মুসলিমা জাহান
গত বছর তিন শতাধিক শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, যা ওই সময়ের মোট ধর্ষণের ঘটনার প্রায় অর্ধেক। শিশুদের অর্ধেকই আবার একেবারে কম বয়সী, ১২ বছরের নিচে। অনেকের বয়স ৬ বছরও পেরোয়নি। এসব ঘটনার এক-তৃতীয়াংশের ক্ষেত্রে কোনো মামলাও হয়নি।
মানবাধিকার ও শিশু অধিকার-বিষয়ক দুটি বেসরকারি সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে এ চিত্র পাওয়া গেছে। মনোরোগ চিকিৎসক, আইনজীবী ও শিশু অধিকারকর্মীদের মতে, শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বলে তারা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বেশি। পাশাপাশি ধারণা করা হয়, এরা অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারবে না। তাঁরা বলছেন, এটা প্রতিরোধ করার জন্য দরকার দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।
এ ধরনের ঘটনা নিন্দনীয় উল্লেখ করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, শিশু ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীর পার পাওয়ার সুযোগ নেই। আইনের আওতায় এনে তাদের বিচার করা হবে। তবে শিশুরা সব সময় ঘটনার কথা বলতে পারে না, সাক্ষীও থাকে না। মামলা দুর্বল হয়। ফলে অভিভাবককে সন্তান পালনে আরও সচেতন ও মনোযোগী হতে হবে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বলছে, ২০১৬ সালে মোট ধর্ষণের ঘটনা ৭২৪টি। এর মধ্যে ৩০৮টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ১৫৭টি শিশুর বয়স ১২ বছরের কম। ৬ বছরের নিচে আছে ৪৬টি শিশু। আটটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর এবং নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে সংস্থাটি এ তথ্য পেয়েছে।
শিশুবিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলোর জাতীয় নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) ১০টি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে বছরওয়ারি পরিসংখ্যান রাখে। বিএসএফের তথ্যমতে, একই বছরের প্রথম ১১ মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ৪ শতাধিক। যার মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৪টি শিশু। ধর্ষণের শিকার অটিস্টিক শিশুর সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য, ৩৮টি। ধর্ষণের শিকার বেশির ভাগ শিশুর বয়স ৪ থেকে ৯। ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ছিল ৫২১টি।
শিশু ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে উল্লেখ করে সংগঠনটির পরিচালক আবদুস শহিদ মাহমুদ বলেন, ছোট শিশুরা বেশির ভাগ সময় কিছুই বুঝতে পারে না। ফলে অপরাধীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করে; চিহ্নিত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।
বিকেলে বাসার পাশেই প্রাইভেট পড়তে যায় সাত বছরের একটি শিশু। দ্বিতীয় শ্রেণির ওই ছাত্রী অন্য দিনের চেয়ে অনেকটা দেরি করে বাসায় ফেরে। পরে পরিবার জানতে পারে, অপরিচিত এক ব্যক্তি তাকে ধর্ষণ করেছে। ঘটনাটি ২০১৬ সালের অক্টোবরে, রাজধানীর শান্তিবাগে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেডোফিলিয়া নামের মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শিশুদের প্রতি যৌন আকর্ষণ থাকে। কিছু ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের এটিও একটি কারণ।
তবে এটাই একমাত্র কারণ নয় বলে মনে করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহিত কামাল। তিনি বলেন, শিশু ধর্ষণের পেছনে মানুষের মূল্যবোধ-নৈতিকতার অবক্ষয়, পর্নোগ্রাফি, মাদকের প্রভাবও রয়েছে। পাশাপাশি, শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতাও কম।
এ বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক বলেন, ‘আমরা অনেক ক্ষেত্রে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারছি না। এ সুযোগটিই অপরাধীরা নিচ্ছে। অপরাধীরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পেলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা কমবে। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠন এবং পরিবারকে আরও সোচ্চার হতে হবে।’
হত্যা ও আত্মহত্যা: আসকের তথ্যমতে, গত এক বছরে ১৬টি শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে হত্যা করা হয় ৪টি শিশুকে। হত্যার শিকার ১০টি শিশুর বয়সই ১২ বছরের কম।
এ বিষয়ে আসকের উপপরিচালক ও আইনজীবী সালমা জেবিন বলছেন, অপরাধী তার অন্যায়ের কোনো চিহ্ন রাখতে চায় না, যাতে তাকে শনাক্ত করা যায়। এ জন্যই ধর্ষণের পর শিশুটিকে মেরে ফেলা হয়।
ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে তিনটি শিশু। এদের বয়স ১৩ থেকে ১৮।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ চিকিৎসক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বলছেন, ছোট শিশুরা ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পারে না। একটু বড় হলে তারা ঘটনা-পরবর্তী বিষণ্নতায় আত্মহত্যা করতে পারে। তাদের বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগার প্রকোপও বেশি।
মামলা কম, বিচারে দীর্ঘসূত্রতা: আসকের হিসাব বলছে, ৩০৮টি শিশু ধর্ষণের ঘটনার মধ্যে ১১০টি ঘটনায় মামলা হয়নি। তবে হত্যা ও আত্মহত্যার ঘটনায় মামলার হার তুলনামূলক বেশি।
এর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবারে এ ধরনের ঘটনা লুকিয়ে রাখার প্রবণতা প্রকট। ধর্ষণের শিকার শিশুর শারীরিক অবস্থা গুরুতর না হলে বা হত্যা-আত্মহত্যার ঘটনা না ঘটলে সাধারণত আইনি সহায়তা নেওয়া হয় না। প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই বেশির ভাগ সময় এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকে। তাদের ভয়ে পরিবার মামলা করতে সাহস পায় না। আবার মামলা করলেও আপস করে ফেলতে হয়। সাক্ষী সুরক্ষা আইন না থাকায় অনেক সময় সাক্ষী পাওয়া যায় না।
২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি নরসিংদীর একটি উপজেলায় দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় সাত বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণ করে। এ ঘটনায় গত বছরের মাঝামাঝি একজনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় স্থানীয় থানার পুলিশ। আসামি এখন জামিনে রয়েছে।
দিনাজপুরে গত বছরের ১৯ অক্টোবর ৫ বছরের একটি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় মামলা হয় ২৩ অক্টোবর। ঘটনার আড়াই মাস পার হলেও এখনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে আইনজীবী সালমা আলী বলেন, এ ধরনের ঘটনায় পরিবারকে প্রতিবাদী হতে হবে। পরিবার ও আক্রান্তকে বুঝতে হবে, এতে তাদের কোনো দায় নেই। এ লজ্জা অপরাধীর। তিনি বলেন, আইনি সহায়তা নেওয়ার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তি নয়, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে প্রমাণ করতে হবে, তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নন। এ জন্য আইনেরও পরিবর্তন প্রয়োজন।