সাধন সরকার
যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বেকারত্ব এখন এক গভীর ও জাতীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৫-১৬ অনুসারে এ দেশে বর্তমানে ২৬ লাখ বেকার। এদের মধ্যে পুরুষ ১৪ লাখ, আর নারী ১২ লাখের মতো। দেশের নীতি-নির্ধারকেরা জনসংখ্যাকে জনসম্পদ বলে আত্মতুষ্টি লাভ করলেও বাস্তবে এর বিপরীত অবস্থা দেখা যাচ্ছে। গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশে উন্নীত হলেও বেকারের সংখ্যা কিছুতেই কমছে না। অনেকে একে কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি বলে উল্লেখ করেছেন। প্রান্তিক তরুণ জনগোষ্ঠীর কাছে উন্নয়নের ছোঁয়া সঠিকভাবে যাচ্ছে কিনা তা এক বিরাট প্রশ্নের বিষয়।
বিবিএসের জরিপ অনুযায়ী, কাজ করেন না এমন কর্মোপযোগী জনগোষ্ঠীকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—বেকার, খণ্ডকালীন কর্মজীবী ও সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে, সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের’ (ইআইইউ) প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ স্নাতকই বেকার। কিন্তু এই শিক্ষিত তরুণেরা দেশের বোঝা নয়, মূলত দেশের সম্পদ! বেকার নারী-পুরুষ হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছেন কিন্তু তারা পাচ্ছেন না। পরিবারের মা-বাবা হয়তো পড়াশোনা শেষ করা ছেলে কিংবা মেয়েটির পথ চেয়ে বসে আছে কখন তারা পরিবারে সচ্ছলতা আনবে ও তাদের মুখে হাসি ফুটাবে। একজন বেকারের নীরব যন্ত্রণা কেউ অনুভব করে না, কেউ বোঝে না তাদের মনের কথা। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সেশনজট, নড়বড়ে শিক্ষাব্যবস্থা ও সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ার কারণে মূলত বেকারত্ব তৈরি হচ্ছে। ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষা হলো দারিদ্র্র্র্য বিমোচনের প্রধান শর্ত। কিন্তু আমরা যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু রেখেছি তা আদৌ শিক্ষিত তরুণদের কাঙ্ক্ষিত চাহিদা পূরণ করতে ভূমিকা রাখছে কিনা তা ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। একজন স্নাতক বা স্নাতকোত্তরধারী কিংবা শিক্ষিত তরুণ তার পড়ালেখা শেষে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি করবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া আর উপায় কী? কেননা এদেশে একজন তরুণের উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
দেশে উন্নয়নের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। আর লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ বেকারের যন্ত্রণা বেড়েই যাচ্ছে। দেশে কাজ না পেয়ে বিদেশে কাজের আশায় দুবেলা-দুমুঠো ভাতের জন্য এদেশের তরুণেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ-মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য যাত্রাপথে জীবন দিয়ে দিচ্ছে কিংবা পৌঁছাতে পারলেও নানা সমস্যার কারণে লুকিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। এদেশের শিক্ষিত তরুণেরা কাজ পাচ্ছে না অথচ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিদেশ থেকে উঁচু বেতন দিয়ে দক্ষ কর্মী নিয়ে আসছে। অর্থাত্ মোদ্দাকথা, আমরা যোগ্য লোকবল তৈরি করতে পারছি না। অথচ শিক্ষিত তরুণদের মেধা ও শ্রম যদি কাজে লাগানো যায় তাহলে দেশের অর্থনীতি আরো এগিয়ে যাবে। কিন্তু নীতি-নির্ধারকদের ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এসব নিয়ে ভাবনার সময় আদৌ আছে কি? আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ তৈরি করতে আর সুইস ব্যাংকে ডলারের পাহাড় গড়তে! চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩০ এ আটকে রেখে এদেশের তরুণদের উপর অবিচার করা হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষিত তরুণদের কাজে লাগাতে দেশের উন্নয়নে চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানো প্রয়োজন। এতে করে বেকারত্বের বোঝা কমবে। তরুণেরা কাজের সুযোগ না পেয়ে অনেকে মাদকসহ নানাবিধ অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। হতাশায় দিশেহারা হয়ে জীবন কাটাচ্ছে।
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ৩ লাখ শূন্য পদ রয়েছে। তাহলে কেন এসব শূন্যপদ পূরণের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না? পদ শূন্য থাকার ফলে দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় জটিলতা দেখা দিবে। অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে বেকারদের জন্য দ্রুত কর্মসংস্থানের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার। দেশে এখন বেকারত্বের হার প্রায় ৫ শতাংশের কাছাকাছি। দেশের শিক্ষিত তরুণদের উদ্যোক্তা তৈরিতে কিংবা বিদেশে কাজের জন্য প্রস্তুত করতে সঠিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার প্রয়োজন রয়েছে। এ ব্যাপারে সরকারকে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। বেকাররা দেশের অভিশাপ নয়। তারাও সুযোগ পেলে দেশের ও পরিবারের জন্য কিছু করতে চায়। নীতি-নির্ধারকদের সেই সুযোগ তৈরি করতে হবে। তা না হলে বড় ধরনের জনশক্তির অপচয় হবে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে। দরকার শুধু বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা। মনে রাখতে হবে শিক্ষিত তরুণদের যদি কর্মসংস্থান করা না যায়, তাহলে সেটি দেশের জন্য বড় ক্ষতিই হবে। কেননা বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তরুণদের বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে হবে।