শরীফ হাসান ও এ বি এম আখতারুজ্জামানের মনোনীত এবং ইমরান হাসান নিজেকে মোহিতউর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমেদ মনোনীত বলে জানান।
এগিয়ে সাংসদ মতিউরের ছেলে: ছাত্রলীগে বিদ্যমান বলয় দুটির নেপথ্যের পরিচালকদ্বয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতায় ময়মনসিংহ সদরের সাংসদ মতিউর রহমানের বড় ছেলে মোহিতউর রহমান এগিয়ে আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের বৃহৎ অংশটিকে নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের কর্মকাণ্ডে হস্তক্ষেপের অভিযোগ আছে।
জানতে চাইলে মোহিতউর রহমান বলেন, ‘আমার মতো রাজনৈতিক পরিবারের একজন ছেলে রাজনীতিতে আসবে, সক্রিয় থাকবে এতে তো বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।’
প্রচার আছ, মোহিতউর রহমান জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে চান। তাই স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি পদে এ বি এম নূরুজ্জামান ওরফে খোকনের নাম ঘোষণা করা হয়। আর সাধারণ সম্পাদক পদে মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক ওরফে রিপনের নাম প্রস্তাবিতই রয়ে গেছে, ঘোষণা হচ্ছে না।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদে আসতে চান কি না, জানতে চাইলে মোহিতউর রহমান বলেন, ‘আমি স্বেচ্ছাসেবক লীগেও আসতে পারি। তার মানে এই নয় যে আমি চাইলে যেকোনো পদ পেয়ে যাব। আমার পদ নির্ধারণ করবেন দলের নেতা-কর্মীরা। সর্বোপরি রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা।’
সাধারণ সম্পাদক পদে প্রস্তাবিত আনোয়ারুল হক সম্পর্কে জানতে চাইলে মোহিতউর রহমানের মন্তব্য, ‘রিপন (আনোয়ারুল হক) ভাই ছাত্রলীগে আমার ঠিক আগের কমিটিতে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। কিন্তু তিনি বহুদিন ধরে নিষ্ক্রিয় আছেন।’
নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ সম্পর্কে আনোয়রুল হক বলেন, ‘আসলে স্যার (সাংসদ মতিউর রহমান) পরিবার-পরিজনের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। তাই স্যারের কাছে যেতে না পেরে আজকাল অনেকেই স্যারের ছেলের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। আমি স্যারের ছেলের কাছে ধরনা দিয়ে পড়ে থাকতে পারি না বলেই নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ উঠেছে।’
স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ বলেন, ‘ময়মনসিংহে স্বেচ্ছাসেবক লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি করার সময় আমরা দলের মধ্যে মত ও পথ নিয়ে বিরোধের কথা মাথায় না রেখে পরীক্ষিত সাবেক ছাত্রনেতাদের কমিটিতে নেব।’