মুহাম্মদ আবদুল কাহহার
গত শুক্রবার ভোরে দেশের দু’সীমান্ত কুড়িগ্রামের রৌমারী ও ঝিনাইদহের মহেশখালীতে দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। জানা গেছে, বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় বিএসএফ সদ্যসরা গুলি করে মানুষ মারছে। কখনো কৃষক কখনো দিনমজুর অথবা অসহায় দরিদ্র নারী ফেলানির মতো মানুষরা হত্যা কিংবা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে গরু ব্যবসায়ী বা কৃষককে তাদের ক্যাম্পের পাশের মাঠে নিয়ে প্রকাশ্যে মারপিটসহ নানা নির্যাতন করছে। ইউটিউবে অনুসন্ধান করলে এমন ঘটনার ভিডিও দেখা যাবে। রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে ও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নির্যাতন করে তারা মারতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়েও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের চোখের কাঁটা হয়ে নীরবে জুলুম নির্যাতন সহ্য করতে হয়।
বিএসএফের আক্রমণের শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে আমাদের স্বজনরা। এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে বড়ই অসহায় মনে হয়। সামান্য কারণে একজনের প্রাণ চলে যাচ্ছে আর আমরা নিশ্চিন্ত মনে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি। দেশের ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি করছি। ক্ষমতাকে আকড়ে ধরতে বা দীর্ঘসময় টিকে থাকতে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দাদাদের প্রণাম করে চলছি। সখ্যতায় ভাটির টান লাগতে পারে অথবা ক্ষমতা হারানোর ভয় করেই নিয়মিত অন্যায়কে জেনে বুঝেই মেনে নিচ্ছি। জোড়ালো প্রতিবাদও করি না।
এটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবনারও সময় আমাদের অনেকের হয় না। ১৬ কোটি মানুষের মধ্য থেকে গুটি কয়েক মানুষ মানববন্ধন করছেন। কেউ আবার দু’চার লাইন লিখে লিখে প্রতিবাদ করছেন। আবার কেউবা সভা সেমিনারে বক্তৃতায় নির্যাতিত মানুষের সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরছেন। তবুও দেশের অভিভাবকদের পক্ষ থেকে মানুষ হত্যা বন্ধে তেমন কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায় না। নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ না করে বরং বিএসএফ-কে উসকে দেয়ার মতো দায়িত্ব-জ্ঞানহীন কথাও বলেন কেউ কেউ। চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তো বলেই ফেললেন, ‘সীমান্তে যা কিছু ঘটছে, তা নিয়ে রাষ্ট্র চিন্তিত নয়। এসব অতীতে ঘটছে, এখনো ঘটছে এবং ভবিষ্যতেও ঘটবে। এগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে সরকার মনে করে না।’
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে প্রতিবছর কত মানুষ মারা যায় তার পরিসংখ্যান তুলে ধরতে না পারলে বিষয়টি হয়তো অস্পষ্টই থেকে যাবে। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র(আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালে সীমান্তে ১৫৫টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। এর মধ্যে ৪৮ জন হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন। ২০১২ সালে সীমান্তে হত্যা ও নির্যাতনের ৩১৯টি ঘটনা ঘটছে। ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন, ২০১৪ সালে ৩৩ জন, ২০১৫ সালে ৪৫ জন বাংলাদেশীকে তারা হত্যা করছে। আর ২০১৬ সালের প্রথম ছয় মাসে সীমান্তে ১৬ জন হত্যা করা হয়েছে।
