কিছুতেই থামছে না সীমান্তে হত্যা। দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বিএসএফ। জুলাই মাসেই ৫ বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে তারা। সর্বশেষ গত সোমবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার দাঁতভাঙ্গার সীমান্তবর্তী এলাকায় নূরুল আমীন (৩২) নামের এক যুবককে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। গত ১৪ জুলাই একই এলাকায় ব্রিজের উপর থেকে পাথর নিক্ষেপ করে রাশেদুল ইসলাম (২৭) নামে এক বাংলাদেশিকে বিএসএফ হত্যা করেছিল। আবার, গত ৪ আগস্ট রাতে ঝিনাইদহের মহেশপুর বাঘাডাঙ্গা সীমান্তে একইভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করা হয় গরু ব্যবসায়ী মোঃ আলম হোসেন (৩২)। বার বার সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্র“তি দিলেও বাস্তবায়ন হয়নি। চলতি বছরে এ পর্যন্ত ২৩ জন নিহত হয়েছে বিএসএফ’র হাতে। আর গত ১০ বছরে নিহত হয়েছেন ৬৮৪ বাংলাদেশি।
সূত্রমতে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র পক্ষ থেকে বারবার বাংলাদেশ সীমান্তে গুলি বন্ধের প্রতিশ্র“তি দেয়ার পরও প্রতিনিয়ত নিরস্ত্র বাংলাদেশীদেরকে গুলি করে হত্যা করছে। গত ২২ জুলাই ভোররাতে বেনাপোলের পুটখালী সীমান্তে শহিদুল ইসলাম ফনি (৩২) নামে বাংলাদেশী এক গরু ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফ। নিহত শহিদুল ইসলাম পুটখালী গ্রামের সাদেক আলীর ছেলে।
একইদিন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চক কানাপাড়া সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীটির গুলিতে গরুর ব্যবসায়ী আবুল কালাম আজাদ (৩০) নিহত হন। তিনি গোদাগাড়ীর সীমান্তবর্তী চক কানাপাড়া এলাকার কদম আলীর ছেলে। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয়েছে, আবুল কালাম মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। গোদাগাড়ী মডেল থানার ওসি এসএম আবু ফরহাদ জানান, সীমান্ত এলাকায় বিএসএফের গুলিতে নিহত হয়েছেন আবুল কালাম আজাদ। তারও দুইদিন আগে ২০ জুলাই সাইফুল ইসলামকে হত্যা করেছে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী সীমান্তে। এলাকাবাসীর দাবি এটিও বিএসএফ ঘটিয়েছে।
গ্রামবাসীর অভিযোগ, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সদস্যরা তাকে পিটিয়ে মেরেছে। সাইফুল ইসলাম জলপাইতলী সীমান্তঘেঁষা বানাহার গ্রামের মোঃ মকলেছার রহমানের ছেলে। গত ১৪ জুলাই কুড়িগ্রামের রৌমারী সীমান্তের একটি ব্রিজের উপর থেকে পাথর নিক্ষেপ করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) রাশেদুল ইসলাম (২৭) নামে এক বাংলাদেশীকে হত্যা করে। উপজেলার বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের ১০৬৬/১ এফ নং আন্তর্জাতিক সীমানা পিলারের কাছে ভন্দুরচর সীমান্তের কালোর ব্রিজ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত রাশেদুল উপজেলার রৌমারী সদর ইউনিয়নের পূর্ব ইজলামারী এলাকার নয়ারচর গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে।
গত ১০ জুলাই নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার চকিলাম সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলিতে গোলাপ হোসেন (৩২) নামে এক বাংলাদেশী যুবক নিহত হন। নিহত গোলাপ স্থানীয় সীমান্তবর্তী চন্ডিপুর গ্রামের খয়রুলের ছেলে। ১৩ জুলাই চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার বাড়াদী সীমান্তে গিয়াসউদ্দিন (৩২) নামের এক কৃষককে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ধরে নিয়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে পিটিয়ে আহত করেছে। নির্যাতনের ঘটনার পর বিজিবি-বিএসএফ’র পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তাকে ফেরত এনে দর্শনার একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। গিয়াসউদ্দিন উপজেলার বাড়াদী গ্রামের আব্দুল মজিদের ছেলে।
সূত্রে জানা গেছে, জুলাই মাসে পাঁচজনসহ ২০১৬ সালে এ পর্যন্ত মোট ২৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ওয়েব সাইটে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সীমান্ত হত্যার একটি পরিসংখ্যান দেয়া আছে। সেখানে বিগত ৬ মাসে ১৬ জনের নিহতের তথ্য রয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন হামলার ঘটনায় ১৭ জন বাংলাদেশীকে আহত এবং ১৮ জনকে সীমান্ত থেকে অপহরণ করেছে ভারতীয় বাহিনী। ১০ বছরে ৬৮৪ হত্যাকান্ড এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০৬ সাল থেকে চলতি বছর পর্যন্ত বিগত ১০ বছরে ৬৮৪ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা।
অবশ্য গত ২৯ মে জাতীয় সংসদে এক সদস্যের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, এসময়ের মধ্যে বিএসএফের হাতে নিহত বাংলাদেশীর সংখ্যা ৫৯১ জন। এসব হত্যাকান্ডের মধ্যে কিশোরী ফেলানির মতো আলোচিত হত্যাকান্ডও রয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী সর্বোচ্চ সংযত আচরণ করবে। ভারতের দিক থেকে এমন আশ্বাস বহুবার দেয়া হলেও সেটি তেমন একটা কাজে আসেনি। ২০১৪ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের স্বরাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরালোভাবে সীমান্ত হত্যার ইস্যুটি তুলে ধরা হয়। এর আগেও একাধিকবার আগেও বাংলাদেশের সীমান্ত বাহিনী বিজিবির পিলখানাস্থ সদর দফতরে আয়োজিত ‘সীমান্ত সম্মেলন’-এ সীমান্ত হত্যার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরেছিল বিজিবি। এসব বৈঠকে সীমান্তে গুলি ও হত্যা বন্ধে যৌথ পদক্ষেপ নেয়া প্রতিশ্র“তি ভারতের পক্ষ থেকে দেয়া হলেও এরপরে শতাধিক বাংলাদেশীকে হত্যার ঘটনা ঘটছে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনার সমন্বয়ক এড. মোমিনুল ইসলাম বলেন, সীমান্তে সব আইন ও অধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। দু’দেশের মধ্যে সমঝোতা এবং এ সম্পর্কিত চুক্তি অনুযায়ী, যদি কোন দেশের নাগরিক অনুনোমোদিতভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে, তবে তা অনুপ্রবেশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার কথা। ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের নিয়ম রয়েছে। তবে এই সমঝোতা এবং চুক্তি লঙ্ঘন করে সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের গুলি করে হত্যা করছে।