দেশে থামছে না সংখ্যালঘু নির্যাতন। বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘটছে সাম্প্রদায়িক হামলা। কখনো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে হত্যা কিংবা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। কখনো ক্ষমতার জোরে চলছে জমি দখল আর লুটপাট। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, সরকারের নমনীয় নীতির ফলে এমন সন্ত্রাসী কর্মাণ্ডের বিস্তার ঘটছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই ঘটনাগুলোকে উসকে দিচ্ছে বলেও মত তাদের। তবে সরকার দলীয় রাজনীতিবিদরা হামলাগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবি করছেন।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর তিনশ’ তিনটি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে বাসস্থান ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ একশ’ ৬৮টি, প্রতিমা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ ১৩০টি এবং জমি ও বসতবাড়ি দখলের ঘটনা ঘটেছে পাঁচটি। এই ঘটনাগুলোতে ৭ জন নিহত ও ৪৯ জন আহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র তথ্যমতে, ২০০১ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে দেশে শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমেছে ৯ লাখের মতো। পরিসংখ্যানে দেখানো হয়, ২০০১ সালে গোপালগঞ্জে হিন্দু ছিল তিন লাখ ৭১ হাজার ৬২৯ জন। কিন্তু ২০১০ সালে তা তিন লাখ ৫৩ হাজার ৭৯৪ জনে দাঁড়িয়েছে।
আদিবাসী সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্যে ২০০৭ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত পর্যন্ত আট বছরে সাঁওতালদের সঙ্গে ভূমি কেন্দ্রিক ৯০টি সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় ১৬ জন সাঁওতাল নিহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য মতে, ২০১৫ সালে সারাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কমপক্ষে ২৬২টি হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং এতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে ১৫৬২টি পরিবার। এসব হামলায় ২৪জন নিহত হয়েছেন। এছাড়াও নারী অপহরণ, ধর্ষণ, সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনাও রয়েছে।
ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে গত ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটে। তব হামলার পর সরকার দলীয় লোকজন সব স্বাভাবিক আছে বলে দাবি করেন। কিন্তু জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে আসে, হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর ও মন্দিরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ছিল সুপরিকল্পিত। একই ঘটনায় পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতি আর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের দ্বন্দ্বের বিষয়টি উঠে আসে। পুলিশি পাহারার মধ্যে গত ১৩ ও ১৬ নভেম্বরও নাসিরনগরে আবার হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটছে।
এর বাইরে দেশব্যাপী আলোচিত আরও একটি সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। এখানে খামারের জমিতে আখ রোপণ করাকে কেন্দ্র করে ৬ নভেম্বর পুলিশের সঙ্গে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সংঘর্ষে তিন সাঁওতাল নিহত হন। সেসময় কয়েক দফার সংঘর্ষে ৯ পুলিশ, সাঁওতাল ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীসহ অন্তত ৩০ জন আহত হন। এখানে হামলার পর থেকেই এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় এমপি এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে ইন্ধনের অভিযোগ ওঠে।
সম্প্রতি এই দুটি বড় চিত্রের পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, জমি দখল ও এলাকা ছাড়া করার বহু অভিযোগ রয়েছে এবং এই অভিযোগের তীর সরকার দলীয় নেতাকর্মীদের দিকেই বেশি। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ বিভিন্ন সময় সংবাদ করে এসব অভিযোগ জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাস গুপ্ত বলেন, ‘ক্ষমতাসীন দলের আশ্রয়ে প্রভাবশালীরা ক্রমাগতভাবে এসব করছে।’
সংখ্যালঘুদের ওপর এসব হামলার পেছনে প্রভাবশালী মহলই জড়িত বলে মনে করেন আইন ও সালিম কেন্দ্রের (আসক) তদন্ত সেলের পরিচালক নূর খান। সরকারি দল কিংবা ক্ষমতাশীলরাই এসব ঘটনার সাথে জড়িত জানিয়ে এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, ‘এই ঘটনাগুলো কিন্তু আজকে বা কালকের নয়। নিত্যদিনের। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তখন তারাই এই কাজগুলো করে। মানে সরকারি প্রভাব কাজে লাগিয়ে একটি ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি করে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালায়, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরকার আসলে মুখেই সাম্প্রদায়িকতার কথা বলে, কাজের ক্ষেত্রে নয়’। সংখ্যালঘুদের ওপর ক্রমাগত এই নির্যাতনগুলো বিচারহীনতার কারণে থামছে না বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী নূর খান।
প্রভাবশালী মহলের কারণে সাম্প্রদায়িক হামলা থামছে না এ কথা জাতীয় মানবাধিকার কমিশেনর চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও মনে করেন। আবার স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বলতার কারণেও এমন হামলার ঘটনা ঘটছে বলে জানান তিনি। এ ক্ষেত্রে তিনি নাসিরনগরের ঘটনাকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
রাজনীতিকে পুঁজি করে সরকারদলীয় কিছু লোকজনও এসব হামলার জড়িত, সম্প্রতি বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনেই এ তথ্য উঠে এসেছে জানিয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী ও কিছু দুষ্ট লোকজন পরিকল্পিতভাবে হামলার ঘটনা ঘটাচ্ছে। আসলে এরা রাজনীতির আড়ালে ফায়দা লুটতে চায়। এর জন্য সরকার, পুলিশ প্রশসান ও স্থানীয় প্রশাসনকে শক্তভাবে বিষয়টি দমন করতে হবে।’
তবে এর মধ্যে উচ্চ আদালতের কিছু রায়ের মধ্য দিয়ে আশার আলো দেখছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। এরই মধ্যে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে উচ্চ আদালতের কয়েকটি রায় আশাব্যঞ্জক। সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনায় আসামিদের ধরা হচ্ছে। বিচারের আওতায় আসছে। আবার নাসিরনগরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে সেটাও ভালো দৃষ্টান্ত বলে জানান রিয়াজুল।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের দায়িত্বহীনতার কারণে সাম্প্রদায়িক হামলা বাড়ছে এবং সরকার মৌলবাদীগোষ্ঠী কিংবা ধর্মান্ধদের সাথে আপোষ করছে বলে অভিযোগ করেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। আর বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন থামছে না বলে মত তার।
আদিবাসীদের মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমা বলনে, ‘আমার মতে বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে হামলা থামছে না। একটা ঘটনা যখন ঘটে, আলোচিত হয়, মামলা হয়, অনেক সময় আসামি গ্রেফতার করা হয় কিন্তু কেউ শাস্তি পায় না। এই কারণে হামলাকারীরা উৎসাহিত হয়।’
তবে হামলাকারীরা যে শুধু সরকারদলীয় হয় একথা মানতে নারাজ পল্লব। তিনি বলেন, ‘আমাদের রাঙ্গামাটিতে যখন আদিবাসীদের ওপর যখন হামলা হয় তখন সবাই হামলা করে। এ সময় আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কিংবা অন্য দল লাগে না।’
‘বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ বহু বছর ধরে পাশাপাশি একে অন্যের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করলেও বিগত কয়েক বছর ধরে অপরাজনীতির মাধ্যমে বিভেদ তৈরি করা হচ্ছে। রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিয়ে বিভাজনের রাজনীতি করার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। ফলে অতীতে যে সহিঞ্চুতা ও সহমর্মিতার পরিবেশ ছিল তা খুব দ্রুতই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে’ বলে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা সংস্থা অধিকার তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে।
সংখ্যালঘুদের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্রে তাদের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করার জন্যও রাষ্ট্র ও সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ারও আহবান জানায় এই মানবাধিকার সংস্থা।