সর্বশেষ গত শনিবার কুড়িগ্রাম সীমান্তে নিহত হন দু’জন। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও শালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএসএফের হাতে অন্তত ২৮ জন বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলার ঘটনায় ১৩ জন নিহত হয়েছে। ১৯৯৭ সালে ৩৯টি ঘটনায় ১১ জন, ১৯৯৮ সালে ৫৬টি ঘটনায় ২৩ জন, ১৯৯৯ সালে ৪৩ ঘটনায় ৩৩জন, ২০০০ সালে ৪২টি ঘটনায় ৩৯জন, ২০০১ সালে ৯৪জন নিহত হন। ২০০২ সালে ১০৫ জন, ২০০৩ সালে ৪৩ জন, ২০০৫ সালে ১০৪ জন, ২০০৬ সালে ১৪৬ জন, ২০০৭ সালে ১২০ জন, ২০০৮ সালে ৬২ জন, ২০০৯ সালে ৯৬ জন, ২০১০ সালে ৭৪ জন, ২০১১ সালে ৩১ জন, ২০১২ সালে ৩৮ জন, ২০১৩ সালে ২৯ জন, ২০১৪ সালে ৩৩ জন, ২০১৫ সালে বিএসএফ হত্যা ৪৫ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে।
আর বেসসরকারি হিসাব মতে গত ২০ বছরে প্রায় দেড় হাজার বাংলাদেশী বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন। নির্যাতন আর আহতদের সংখ্যা হিসাবে করলে সংখ্যাটি দু’হাজারের অধিক হতে পারে। একটি মানুষ মারা গেলেও অনেক সময় একটি পরিবার হারিয়ে যায়। পরিবারের অন্য সদস্যদের কষ্টের সীমা থাকে না। আমরা কি চিন্তা করে দেখতে পারি না বাবা, ভাই আর সন্তানের শোক সহ্য করতে আমাদের কত কষ্ট হয়। তাহলে ওইসব পরিবারগুলো কীভাবে তাদের স্বজনদের শোক বহন করে? দু’হাজার নয়, দু’জনের প্রাণ গেলেও রাষ্ট্রকে সেটা বন্ধ করতে উদ্যোগ নিতে হবে।
মানুষের জীবনের কোনই মূল্য নেই। এক দিকে বিএসএফের গুলিতে মানুষ মারা যাচ্ছে। অপরদিকে সরকারি পয়সা ব্যয় করে চট্টগ্রামে চিড়িয়াখানায় পশুর সাথে পশুর বিয়ে দিয়ে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠছে কতিপয় রুচিহীন মানুষ। এর কোনটিই যেন দেখার কেউ নেই! বর্ডারে মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারাতে থাকবে আর আমি দেশ পরিচালনায় সফল ব্যক্তি দাবি করবো, এমনটি আসলেই বেমানান। ২০১১ সালে বিএসএফ এবং বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত চোরাচালান ঠেকাতে প্রাণঘাতী নিয়ে নয়, এমন অস্ত্র ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়, যাতে হতাহত ব্যক্তিদের সংখ্যা কমানো সম্ভব হয়। কিন্তু তারা সেই কথা রাখেনি। এছাড়া গত জুলাই মাসে নয়াদিল্লিেিত দুই প্রতিবেশী দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে রাজনাথ সিং বলেছেন, সীমান্তে হত্যা বন্ধে জোর প্রচেষ্টা করা হবে। কিন্তু তাদের আশ্বাস নিয়মিত অসত্যে পরিণত হচ্ছে। এমনকি সম্প্রতি দিনাজপুর জেলার মোহনপুর সীমান্তে ভারতের অভ্যন্তরে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী সাদেকুল ইসলাম নিহত হওয়ার খবর এসেছে। নিহত সাদেকুল পেশায় কৃষক বলে জানা গেছে। তার শরীরে গুলির চিহ্ন রয়েছে। এই যদি হয় বিএসএফ সদস্যদের চরিত্র তাহলে তাদেরকে বিশ্বাস করা অনুচিত।
সীমান্ত পার হয়ে যেসব ব্যবসা হয় তাতে দু’দেশেই লাভ হয়। কিন্তু যখন কোন ক্ষতি হয় তখন শুধুই বাংলাদেশের হয়। চলতি বছর জানুয়ারি থেকে দেশের ছাগলনাইয়া-শ্রীনগর সীমান্তে প্রতি মঙ্গলবার হাট বসলেও বাংলাদেশীদের চেয়ে ভারতীয় দক্ষিণ ত্রিপুরার ব্যবসায়ীরা অধিক উপকৃত হচ্ছেন। ভারত আমাদের দিয়ে ব্যবসায় লাভবান হচ্ছে। মুনাফা করছে। কিন্তু আমরা সে তুলনায় কিছুই করতে পারছি না। তারপরও দু’একদিন পরপর সেই ভারতীয় জাওয়নরা আবার এ দেশীয়দের গুলি করে হত্যা করছে। যতবারই গুলি করে মানুষ মারা হচ্ছে ততবারই বলা হয় আত্মরক্ষার স্বার্থেই গুলি করা হয়েছে, এই হলো মানবতা! বারবার কথা দিয়েও বিএসএফ সদস্যরা সে কথা মানছেন না। তাছাড়া প্রশ্ন হলো, সীমান্তে গরু চোরাচালানকারীরা হত্যার শিকার হলেও কোনো মাদক ও চামড়া পাচারকারী সীমান্তে আটক, নির্যাতন কিংবা হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন তা কখনোই শোনা যায় না। তার কারণ হলো, ওইসব ব্যবসায়ীদের থেকে তারা নিয়মিত নগদ অর্থ পান বলেই তারা ধরাশায়ী হয় না। তাছাড়া, এসব পণ্য পাচার হলে ভারতেরই লাভ বেশি। তাই বিএসএফ তা দেখেও না দেখার ভান করে।
আমরা জানি, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে ৪ হাজার ৯৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত। এর মধ্যে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে দুই হাজার ২১৬ কিলোমিটার, ত্রিপুরার সঙ্গে ৮৫৬ কিলোমিটার, মেঘালয়ের সঙ্গে ৪৪৩ কিলোমিটার, মিজোরামের সঙ্গে ৩১৮ কিলোমিটার এবং আসামের সঙ্গে ২৬২ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের। দুই দেশের মধ্যে এই সীমান্ত অংশের একটি বিশাল জায়গায় এখনো কোনো বেড়া দেয়া হয়নি। কোথাও পাহাড়, কোথাও নদীসহ নানা ফাঁক ফোকর থাকায় এসব সীমান্ত এলাকা দিয়ে সব সময়ই অবৈধ চলাচল হয়ে থাকে। এক্ষত্রে অনুপ্রবেশ ঘটলে আটক করা বা পতাকা বৈঠকের পর তাদের ফেরত দেয়া কিংবা অপরাধের ধরন অনুযায়ী তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসার বিধান থাকলেও তা পালন করার সময় পাচ্ছে না বিএসএফ। বিএসএফ বিনা বিচারে তাদের নির্যাতন ও হত্যা করছে। কেউ হয়তো বলবেন, চোরাচালান করতে গিয়ে তারা মারা পড়ছেন। তর্কের খাতিরে হয়তো তার কথা ওই সময়ের জন্য মেনেও নিবো। তবে, চোরাচালান তো কোন একটি পক্ষের দ্বারা সম্ভব নয়। কোনো কিছু পাচার করতে হলেও ভারতীয়দের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব নয়। তাহলে ভারতীয়রা কেন বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় না। বিজিবি সদস্যরাও তো ভারতীয়দের ওপর গুলি চালাতে পারেন, কিন্তু তারা তো সে কাজটি করছেন না। বাংলাদেশ কেন নতজানু পররাষ্ট্রনীতি মেনে চলছেন সে রহস্য প্রকাশ হচ্ছে না।
অধিকার সম্পাদক আদিলুর রহমান খান বিবিসিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তটি পৃথিবীর সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সীমান্ত। সীমান্ত সম্মেলনের ফল জনগণ ভোগ করতে পারেনি। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স শ্যুট-অন-সাইট (দেখা মাত্র গুলি) নীতির ফলে সীমান্তে লাশের মিছিল কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন অনুসারে কোনো দেশ অন্য দেশের নাগরিককে হত্যা করতে পারে না। সে দিক থেকে ভারত বাংলাদেশের কাছে অপরাধী রাষ্ট্র। ২০১১ সালে ফেলানীর লাশ প্রায় ৫ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলেছিল বলে বিশ্বব্যাপী তোলপাড় হয়েছিল। আর যাদের লাশ ডোবা আর নর্দমায় পড়ে থাকে তাদের কথা হয়তো অজানাই থেকে যায়।
দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকেটি মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার আদায়ে সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে। সাধারণ মানুষ মনে করে সরকার চাইলে অবশ্যই এর প্রতিবাদ ও প্রতিকার হওয়া সম্ভব। সরকারকে দেশের মানুষের প্রতি আরো আন্তরিক হয়ে কাজ করতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে কোনো একটি মানুষও ক্ষতিগ্রস্থ হবে না এমন চিন্তা নিয়েই দেশ চালাতে হবে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
[email protected]